মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৩ পূর্বাহ্ন
মাহফুজ শাকিল :: রুহেনা আক্তার লুবনা (২২)। ২০১২ সাল থেকে একজন মানসিক রোগী। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রও আছে। কিন্তু কেউ সেটা তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেয়নি। পুলিশ তাকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করেছে। তার আগে স্থানীয় লোকজন সেই পাগলীর উপর চালিয়েছে অমানবিক নির্যাতন। অপবাদ দেয়া হয় মূর্তি ভাঙচুরের চেষ্টা ও হামলার। গত ৮ দিন থেকে সেই নির্যাতন আর অপবাদের ক্ষত নিয়ে নিয়ে মৌলভীবাজার জেলহাজতের প্রকোষ্টে কাটছে পাগলী লুবনার অনিশ্চিত দিনকাল। এমন অমানবিক ঘটনাটি ঘটেছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নে।
দূর্গাপূজার নবমীর রাত অর্থাৎ গত ১২ অক্টোবর শনিবার রাতে উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের কামারকান্দি গ্রামের লেবু মিয়া ও বাচ্চু মিয়ার ভাগনী মানসিক রোগী লুবনার স্বামী আল আমীনের সাথে শুয়েছিলেন ঘরে। কিন্তু স্ত্রী লুবনা কখন উঠে ঘরের বাইরে গেছে সেটি তিনি টেরও পাননি। অনেক খোজাঁখুজির পর পরিবারের লোকজন রাতে তাকে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। এদিকে রাত আনুমানিক দেড়টায় গ্রামের পার্শ্ববর্তী বিজয়া বাজারে পাহারাদার সুরুজ মিয়া ও সিরাজ মিয়া সুন্দরী মহিলা দেখতে পান। পাহারাদার সুরুজ মিয়া তাকে বাড়ি ঘরের কথা জিজ্ঞাসা করলে কোন উত্তর দেয়নি। এদিকে কিছু খারাপ প্রকৃতির ছেলেরাও তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করার কারণে মেয়েটির নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে টহল পুলিশের দ্বারস্থ হন দুই পাহারাদার। টহল পুলিশের দায়িত্বরত কুলাউড়া থানার এএসআই মো. নুরু মিয়া ও সঙ্গীয় ফোর্স পুলিশ লুবনাকে বিজয়া বাজারের পার্শ্ববর্তী দূর্গাপূজা মন্ডপে দায়িত্বরত মহিলা আনসারের কাছে নিয়ে রাখেন। মহিলারা থাকতেন পুজামন্ডপের পাশে বাগানের স্কুল ঘরে।
বিজয়া চা বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি কিরণ শুক্ল বৈদ্য জানান, ওই মেয়েটাকে আনসারের কাছে রাখার পর রাত আড়াইটায় পুজামন্ডপ বন্ধ করা হয়। পরদিন অর্থাৎ রোববার সকালে তিনি শুনতে পান, মেয়েটি পুজামন্ডপে ঢুকার চেষ্ঠা করেছে। এসময় একটি শিশুকে আছাড় মেরে আহত করেছে এবং ঠাকুর সুমনকে মারপিট করেছে। এদিকে বাগানের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং পুলিশ ও চেয়ারম্যান মেম্বারকে অবহিত করেন। এসময় শ্রমিকরা কিছু মারপিট করেছে।
স্থানীয় লোকজন জানান, সকালে বাগানের শিশু কিশোররা তাকে পাগলী বলে উত্যক্ত করলে লুবনা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। এসময় তার উপর চালানো হয় শারিরীক নির্যাতন। মুর্তি ভাঙ্গার অপবাদ দিয়ে ইসকন মন্দিরের সুমন এবং নয়নের নেতৃত্বে লুবনাকে বেধড়ক মারপিট করা হয়। এসময় হুলস্থুল কান্ডে এক শিশু আহত হয়। পরিস্থিতি যখন থমথমে তখন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন, ওসি মো. গোলাপ আপছার, সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি শান্ত করেন।
মেয়ের মামা বাচ্চু মিয়া ও লেবু মিয়া জানান, ২০১২ সাল থেকে সে মানসিক রোগী। তারা ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও মানসিক রোগী হিসেবে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাগানের লোকজন উল্টো তাদের উপর আক্রমণ করার চেষ্টা করে। অসহায় হয়ে তারা ফিরে আসেন। আইনজীবি নিয়ে আদালতে জামিন চেয়েছিলেন কিন্তু পাননি। শারিরীক নির্যাতনের কারণে মেয়েটি আরও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। জেলহাজতে দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু লুবনা কাউকে চিনতে পারেনি। শরীরের ক্ষত নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
তারা আরও জানান, লুবনা তাদের ভাগনি। তার বাবার বাড়ি পার্শ্ববর্তী জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নে। বাবা আকদ্দছ আলী ও মা রিনা বেগম। লুবনার স্বামীর বাড়ী রংপুর জেলার গঙ্গছড়া থানার বৈরাতী গ্রামের। গত ০৬ অক্টোবর স্বামী আল আমীনসহ সে নানাবাড়ী জয়চন্ডীতে বেড়াতে আসে।
পুজামন্ডপে হামলার খবর পেয়ে কুলাউড়ার সহকারী কমিশনার (ভুমি) মো. জহুরুল হোসেন, সেনাবাহিনী এবং পুলিশের উপস্থিতিতে যখন লুবনাকে হস্তান্তর করা হয় তখন নয়ন এবং সুমন ঘটনাটি মন্দিরে হামলার কথা বলে ঘটনাটি লাইভ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো। কুলাউড়া থানায় লুবনাকে নিয়ে আসার পর বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি কিরন শুক্ল বৈদ্য বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলায় লুবনার বিরুদ্ধে শিশুর উপর হামলা ও ৫০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগ করা হয়।
জয়চন্ডী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রব মাহাবুব জানান, মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে তার মামারা জানিয়েছেন এবং চিকিৎসার কাগজপত্রও দেখিয়েছেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তাকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে।
কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. গোলাম আপছার জানান, এ ঘটনায় একটা মামলা হয়েছে। মেয়েটিতো আদালত থেকে জামিন পাওয়ার কথা। এ ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার দায়ে এএসআই মো. নুরু মিয়াকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে।