শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:২৮ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী
ঈদ। ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ঈদ-উল ফিতরের দিনক্ষণে কোনও পরিবর্তন নেই যদিও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি বছর ঈদ ১১ দিন এগিয়ে আসে। আবার যদি গ্রেগরির ক্যালেন্ডারে বর্ষের প্রথম ১০ দিনের মধ্যে ঈদ এসে যায় তাহলে একই বছরের শেষ সপ্তাহে দ্বিতীয় ঈদের দিনক্ষণ স্থির হয়। গ্রেগরি ক্যালেন্ডারের তারিখ বিভিন্ন দেশে ভিন্নভাবে দেখা যায়। মূলত একটি দেশের চন্দ্র দর্শনের উপর নির্ভর করেই এই পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের বিজ্ঞ ও বিশিষ্টজনেরা নিজেদের দেশের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করেই ইসলামি ক্যালেন্ডারের দিন গণনা করেন। ইসলামি ক্যালেন্ডার মতে, একটি দিনের শুরু হয় সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর। একই ভাবে ঈদ-উল ফিতরেরও শুভারম্ভ ঘটে সূর্য অস্ত যাওয়ার পর। প্রসঙ্গত, ইসলামি ক্যালেন্ডার হচ্ছে চন্দ্রনির্ভর। বিপরীতে, সূর্যনির্ভর হচ্ছে গ্রেগরি ক্যালেন্ডার।
ঈদ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে ঈদ অফুরন্ত খুশির এক ফোয়ারা যা সমাজের সবচাইতে দীন-দরিদ্র থেকে শুরু করে বিত্তবানদের মধ্যে সমানতালে খুশির বহর নিয়ে আসে। ইসলামি অভিধান মতে, ঈদ শব্দের অর্থ বারবার আগমন করা। অর্থাৎ প্রতি বছর বিশ্ব মুসলমানদের অন্তরে আনন্দ ও খুশি নিয়ে যার পুনরাগমন ঘটে, সেটাই ঈদ। ঈদ বলতে দুটো উৎসব বোঝায়। প্রথমটি ঈদ-উল ফিতর, অপরটি ঈদ-উল আজহা। আবার দু’টি ঈদের পার্থক্য হচ্ছে- সংযম ও দানের উৎসব ঈদ-উল ফিতর এবং ত্যাগের উৎসব ঈদ-উল আজহা।
আজ বিশ্ব মুসলমানদের দরজায় কড়া নেড়েছে ঈদ-উল ফিতর। এই ঈদ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে পালন করা হয়, এ নিয়ে আলোচনা করা যাক। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অধিকাংশ মুসলমান ঈদ-উল ফিতরের আগের রাতকে ‘চাঁদ রাত’ বলে বর্ণনা করেন। এসব দেশের মুসলমানরা পরিবার নিয়ে ঈদের আগের দিনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত কেনাকাটা করেন। মহিলারা, বিশেষ করে তরুনীরা মেহেন্দির রঙে নিজেদের সাজিয়ে তোলেন। ঈদের সময় চিরাচরিত প্রথায় ‘ঈদ মোবারক’ বলে একে অপরকে সম্ভাষণ করেন। দান-খয়রাত করা হয়। একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, এসব দেশের প্রায় শিশুরই হাতে ঈদের দিন ছোট অঙ্কের অর্থ দেন বড়রা। তাছাড়া এই দেশগুলোর ছেলে-মেয়েরা অন্তত ঈদের দিন তাদের বাবা-মার পায়ে ধরে সালাম করে। নিকটাত্মীয় বয়োজ্যেষ্ঠদেরও একইভাবে সালাম করে তাদের ছোটরা। ঈদের নামাজের পর পরিবার-পরিজনেরা মৃত নিকটাত্মীয়দের আত্মার মাগফেরাত কামনায় কবরস্থানে গিয়ে কিংবা সে উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ মোনাজাত করেন। এ ধরনের প্রার্থনা সচরাচর দেখা যায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে।
পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও ফিজিতে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ধরনের খাবারও তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতে সেমাই ও চটপটি উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া ইসলাম ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী অর্থনৈতিক দিক থেকে সচ্ছল ব্যক্তিরা যাকাত, ফিতরা ইত্যাদি গরীবদের মধ্য বণ্টন করেন। সাধারণত ঈদের নামাজের আগেই তা বণ্টন করা হয়ে থাকে। ঈদের নামাজে উল্লেখযোগ্য লোক জমায়েত হয়। এসব দেশে ঈদের দিন সরকারি ছুটি ঘোষিত। দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ব্রæনেইতে মহা ধুমধামে ঈদ পালিত হয়। বিশ্বের সবচাইতে বেশি মুসলমান অধ্যুষিত দেশ হিসাবে ইন্দোনেশিয়ার আনাচে-কানাচে তা পালিত হয়। সেদেশে ঈদ-উল ফিতরকে ‘ঈদুল ফিতরি’ বলা হয়। দেশটিতে ঈদ উপলক্ষে প্রত্যেক কর্মচারীকে বেতন-বোনাস প্রদান করা বাধ্যতামূলক। তাদের পরিভাষায় এই বোনাসকে ‘তুনজানগান হ্যারি র্যায়া’ বলা হয়। