মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ পূর্বাহ্ন
কুলাউড়া প্রতিনিধি: মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা মোছাদ্দিক আহমদ নোমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তিনি উপজেলা আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক হওয়ায় দলীয় প্রভাবে ইউনিয়ন পরিষদকে রীতিমত অনিয়মে পরিণত করেছেন। ৬৪ বছর ধরে কুলাউড়া পৌর শহরে কার্যক্রম চলা ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন ভবনটি জেলা পরিষদ থেকে নিজের স্বার্থের জন্য লিজ নেন। বর্তমানে ওই ভবনের সামনে ৩টি ফলের দোকান ভাড়া দিয়েছেন তিনি। চেয়ারম্যান নোমান নিজের স্বার্থের জন্য ওই কার্যালয়টি লিজ নিয়ে দৃষ্টতা দেখিয়েছেন। এদিকে স্থানীয় সরকার কিংবা প্রশাসনের কোন অনুমতি এবং ইউনিয়নের নির্বাচিত সদস্যদের সাথে কোন ধরণের সভা কিংবা পরামর্শ ছাড়াই নিজের ক্ষমতাবলে জনতাবাজারে অবস্থিত পরিষদের নতুন ভবনে কার্যক্রম স্থানান্তর করেছেন। এটা নিয়ে সমগ্র ইউনিয়ন জুড়ে তোলপাড় চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৬০ সালে কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে পৌর শহরে থানার সম্মুখে ডিসি খতিয়ানের চার শতক ভূমিতে ইউনিয়নের পরিষদের কার্যক্রম চলে আসছিল। দীর্ঘ ৬৪ বছরে অনেকেই এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু কেউই পরিষদের ভবনটি লিজ নেওয়ার কথা চিন্তাও করেননি। কিন্তু বছর দেড়েক আগে পরিষদের প্রাচীনতম কার্যালয়টি চেয়ারম্যান নোমান মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ থেকে নিজের স্বার্থের জন্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মিসবাহুর রহমানের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় তিনি ওই কার্যালয়টি লিজ নেন।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৮ মে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে টাকা উপার্জনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন চেয়ারম্যান নোমান। এজন্য তিনি ইউনিয়নে তার নিজস্ব কিছু লোক দিয়ে একটি সিন্ডিকেট চক্র গঠন করেন। ওই সিন্ডিকেটের প্রধান ছিল মিনারমহল গ্রামের সুলতান আহমদ নামের এক ব্যক্তি। তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন ভাতা, গভীর নলকূপ বরাদ্দের জন্য টাকা আদায় করা হতো। এছাড়া পরিষদের সকল সদস্যসহ সাধারণ জনগণকে মিষ্টিমুখে কথা বলে মন জয় করে ঠান্ডা মাথায় পরিষদের বিভিন্ন খাত থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। দায়িত্ব নিয়ে কুলাউড়া পৌর শহরে ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন কার্যালয়ে প্রায় আড়াই বছর অফিস করেন। ওইসময় চেয়ারম্যানের কক্ষটি সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের প্রায় ৩-৪ লক্ষ টাকা দিয়ে মেরামত কাজ করেন এমনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসি লাগানো হয়। কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্য সরকারি টাকার অপচয় করে ওই অফিস ছেড়ে দিয়ে ২০০০ সালে জনতাবাজারে নির্মিত পরিষদের নতুন ভবনে অফিস করছেন। এরআগে জনতাবাজারে পরিষদের ভবন মেরামত কাজ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রকল্প হাতে নিয়ে নামমাত্র কাজ করে সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এদিকে দায়িত্বগ্রহণের কিছুদিন পর বিভিন্ন প্রকল্প ও ভাতার উপকারভোগী নির্বাচন নিয়ে পরিষদের সিংহভাগ সদস্যদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয় চেয়ারম্যান নোমানের। চেয়ারম্যান তাঁর নিজস্ব লোক দিয়ে ভাতার উপকারভোগী নির্বাচন করতেন টাকার বিনিময়ে। এমনকি কোন ধরণের স্বমন্বয় ছাড়া নিজের ইচ্ছামতো প্রকল্প হাতে নিয়ে নিজের পছন্দমত লোক দিয়ে সেই কাজ করাতেন। এ নিয়ে মূলত সদস্যদের সাথে দূরত্ব দেখা দেয় চেয়ারম্যানের। পরবর্তীতে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রেনুর হস্তক্ষেপে বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়। তারপরও থেমে যাননি চেয়ারম্যান নোমান। তিনি আওয়ামীলীগের চেয়ারম্যান থাকায় সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের নামমাত্র কাজ করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ওইসময় কোন ইউপি সদস্য তাঁর ভয়ে প্রতিবাদ করেননি।