মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০০ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক: মডেল ও অভিনেত্রী রোমানা ইসলাম স্বর্ণা ২০১৭ সালে তার প্রথম স্বামীকে তালাক দেন। বিয়ে করেন একজন আইনজীবীকে। কিছুদিন সংসার করার পর তাকেও তালাক দেন। এরপর সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলামকে তৃতীয় বিয়ে করেন। বিয়ের পর প্রতারণা করে কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ স্বর্ণার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় মামলাও করেছেন সৌদি প্রবাসী কামরুল। ভুক্তভোগী ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন— অভিনেত্রী স্বর্ণা প্রতারণার উদ্দেশ্যে তার মা আশরাফী ইসলাম শেইলী, ছেলে আন্নাফি ইউসুফ ওরফে আনান, নাহিদ হাসান জেমি, ফারহা আহম্মেদ ও অজ্ঞাত এক যুবক মিলে সহজ-সরল ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কৌশলে বিয়ে করে টাকা আত্মসাতের পরে ভয়-ভীতি দেখাতেন। প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর তালাক দেন।এদিকে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি টাকারও বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গত ১১ মার্চ অভিনেত্রী স্বর্ণাসহ আরও ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সৌদি প্রবাসী কামরুল ইসলাম। মামলার পরদিন স্বর্ণা, তার মা শেইলী, ছেলে আন্নাফিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে রয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) দুলাল হোসেন বলেন, ‘অভিনেত্রী রোমানা ইসলাম স্বর্ণাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। তথ্যের ভিত্তিতে গোপনে তদন্ত চলছে। মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্ব সহকারেই তদন্ত করা হচ্ছে।’
মামলার বাদী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর আমি সৌদি আরবে থাকি। রোমানা ইসলাম স্বর্ণার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারি তার প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে তিনি ২০১৭ সালে পুনরায় বিয়ে করেছেন। কিছুদিন পরে তাকেও তালাক দেন। লোক মারফতে জানতে পারি আসামি রোমানা প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে তার মা, ছেলেসহ কয়েকজন মিলে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কৌশলে বিয়ে করে টাকা আত্মসাতের পরে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে তালাক দেন। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা করে আমার দীর্ঘ প্রবাস জীবনের কষ্টার্জিত টাকা আত্মসাৎ করে আমাকে আজ পথে বসিয়ে দিয়েছে। আমি তাদের সবার শাস্তি চাই।’
মা-ছেলেকে নিয়েই স্বর্ণার ‘প্রতারক চক্র’
জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) দুলাল হোসেন গত ১৭ মার্চ আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। সেখানে স্বর্ণা ও তার পরিবারের সদস্যদের একটি প্রতারক চক্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে তিনি বলেছেন, গত ১২ মার্চ আদালতের নির্দেশ মোতাবেক আসামি রোমানা ইসলাম স্বর্ণা (৪০), তার মা আশরাফী আক্তার শেইলী (৫৭) ও ছেলে আন্নাফি ইউসুফ ওরফে আনানকে (২১) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা মামলার তদন্ত সহায়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
এতে আরও বলা হয়, আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে গোপন রেখে তদন্ত অব্যাহত রাখা হয়েছে। আসামিরা একটি প্রতারক চক্র। এমতাবস্থায় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিদেরকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত জেলহাজতে আটক রাখা প্রয়োজন। আসামিদের নাম-ঠিকানা যাচাই প্রক্রিয়াধীন। মামলাটির তদন্ত অব্যাহত আছে।
বাসায় ডেকে নিয়ে অর্ধনগ্ন ছবি তুলে ব্লাকমেইল
মামলার অভিযোগে বাদী কামরুল বলেন, ২০০৪ সালে সৌদি আরবে গিয়ে ২০০৫ সাল থেকে ব্যবসা শুরু করি। বর্তমানে আমি মক্কায় নাবিয়াহ আল-মদিনা ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যালি কোম্পানি নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি আমি ঢাকার মিরপুরে কে এম ফুয়েল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
তিনি আরও বলেন, ২০১৮ সালে স্বর্ণার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। স্বর্ণা নিজেকে চিত্রনায়িকা পরিচয় দেন। পরিচয়ের শুরুতে স্বর্ণা আমাকে জানান, তার স্বামী মারা গেছেন। তার এক সন্তান রয়েছে। তখন স্বর্ণার সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ হতো আমার। পরিচয়ের পর থেকেই স্বর্ণা নানা অজুহাতে আমার কাছে টাকা চাইতেন।