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ব্রæনেইয়ে ঈদ সাধারণত ‘হ্যারি র্যায়া অ্যাইদিল ফিতরি’ অথবা ‘হ্যারি র্যায়া পুসা’ নামে পরিচিত। ‘হ্যারি র্যায়া’ মানে উৎসবের দিন।
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ঈদের দিনকে শুধুই উৎসবের দিন হিসাবে গণ্য করা হয় না, দিনটি পাপমোচনের অতি উত্তম দিন হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। ইন্দোনেশিয়ায় পাপমোচনের জন্য ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বলেন, মোহন মাফ লাহির ডান বাতিন।’ মালয়েশিয়ায় একই কারণে মুসলমানরা উচ্চারণ করেন-‘মাফ জাহির ডান বাতিন।’ উভয় দেশে ঈদের দিন চিরাচরিত ডিজাইনের কাপড় পরিধান করে লোকজন। ইন্দোনেশিয়ার পরিধেয় এই কাপড়কে বলা হয়-‘বাজু কুকু’। মালয়েশিয়ায় এর নাম ‘বাজু মিলায়ু’। উভয় দেশের মহিলারাও চিরাচরিত কাপড় পরিধান করেন। ইন্দোনেশিয়ার এহেন পরিধেয়কে বলা হয় ‘কেবায়া ক্রডং। অপর দেশ মালয়েশিয়ায় এটিকে বলা হয় বাজু কুরুং। মায়ান্মারে এই উৎসবের আমেজ তেমন নেই। মাত্র একদিনই উৎসবের আমেজ সতেজ থাকে দেশটিতে। দিনটিকে তাদের পরিভাষায় হয় ‘ঈদ নেই।’ নেই মানে দিন। ঈদের দিন মায়ান্মারের মুসলমানরা চিরাচরিত খাদ্য ও কাপড় পরিধান করেন। রমজান মাসে দেশটির যুব সমাজ এক ধরনের গানের দল তৈরি করে। এই দলকে বলা হয় ‘জাগো।’ হিন্দি অথবা উর্দু ভাষায় গ্রামে গ্রামে, শহরে এসব দল গান গেড়ে বেড়ায়। সাহরির পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত এসব গান গেয়ে থাকে। বিশেষ করে জনপ্রিয় বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের বিশেষ বিশেষ গানকে পছন্দ করে এসব গানে নিজেদের ভাষায় সুরারোপ করে নেয় গানের দল। দেশটিতে বিশেষ করে সুন্নি মুসলমানদের বসবাস। দেশটিতে ঈদের দিন সরকারি ছুটি রয়েছে।
ফিলিপাইনে মুসলমানদের সংখ্যা কম। তবে দেশটির রিপাবলিক অ্যাক্ট অনুসারে ২০০২ সালের ১৩ নভেম্বর থেকে মুসলমানরা সরকারি ছুটি হিসাবে দিনটি উপভোগ করেন। চেক প্রজাতন্ত্র এবং চীনেও ঈদের দিন সরকারি ছুটি রয়েছে। তবে অঞ্চলভিত্তিক এই ছুটি অনুমোদিত। চেক প্রজাতন্ত্রের ৫৬টি জাতির মধ্যে ১০টি জাতি ঈদ পালন করে।
আফ্রিকার প্রায় দেশেই ঈদ ধুমধামে পালন করা হয়। বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকায় এর প্রভাব বেশি। টিউনিসিয়ায় তিন থেকে চারদিন ঈদ উৎসব পালন করা হয়। বিশেষ ধরনের বিস্কুট বন্ধুবান্ধব ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যে আদান-প্রদান করা হয়। ঈদের নামাজের পর বিভিন্ন গান এবং নৃত্যের আয়োজন হচ্ছে দেশটির ঈদ পালনের অভিন্ন কার্যসূচি। কেপটাউনের গ্রিন পয়েন্টে ঈদের চাঁদ দেখতে অসংখ্য লোক জমায়েত হন। ঈদের চাঁদ দেখার পরই তা ঘোষণা করে মাগরিবের নামাজ পড়া হয়। নাইজেরিয়ায় ঈদ নিয়ে এক বিশেষ ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের ঈদ পালনে অংশ নেন খ্রিস্টানরাও। দেশটিতে ঈদকে বলা হয় ‘স্মাল সাল্লাহ’। আমেরিকা, ব্রিটেনেও মুসলমানরা উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ পালন করেন। দু’টি দেশেই ঈদ উপলক্ষে কোনও সরকারি ছুটি নেই। তবে মুসলমানরা অবসরের মাঝেই দিনটি পালন করে থাকেন। আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে ঈদের দিন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
সাংবাদিক-কলামিস্ট।