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে অনেক সদস্য চেয়ারম্যানের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে মুখ খুলেছেন। নির্বাচিত হওয়ার ২ বছর ১০ মাসে ইউনিয়ন পরিষদের রাজস্ব আয় থেকে প্রত্যেক ইউপি সদস্যদের মাসিক ৩৬০০ টাকা করে ১ লাখ ২২ হাজার টাকা করে মোট ১৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চেয়ারম্যান নোমান প্রত্যেক সদস্যদের একবার শুধু পাঁচ মাসের সম্মানী ভাতা ২২ হাজার করে দিয়ে বাকি ১২ লাখ টাকা তিনি নিজেই ভোগ করেছেন। তিন অর্থবছরে ইউনিয়ন পরিষদের গৃহকর বাবদ প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা আদায় হয়। ওই টাকা পরিষদের চেয়ারম্যান-সদস্যদের সম্মানী ও উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হওয়ার কথা থাকলেও সিংহভাগ টাকা তিনি একাই ভোগ করেন। জন্ম নিবন্ধন সনদ, নাগরিক সনদ, ট্রেডলাইসেন্স, উত্তরাধিকারী সনদসহ বিভিন্ন সনদ খাতে তিনি কয়েক লক্ষ টাকা নিজের পছন্দ লোক দিয়ে আদায় করে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন ভাতা দেবার জন্য উপকারভোগীদের কাছ থেকে ১০০০-২০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করারও অভিযোগ রয়েছে। ভাতা ও নলকূপের টাকা আদায়ের বিষয়টি দেখাশুনা করতেন চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন মিনারমহল গ্রামের সুলতান আহমদসহ একটি সিন্ডিকেট।
এদিকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে জনতাবাজারে বিজয় মিছিলে মোছাদ্দিক আহমদ নোমান ইউনিয়নের জনগণের উদ্দেশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন, অসহায়-সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ইউনিয়নের সকল জনগণকে নিয়ে দল, মতের উর্দ্ধে উঠে অবহেলিত ইউনিয়নকে একটি মডেল ইউনিয়নে রুপান্তরিত করে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাবেন। তিনি আরো বলেছিলেন, আপনারা সবাই আর কুয়ার পানি খেতে হবেনা। সবাই যার যার কুয়া ভরে ফেলেন। আমি আপনাদের সবাইকে নলকূপ বরাদ্দ দিব। ওইসময় চেয়ারম্যানের এমন বক্তব্য খুশি হয়েছিলেন জনগণ। কিন্তু কে জানতো ওই চেয়ারম্যানই জনগণের কাছ থেকে নলকূপের জন্য মোটা অংকের টাকা আদায় করবেন। সরকারি নলকূপ বরাদ্দ দেয়ার জন্য ইউনিয়নের অনেক মানুষের কাছ থেকে তাঁর মনোনীত মানুষ দিয়ে টাকা আদায় করেন। প্রায় দুইবছর আগে ইউনিয়নের নাজিরের চক গ্রামের বাসিন্দা খলিল মিয়ার ছেলে জাহাঙ্গীর মিয়ার কাছ থেকে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, ফরমুজ মিয়ার স্ত্রী রিনা বেগমের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, মিনারমহল গ্রামের রানা মিয়ার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, শ্রীপুর গ্রামের মাহমুদ আলীর ছেলে মাছির মিয়ার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিলেও তারা এখন পর্যন্ত নলকূপ পাননি বলে এই প্রতিবেদককে জানান।
অভিযোগের বিষয়ে কুলাউড়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোছাদ্দিক আহমদ নোমান বলেন, আমি কোন অনিয়ম দুর্নীতি করিনি। দল, মতের উর্দ্ধে উঠে জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছি। পরিষদের সদস্যদের সম্মানী ভাতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গৃহকরের টাকা আদায় করে সদস্যদের একবার পাঁচ মাসের সম্মানী দিয়েছিলাম ঠিক কিন্তু টাকা হাতে না থাকায় বাকি টাকা দিতে পারিনি। নলকূপের টাকা আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত নির্বাচনের সময় আমার প্রতিপক্ষের করা একটি মামলা পরিচালনায় অনেক টাকা খরচ হয়েছিল। ওইসময় আমার নিজস্ব কিছু শুভাকাঙ্খী আমাকে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করে। পরে তারা বলে ওই টাকার বিনিময়ে তাদের কিছু নলকূপ দিতে হবে। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে আমার গাড়িটি বিক্রি করে নলকূপ ও ভাতা বাবদ টাকা জনগণকে ফেরত দিয়েছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ লিজ নেয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিলনা। কিভাবে লিজ দেয়া হলো সেটি খতিয়ে দেখা হবে। আর মেম্বারদের সম্মানী ভাতার বিষয়ে উনারা লিখিত অভিযোগ দিলে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।