‘দেশের রাজনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ আছে জানিয়ে আমার ব্যবসায় সহযোগিতার কথা বলে ঘনিষ্ঠ হন স্বর্ণা। একপর্যায়ে তার ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতে সহযোগিতা চান। স্বর্ণা উবারে চালানোর জন্য একটি গাড়ি কেনার জন্য একটি লোন করিয়ে দিতে বলেন। যার বিনিময়ে প্রতিমাসে লভ্যাংশ দেবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন। তখন আমি স্বর্ণাকে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেই। এরপরই আবার ব্যবসার উদ্দেশ্যে কম দামে একটি ফ্ল্যাট কেনার প্রস্তাব দেন স্বর্ণা। তখন আবার স্বর্ণাকে ৬৬ লাখ টাকা দেই। এ ছাড়া নানা অজুহাতে স্বর্ণা কামরুলের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন’ বলেন কামরুল।
কামরুল আরও বলেন, ২০১৯ সালের ১০ মার্চ সৌদি থেকে দেশে আসি। এর তিনদিনের মাথায় ১৩ মার্চ স্বর্ণা উবারে ভাড়ায়চালিত প্রাইভেট কার ও ফ্ল্যাট দেখার জন্য মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ার বাসায় ডাকেন। ১৪ মার্চ আমি ওই বাসায় যাই। সেখানে অজ্ঞাত এক যুবক ছিলেন। তখন স্বর্ণা আমাকে চা-নাস্তা দেন। নাশতা খেয়ে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। জ্ঞান ফিরলে আমি নিজেকে ওই ফ্ল্যাটে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পাই। তখন আমি চিৎকার শুরু করলে রুমে স্বর্ণা, তার ভাই নাহিদ হাসান ও অজ্ঞাত এক যুবক প্রবেশ করে।
‘এর মধ্যে স্বর্ণা আমার সঙ্গে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় দুই-তিনটি ছবি দেখিয়ে বলে— চিল্লাচিল্লি করবি না। গাড়ি ও ফ্ল্যাট বাবদ যে টাকা দিছিস তা ভুলে যা। আমাকে বিয়ে করতে হবে তোকে। না হলে সৌদি আরব ও বাংলাদেশে তোর পরিচিত যত মানুষ আছে সবাইকে এ ছবি দেখিয়ে মানসম্মান নষ্ট করব। তাছাড়া তোর নামে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা করব।’
কামরুল আরও বলেন, ‘স্বর্ণার মা আশরাফী আক্তার শেইলী ও তার ছেলে আন্নাফি স্ট্যাম্প ও কলম হাতে কক্ষে প্রবেশ করে আমাকে তাতে স্বাক্ষর দিতে বলে। আমি স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আমার মোবাইল থাকা বিভিন্ন পরিচিতজনের নম্বরে ফোন করে স্বর্ণাকে ধর্ষণ করেছি বলে জানানোর হুমকি দেয়। নাহিদ হাসান জেমি ও অজ্ঞাত এক যুবক হত্যার উদ্দেশ্যে আমাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। আমি মানসম্মান ও প্রাণভয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করি।’
‘উপস্থিত সবাই হুমকি দেয়- আমি সাত দিনের মধ্যে স্বর্ণাকে বিয়ে না করলে মিথ্যা মামলার পাশাপাশি মানসম্মান নষ্ট করার জন্য যা যা করা দরকার তারা সব করবে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমার ড্রাইভারের সহায়তায় আমি বাসায় ফিরি। বিষয়টি প্রথমে আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নিলেও সামাজিক মর্যাদা ও মানসম্মানের ভয়ে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসি। হুমকির মুখে ২০ মার্চ নিকাহনামা রেজিস্ট্রির মাধ্যমে আমি তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে বাধ্য হই। নিকাহনামায় সে নিজেকে বিধবা হিসেবে উপস্থাপন করে। স্বর্ণার নির্দেশনায় দেনমোহর বাবদ নগদ ১০ লাখ টাকা পরিশোধের পাশাপাশি তার চাহিদা মতো ৩৩ ভরি স্বর্ণ দিতে বাধ্য হই।’
স্বর্ণার বিরুদ্ধে এর আগেও প্রতারণা মামলা
মামলার অভিযোগে বাদী কামরুল উল্লেখ করেছেন, আমি তার বাসায় কয়েক দিন অবস্থান করতে বাধ্য হই এবং ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল সৌদি আরবে চলে যাই। সৌদি আরবে যাওয়ার পর প্রথম দিকে সে আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে এবং আমি তাকে নিয়মিত সাংসারিক খরচ দিতাম। চার-পাঁচ মাস পর সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে থাকে এবং দেখা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ বিষয়ে আমি তার পরিবারের সঙ্গে কথা বললে তারাও আমাকে ভয়ভীতি ও হুমকি দেয়। স্বর্ণার আচরণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে ফ্ল্যাট ও গাড়ি বুঝিয়ে দিতে বললে সেসব নেই বলে জানায়।
২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি আদালতে মামলা করেন কামরুল। মামলার পর স্বর্ণা টাকা, স্বর্ণালংকার, ফ্ল্যাট ও গাড়ি ফেরত দিতে চাইলে মামলা প্রত্যাহার করে সৌদি আরব ফিরে যান কামরুল। চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরব থেকে কামরুল বাংলাদেশে এসে ফোন করলে লালমাটিয়ার বাসায় যেতে নিষেধ করেন স্বর্ণা।
এজাহারে তিনি আরও উল্লেখ করেন, ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে ফোন করলে স্বর্ণা তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে। মোহাম্মদপুর থানার এসআই সাইফুল ইসলাম ও ফোর্সসহ রাত অনুমান ৩টার দিকে ওই বাসায় যাই। বাসার সিকিউরিটি জানায়, রাত আনুমানিক ২টা ৪০ মিনিটে স্বর্ণা বাসায় ফিরেছে।
কামরুল বলেন, আমি পুলিশ নিয়ে তার ফ্ল্যাটের সামনে যাই। স্বর্ণা দরজা না খুলে মোবাইলে এসআই সাইফুল ইসলামকে জানায়— ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর সে আমাকে তালাক দিয়েছে। পরে এসআই সাইফুল ইসলাম তালাকের কপি আমার হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে পাঠান। আমি তালাকের কপিটি যাচাইয়ের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন অফিসে আবেদন করে জানতে পারি যে, তালাক নোটিশটি জাল।
সৌজন্যে : জাগোনিউজ ২৪