রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪৯ অপরাহ্ন
:আফতাব চৌধুরী:
কাঠবিড়ালি ও ইঁদুর এই দুয়ের মাঝখানে আর একটি অদ্ভুত জীব এসে পড়েছে সারা সিলেট জুড়ে। জেলার সর্ব এই অত্যন্ত ব্যাপক উপদ্রব করছে ‘কটা’ জাতীয় জীবটি। যে কোনও ফলের গাছ থেকে যখন-তখন কাঁচা ফলটি খেয়ে নিচ্ছে। গাছের কুঁড়ি পাতা, বাকল, সুপারি- নারকেল গাছের কচি ফল, পাকা- কাঁচা নারকেল গোল ছিদ্র করে কেটে ভিতরের সার আঁশ খেয়ে নিচ্ছে। এরা কখনও একা বা দু’-তিনটি একসঙ্গে গাছে চড়তে দেখা যায়। চলে অতি দ্রæত গতিতে। এক ডাল থেকে অন্য ডালে, এক গাছ থেকে ৭-৮ হাত দূরে অন্য গাছে পাখির মতো উড়ে যায়। নিখুঁত নিশানায়। ২০১৮ সাল থেকে এরা সিলেট মÐলে প্রবেশ করেছে। প্রথমে কেউ ততটা আশঙ্কা করেনি ওদের দেখে। কারণ, ফল তো বাঁদরেও খায়, বাঁদুড়েও খায়, পাকা কাঁঠাল আমাদের দেশি ‘কটই খেয়ে থাকে। দিনের বেলায় কত প্রকার পাখিও খেয়ে যাচ্ছে। সবুজ ছোট ছোট টিয়া জাতীয় পাখি, চিরপরিচিত বুলবুলি, শালিক, কোকিল, কাক এরাও ফল পাকা পেলে খায় তবে গৃহস্থের সর্বনাশ করে না। এই আপদ প্রাণীটি সিলেটের গ্রামীণ জীবনে ভীষণ আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতকরা ৫০টি সুপারি গাছ এরা ধ্বংস করে দিচ্ছে, গাছের মজ্জা দাঁত দিয়ে কুটকুট করে কেটে খেয়ে ফেলে। ফলে গাছটি মরে যায়। একই ভাবে প্রথমে পাকা নারকেল গোল করে কেটে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে নারকেলের জল ও শাঁস খেয়ে নেয়। পরে কচি ডাবও খেয়ে নেয় একই ভাবে ছিদ্র করে। যখন নারকেল গাছে ফল থাকে না, তখন ওই কটাগুলো গাছের আগায় বাসা বানায়, বাচ্চা দেয়। খাদ্য কম পেলে গাছের আগা (মজ্জা) খেয়ে নেয়, বাচ্চাদের খাওয়ায়। ফলত গাছগুলো মরেই যায়। তিন বছর আগে একজোড়া নারকেল বাজারে বিক্রি হতো ২০/৩০ টাকা দরে। আজ একজোড়া ২০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে। সিলেটের সুপারি সারা দেশে বিখ্যাত। ৩ বছর আগে শুকনো সুপারি কেজি। প্রতি দর ছিল ১০০/১৫০ টাকা। আজকাল পাওয়াই যাচ্ছে না- দাম উঠেছে ৭০০/৮০০ টাকার ওপর। বার্মিজ সুপারি বাজারে এসেছে। সদরী কি চোরাপথে জানি না, তবে দর উঠেছে কেজি প্রতি ৫০০ টাকার ওপর।
আম, আতা, লিচু, ভুবি, পেয়ারা, কলা, আনারস প্রভৃতি সব ধরনের ফলেরই শত্রæ এই ‘কটা’। গ্রামাঞ্চলে সবাই ‘কটা’ সম্পর্কে ভীষণ উদ্বিগ্ন। কেউ বলেন ‘গুলাইল দিয়া মারো’, কেউ বলেন তীর-ধনুক দিয়া মারো। আবার কেউ বিষ প্রয়োগে, ইঁদুরের ছাঁট দিয়ে ধরার কথা বলছেন। কিন্তু সবাই অকৃতকার্য এদের কাছে। বড় ও মাঝারি মাপের গ্রামের বাড়িতে অনেকেরই সুপারি-নারকেল থেকে নিজে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে। দশ-পনেরো হাজার টাকা বার্ষিক আয় হয়। কেউ সুপারি-নারকেল বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও চাষ করেন। এদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। অর্ধেকের বেশি গাছ মরে গেছে কটার উপ্রদবে। বাকি গাছে যে তুচ্ছ পরিমিত ফল আছে, তা তাদের নিজের পরিবারের প্রয়োজনই মেটাতে পারে না। একটা বহিরাগত ছোট জীব যে সিলেটের জনজীবনে এমন আর্থিক ক্ষতি করে যাচ্ছে, তা শহুরে জীবনের মানুষ অনেকেই ভাবতেও পারেন না।
