শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:০৫ অপরাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : ২০২২ সালে পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালার হত্যার পর থেকে বলকরণ ব্রার ওরফে লরেন্স বিষ্ণোই আরও কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। সংশোধিত হওয়ার পরিবর্তে কারাগারে থেকেই শক্তিশালী গ্যাং গড়ে তুলেছেন লরেন্স বিষ্ণোই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন করেন সদস্য। আবার বলিউড তারকা সালমান খানকে হুমকি দিয়ে নীতিবান মানুষ হিসেবে প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। ভারত-নেপাল সীমান্তে উত্তর প্রদেশের বাহরাইচ জেলায় মুম্বাইয়ের আলোচিত রাজনীতিবিদ বাবা সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এছাড়া আরও অর্ধ ডজনের বেশি যুবককে আটক করা হয়েছে।
বাবা সিদ্দিকী ছিলেন তিনবারের রাজ্য বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী। তিনি বলিউড তারকা সালমান খানেরও ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে ভারতের কুখ্যাত লরেন্স বিষ্ণোইর গ্যাং। সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্যাংয়ের এক সহযোগী পোস্টে লিখেছিলেন, “আমাদের কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই, তবে যারা সালমান খানকে সাহায্য করে, তাদের সতর্ক থাকা উচিত।” পুলিশ জানিয়েছে, সন্দেহভাজন হত্যাকারীরা মুম্বাইয়ের এক স্ক্র্যাপ ডিলারের দোকানে কাজ করত। এরা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের সদস্য। পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্সের দাবি, বিষ্ণোই গ্যাং হত্যাকারীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে পরিকল্পিতভাবে তাদের বেছে নিয়েছে।
ভারতে গ্যাংস্টার সংস্কৃতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে ২০২২ সালে পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালার হত্যার পর থেকে এটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। সেই হত্যার দায়ও বিষ্ণোই গ্যাং স্বীকার করে নেয়। এরপর থেকে বলকরণ ব্রার ওরফে লরেন্স বিষ্ণোই আরও কুখ্যাত হয়ে ওঠেন।
গুঞ্জন রয়েছে, স্কুলজীবনে খালার পরামর্শে বিষ্ণোই ‘লরেন্স’ নামটি গ্রহণ করেন। তার খালার বিশ্বাস ছিল, উজ্জ্বল গায়ের রঙের কারণে এই নামটি তার জন্য মানানসই। গ্যাংয়ের এই নেতাকে ঘিরে মিশ্র জনমতও রয়েছে।
কেউ তাঁকে আধুনিক যুগের বিপ্লবী মনে করেন, আবার কেউ তাঁকে সাধারণ অপরাধী হিসেবে গণ্য করেন। কেউ কেউ সালমান খানকে হুমকি দেওয়ার জন্য তাঁকে নীতিবান মানুষ হিসেবে প্রশংসা করেন; আবার অনেকেই তাঁকে ভগত সিংয়ের মতো মনে করেন, ভাবেন তিনি খালিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়ছেন।
উত্তর ভারতে লরেন্সের আগের একসময় আতিক আহমেদ ও মুখতার আনসারির মতো মাফিয়া নেতারা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তারা রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তবে ২০২৩ সালে উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে পুলিশের হেফাজতে আতিক আহমেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সাবেক ইউপি পুলিশ প্রধান বিক্রম সিং মনে করেন, ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে অপরাধী নিয়োগের ধরণ পাল্টে গেছে। আগে নবাগত অপরাধীরা মাফিয়াদের অধীনে ছোটখাটো কাজ দিয়ে শুরু করত। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়া পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের বাছাই করা হয়।
বিক্রম সিং বলেন, “আগে অপরাধীরা নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর জন্য মাফিয়াদের কাছে যেত। শুরুতে তারা মাফিয়া নেতাদের বিভিন্ন কাজ করে দিতো পরে দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করত। ছোটখাটো অপরাধ করার মাধ্যমে দক্ষতা প্রমাণ করেই তারা বড় কাজ পেত।”
কিন্তু এখন অপরাধীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারিতে রাখা হয় বলে জানান ব্রিকম সিং। তিনি বলেন, “তরুণদের মধ্যে যারা অপরাধপ্রবণ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এবং কী ধরনের অপরাধ করতে পারে তা যাচাই করা হয়। যেমন স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ী যারা বাবা সিদ্দিকীকে হত্যা করেছে, তারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপরাধী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে ভিডিও আপলোড করেছিল।”
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধান তদন্ত সংস্থা একজন খালিস্তানপন্থী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারকে মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত করে। কিন্তু এ ঘোষণার একদিন পরই ওই নেতাকে কানাডার উইনিপেগ শহরে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিষ্ণোই গ্যাং এ হত্যার দায় স্বীকার করে বলেছে, ওই ব্যক্তি মাদকাসক্ত ছিলেন এবং নিজের অপরাধের শাস্তি পেয়েছেন।
পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সিঙ্গাপুরে কানাডার এক কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে গোপন বৈঠকও করেন। সেখানে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের ভূমিকা নিয়ে তারা আলোচনা করেন বলে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
নিজ্জার ২০২৩ সালের ১৮ জুন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সারে শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তাকে নিষিদ্ধ খালিস্তানপন্থী দল সিকস ফর জাস্টিসের নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুনের সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে দিল্লি এসব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং প্রমাণের অভাবে কানাডাকে দোষারোপ করেছে।
১৯৯৩ সালে রাজস্থানে জন্মগ্রহণ করেন লরেন্স বিষ্ণোই। প্রকৃতি ও প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবেও আছেন লরেন্স।
১৯৯৮ সালে রাজস্থানে একটি চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় সালমান খান দুটি কৃষ্ণ হরিণ হত্যা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই ঘটনার জেরে সালামন খানের সঙ্গে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের শত্রুতা রয়েছে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে বিষ্ণোই গ্যাংয়ের দুই সদস্য সালমান খানের বাড়ি উদ্দেশ্য করে গুলি চালালে নতুন করে এ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে ওই দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ভারতের পুলিশের একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান লরেন্সের সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি তাকে ‘প্রকৃতির বিদ্রোহী’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি জানান, সংশোধিত হওয়ার বদলে লরেন্স তার পরামর্শদাতা রকি ফজিলকারের সহায়তায় সারা দেশে শত শত শ্যুটার নিয়ে শক্তিশালী একটি গ্যাং তৈরি করেছেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তিনি বিশ্বাস করেন, লরেন্স গোপনে রাজনৈতিক আশ্রয় পাচ্ছেন এবং এর মাধ্যমেই তিনি তার নেটওয়ার্ক এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়াচ্ছেন।
কর্তৃপক্ষও দাবি করেন যে লরেন্স কারাগারে থেকেই দিন দিন নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছেন। তারা এসব বিষয়ে খতিয়ে দেখতে তদন্তেরও দাবি জানান।
ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) বলছে, লরেন্সের ৭০০ সদস্যের একটি অপরাধ চক্র রয়েছে।
সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য সংগ্রহের অন্যতম মাধ্যম হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গ্যাংয়ের সদস্য, এক আসামির স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে, গ্যাং সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করত, যা দেখে আগ্রহীরা যোগাযোগ করত। এরপর তাদের যাচাই করে নির্বাচিত করা হতো।
ওই আসামি বলেন, “গ্যাং নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে। পোস্টগুলো দেখে আগ্রহী ব্যক্তিরা যোগদানের জন্য যোগাযোগ করত। এরপরে, প্রাপ্ত অনুরোধগুলো যাচাই করে প্রয়োজন অনুযায়ী সদস্য নির্বাচন করা হতো।”
তরুণদের মধ্যে গ্যাংস্টার সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ অপরাধ সম্পর্কিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষ অভিযান শুরু করেছে।
লখনউয়ের কিং জর্জ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ড. কৃষ্ণ দত্ত মনে করেন, তরুণদের অপরাধের দিকে ধাবিত হওয়ার পেছনে সিনেমা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্ল্যামারাইজেশনের বড় ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, “৯০-এর দশকে ‘খলনায়ক’ সিনেমার পর অনেক তরুণ লম্বা চুল রেখে স্থানীয় অপরাধে জড়িয়েছিল। এখন প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এই ধরনের আধিপত্য দেখানো এবং মাচো মনোভাব প্রকাশ সহজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখানো সম্ভব।”
ড. কৃষ্ণ দত্ত আরও বলেন, “অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল যুবকরা যখন কারাগারে থাকা কোনো অপরাধীকে বিপুল সংখ্যক অনুগামী নিয়ে আন্তর্জাতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখে, তখন তা একটি বিপজ্জনক আকাঙ্ক্ষার মডেলে পরিণত হয়। এতে শুধু অপরাধ নয়, পুরো একটি ডিজিটাল বাস্তুতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে, যা স্থানীয় অপরাধীদের নায়ক বানিয়ে তুলছে এবং ঐতিহ্যবাহী আইন প্রয়োগের পদ্ধতিকে প্রায় অকার্যকর করে তুলেছে।”
মহারাষ্ট্রের পুনে পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল বিপিন মিশ্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, অপরাধী প্রবণতা রোধে ১২ বছরের নিচে শিশুদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকারকে বিবেচনা করা উচিত।
ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সংগঠিত অপরাধের সংযোগ একটি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। পুনে পুলিশের পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি এই সংস্কৃতির বিস্তার ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।