বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৪১ পূর্বাহ্ন
মাহফুজ শাকিল, কুলাউড়া থেকে : “আশ্রয়নের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার” মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারা দেশের ন্যায় কুলাউড়ায় ১ম ও ২য় পর্যায়ে মোট ২১০ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা হয় একটি পরিপূর্ণ ঘর। গৃহহীনদের জন্য যা স্বপ্নের বাড়ি। চারপাশে ইটের দেয়াল এবং ছাদে লাল ও সবুজ টিনের ছাউনি। ভূমিহীনরা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে তারা জীবনের একটা পর্যায়ে এসে এখন একটি নতুন ঘর পাবে। দীর্ঘদিন তারা অন্যের বাড়িতে দুঃখে কষ্টে আশ্রিত ছিলো। এখন তারা প্রত্যেকে উঠেছেন নিজেদের স্বপ্নের নীড়ে।
সরেজমিন সোমবার (১২ জুলাই) দুপুরে কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলী, জয়চন্ডী ইউনিয়নের উত্তর কুলাউড়া (পুষাইনগর), ভাটেরা ইউনিয়নের কড়ইতলা, ইসলামনগর এলাকায় প্রকল্পের অন্তত অর্ধ শতাধিক ঘর পরিদর্শন করে দেখা গেছে, দেশের অন্যান্য জেলা-উপজেলার তুলনায় কুলাউড়ায় আশ্রয়ন প্রকল্পের নির্মিত ঘরে এখন পর্যন্ত কোন অনিয়ম বা সমস্যা দেখা দেয়নি। ঘরগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে সবুজ ও লাল রঙের টিন। দুই রুমবিশিষ্ট ঘরে রয়েছে একটি রান্নাঘর, টয়লেট ও স্টোর রুম। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া স্বপ্নের বাড়িতে ইতিমধ্যে যারা উঠেছেন তাদের মধ্যে অনেক উপকারভোগীরা তাদের সন্তানাদিদের নিয়ে খুবই খুশিতে বসবাস করছেন। কেউ কেউ শোভাবর্ধনের জন্য ঘরের আঙ্গিনায় লাগিয়েছেন ফুল ও ফলের গাছ। ঘর ঘেঁষে তৈরি করছেন আলাদা আরও প্রয়োজনীয় গুদাম ঘর। সবাই খুব উৎফুল্ল, আনন্দিত। এদিকে অনেক উপকারভোগীরা জানালেন, ঘর পেলেও তারা এখনো বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যা রয়েছেন। তারা অতি দ্রæত এই সমস্যা নিরসনের দাবি জানিয়েছেন।
গত ১০ জুলাই কুলাউড়ার জয়চন্ডী ও কর্মধা ইউনিয়নে প্রকল্পের ঘরের কাজ সরেজমিন পরিদর্শন করে মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মল্লিকা দে। এছাড়া গত ১৯ জুন কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলী এলাকায় প্রকল্পের ঘর সরেজমিন পরিদর্শনে এসে ঘরের কাজের মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার-২ আবু জাফর রাজু। এসময় তিনি স্থানীয় উপকারভোগীদের সাথে কথা বলে তাদের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন এবং উপকারভোগীদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া কামনা করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি গণমাধ্যমকে কাজের সন্তুষ্টির কথা তুলে ধরে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গৃহহীনদের ঘর উপহার দিচ্ছেন। এই গৃহগুলোর কাজ পরিদর্শন করে দেখলাম। উপকারভোগীরাও ঘর পেয়ে অনেক আনন্দিত।
হেলাল মিয়া (৪১)। তিনি কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব কর্মধা এলাকার বাসিন্দা। পেশায় তিনি ভ্যান গাড়ি চালক। পরিবারে তার স্ত্রীসহ ১ ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তান রয়েছেন। একই ইউনিয়নের টাট্টিউলী এলাকার ফখরুল আলম (৩৭) পেশায় গাড়ী চালক। পরিবারে তার স্ত্রীসহ নয় বছরের এক ছেলে ও ৩ মাসের একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে। ফয়জুন বেগম (৪৬)। তাঁর স্বামী মৃত মনা মিয়া। গ্রামের বাড়ি কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নে। ১ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তান রয়েছে তার। আজিরুন বেগম (৪৫)। তার স্বামী মৃত কালা মিয়া। ১ ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তান রয়েছে তার। সে অন্যের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করে পরিবার চালাতেন।
জয়চন্ডী ইউনিয়নের উত্তর কুলাউড়া এলাকার বাসিন্দা গৌরি দাস (৪০)। তার স্বামী কৃতিষ দাস (৬০) পেশায় রিকশা চালক। তাদের দুই মেয়ে সন্তান রয়েছে। মো. শুকুর মিয়া (৪৫) একজন চটপটি বিক্রেতা। তার পরিবারে তিন ছেলে ও ১ মেয়ে সন্তান রয়েছে। সবজান বিবি (৫৫) একজন স্বামী পরিত্যক্তা। তার ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তান রয়েছে। তার বাড়ি কুলাউড়ার গাজিপুর এলাকায়। তিনি মানুষের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। নির্মল দাস (৬০) একজন রিকশা চালক। পরিবারে তার স্ত্রীসহ দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। নিপালী রাণী দাস (৩২) একজন স্বামী পরিত্যক্তা। তিনি কাপড় সেলাইয়ের কাজ করেন। তার দুই মেয়ে সন্তান রয়েছে।