ইঁদুরের উপদ্রব, বইয়ের পোকা, ‘কুতি’ পোকা মানুষের খাদ্য খেয়ে অনেক ক্ষতি করে। ক্ষতির পরিমাণ সঞ্চিত খাদ্যের ৩০ থেকে কোথাও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। ইঁদুর সাধারণত ধান, চাল, গম, আটা, আলু,আনাজপাতি খেয়ে থাকে। এদের শত্রু বিড়াল। গ্রাম-শহরে এখনও অনেকেই বিড়াল পোষেন। ‘কুতি’ পোকা, বইয়ের পোকা, তেলাপোকাদের ঠেকাতে বিষাক্ত ওষুধ, পাউডার প্রয়োগ করেন অনেকেই। সংগৃহীত ধান, চালের ভাÐের উপর নিম/নিশিন্দাপাতা ছড়িয়ে রাখলে ওইসব পোকার আক্রমণ রোধ করা যায়। ইঁদুর কখনও ভয়ঙ্কররূপে খাদ্য গুদামে হানা দেয়। গল্পে আছে ‘চওঊউ চওচঊজ’ বাঁশিওয়ালা এক শহরের হাজার হাজার ইঁদুর নিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ায় খরগোশের আক্রমণে সারা মহাদেশ আক্রান্ত হলে সরকার এদের ধ্বংস করতে বাধ্য হয়েছিল। কিছুদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপকভাবে কাঙারুও হত্যা করা হয়েছিল। বার্ড ফ্লু দেখা দিলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই মুরগি হত্যা করে, পোড়ায় বা পুঁতে রাখা হয়। পঙ্গুপালের আক্রমণ তো বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই হয়। কৃষির সর্বনাশ করে ফেলে এরা গাছ খেয়ে। হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিষাক্ত ওষুধ ছড়িয়ে পঙ্গপাল দমন করতে দেখা গেছে।
জেলার সদরেই কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণমূলক অফিস বর্তমান। এদের তত্ত্বাবধানে কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ এবং কৃষিবিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্যপাতি ও উপদেশ দেওয়া হয়ে থাকে। সদর অফিস থেকে গ্রামেগঞ্জে কৃষি পরিদর্শনে এদের বড় একটা দেখা যায় না। কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ ব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়ে আছে। গতানুগতিক খাল-নালার জল আর বৃষ্টির জলই সিলেটের কৃষিকর্মের মূলাধার। তার ওপর বাড়তি এই বহিরাগত ‘কটা’র উপদ্রব, যা কৃষি ও কৃষকের গ্রামীণ জীবনকে অশেষ ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তার খবর কি জেলার কৃষি বিভাগ এখন পর্যন্ত জেনেছে? সুপারি, নারকেল- অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলঘুরে এসে এই লেখা লিখেছি। আমার নিজের বাড়িতেও অত্যন্ত ২টি নারকেল গাছ মেরে ফেলেছে কটা। আর বাকি ৫/৬ টির সব ফল খেয়ে ফেলেছে। বছরে যেখানে ৫০০/৬০০ টি নারকেল গাছথেকে যোড়ে নিজেকে মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা কওে খেতাম এখন কটার উপ্রদবে তার খাওয়া যাচ্ছেনা।
আমার বাসায় একটি সাদা বিড়াল আছে, সে এমন শিকারি যে, নিয়ত ইঁদুর ধরে মেরে ফেলে কিন্তু সেই বেড়াল ২/৩টি কটাও ধরে মেরেছে। ইঁদুর ধরার কলেও ধরা পড়েছে ২/৪টি। কিন্তু এদের সংখ্যা যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিবিভাগকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
সাংবাদিক কলা মিস্ট।১৪.০১.২০২৪