গোলাপ মিয়া (৭০) বরমচাল ইউনিয়নের দক্ষিণ রাউৎগাও এলাকার বাসিন্দা। তার দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। তিনি দিনমজুরের কাজ করেন। ভাটেরা ইউনিয়নের কড়ইতলা এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি নতুন ঘর পেয়েছেন। জাবেদ মিয়া (৩৮) । ভাটেরা ইউনিয়নের বেড়কুড়ি গ্রামের বাসিন্দা। তার দুই মেয়ে সন্তান রয়েছে। তিনিও দিনমজুরের কাজ করতেন। ফিরুজ মিয়া (৪৫)। ভাটেরা খামাউড়া এলাকার বাসিন্দা তিনি। তার ১ মেয়ে সন্তান রয়েছে। রীণা বেগম (৫০) ৭ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। তার পরিবারে ৩ মেয়ে ও ২ ছেলে সন্তান রয়েছে। মানুষের সাহায্য-সহযোগিতায় তার পরিবার চলে। স্ট্রক করে তার এক হাত অবশ হয়ে গেছে। সবাই গৃহহীন হয়ে বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে আশ্রিত ছিলেন। এখন তারা প্রত্যেকে সরকারি ঘর পেয়ে বেজায় খুশি। তাদের চোখে মুখে যেন হাসির ঝিলিক। কিন্তুু মুজিববর্ষ উপলক্ষে তাদের সকলের ভাগ্যে বদল হয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে জমিসহ পেলেন একটি পরিপূর্ণ পাকা ঘর। স্বপ্নের নতুন ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, শেখের বেটি (শেখ হাসিনা) কারণে আমরা নতুন ঘর পাচ্ছি। কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি একটি পাকা ঘর পাবো। কিন্তুু শেখের বেটির কারণে আমাদের সেই কাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দীর্ঘদিন অন্যের বাড়িতে আশ্রিত ছিলাম এখন আমরা নিজেদের বাড়িতে উঠবো। সেটা আমাদের কাছে একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এখন মরার আগেও কিছুদিন শান্তিতে বাঁচতে পারবো। প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের মাথা গুজার ঠাঁই করে দিচ্ছেন। আমাদের ঘরে কোন সমস্যা নেই। প্রশাসন সবসময় আমাদের খোঁজখবর রাখছেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুলাউড়া উপজেলায় আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ১০০টি পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘরের খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা। উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক তালিকাভুক্ত ৪৪০ ভূমিহীন পরিবার রয়েছে। তার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ১১০ ভূমিহীন পরিবার পেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর এই উপহার। প্রতিটি ঘরের খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে ৪টি, জয়চন্ডীতে ৫টি, রাউৎগাঁওয়ে ১২টি, টিলাগাঁওয়ে ১৫টি, পৃথিমপাশায় ৩২ টি, কর্মধা ৩টি, শরীফপুরে ৩০টি ও হাজিপুরে ৮টি ভূমিহীন পরিবার পেয়েছে এই ঘর। দ্বিতীয় পর্যায়ে উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নে ৩৩টি, জয়চন্ডীতে ১১টি, রাউৎগাঁওয়ে ৪টি, টিলাগাঁওয়ে ১১টি, পৃথিমপাশায় ১০টি, কর্মধা ১০টি, শরীফপুরে ১৬টি, হাজিপুরে ৪টি, বরমচালে ১টি ভূমিহীন পরিবার পাচ্ছে এই ঘর। প্রতি ১০টি ঘরের জন্য দেয়া হবে একটি করে ডিব টিউবওয়েল এবং বিদ্যুতায়নও করা হবে ঘরগুলো।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ শিমুল আলী বলেন, ১ম পর্যায়ের ১১০টি ঘরের নির্মাণ কাজ শেষে ইতোমধ্যে উপকারভোগীদের কাছে তা হস্তান্তর করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের ১০০টি ঘরের মধ্যে ৪২টি ঘরের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। বাকি ঘরের কাজ চলমান রয়েছে।
মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার জিয়াউর রহমান বলেন, আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরগুলোতে দ্রæত বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় নিয়ে আসতি আমরা কাজ করছি। পানীর বিষয়ে উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মুহসিন বলেন, আশ্রয়ন প্রকল্পগুলোতে গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এটিএম ফরহাদ চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার হিসেবে সারাদেশের ন্যায় কুলাউড়ায়ও ১০০ ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ঘরনির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যেক উপকারভোগীদের হাতে ইতিমধ্যে কবুলিয়ত, নামজারি খতিয়ান, গৃহ হস্তান্তরের সনদপত্র প্রদান করা হয়।
বিদ্যুৎ ও নলকূপ প্রসঙ্গে ইউএনও আরোও বলেন, বেশিরভাগ উপকারভোগীদের মধ্যে বিদ্যুৎ ও নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের সাথে আলোচনা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও নলকূপ ব্যবস্থার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।