1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
  • E-paper
  • English Version
  • শনিবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:২০ পূর্বাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

বাংলাদেশে বিলুপ্ত সংবাদপত্রসমূহের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
  • ৬৩ বার পঠিত

: শাহ্ শেখ মজলিশ ফুয়াদ:
বাংলাদেশে বিলুপ্ত সংবাদপত্রের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত আলোচনায় বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস প্রাসঙ্গিক। এ অঞ্চলে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাস দুইশ’ বছরেরও বেশি পুরনো। সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশের যুগে এটি ছিল এক ধরনের সমাজকর্ম। আর সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার উৎকর্ষ, বিকাশের জন্য অপরিহার্য যে মুদ্রণ প্রযুক্তি, তা এ উপমহাদেশে প্রথম চালু করেছিলেন পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকরা।
তারা পর্তুগালের লিসবন থেকে রোমান হরফে বাংলা বই ছাপিয়ে এনেছিলেন। ফলে পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকদের কাছে এ দেশের মানুষ ঋণী। কেননা মুদ্রণপ্রযুক্তির বিকাশ ও অগ্রগতির পথ ধরেই এ দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটেছে। এর সঙ্গে নাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেড, পঞ্চানন কর্মকার, উইলিয়াম ক্যারি প্রমুখ মনিষীদের নামও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়।

গণমাধ্যমের ভাষা:
ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষক শ্রেণি এবং তাদের তল্পিবাহকদের মুখোশ উন্মোচনে সমগ্র বাংলা তথা ভারতবর্ষে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ ও লেখালেখির কারণে ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি নামের ভবঘুরে এক ইংরেজকে তৎকালীন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কোপানলে পড়ে ভারত ছাড়তে হয়েছিল। সেই থেকে শুরু এদেশের মুদ্রিত সংবাদপত্রের পথচলা।

এরপর থেকে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারত, ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি আমল- এ দীর্ঘ সময়ে এখানকার রাজনীতি, সাংবাদিকতা, সাহিত্য জগতে যাঁরাই অগ্রপথিকের ভ‚মিকা পালন করেছেন, তাদের সবাই যে জনস্বার্থ তথা দেশ ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন, একথা সর্বজনস্বীকৃত; যদিও অনেক সময় নেতাদের চলার পথ ছিল ভিন্ন। এই দীর্ঘ সময়ে প্রথমে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ও তারপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের সমর্থক বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্যোগে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের সংবাদপত্র প্রকাশিতও বিলুপ্ত হয়েছে।

এ দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা যাঁদের হাত ধরে উন্মেষিত ও বিকশিত হয়েছিল, তাঁরা হলেন- গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, রাজা রামমোহন রায়, জন ক্লার্ক মার্শম্যান, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, হরিশচন্দ্র মুখার্জী, কাঙাল হরিনাথ মজুমদার, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র ঘোষ, বিপীন চন্দ্র পাল, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, কমরেড মুজাফ্ফর আহ্মদ, কাজী নজরুল ইসলাম, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রমুখ।

এ সকল মনিষীদের কেউ ছিলেন শিক্ষক, মিশনারি, কেউ কবি বা সাধক, আবার কেউ বা একাধারে ছিলেন বিপ্লবী, বড় মাপের রাজনীতিক, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। পরাধীন দেশ এবং দেশের মানুষের মুক্তি আর অপশক্তির মুখোশ উন্মোচন করে জনগণের রাজত্ব কায়েম করা, সে লক্ষ্যে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে জনমত তৈরি করাই ছিল তাঁদের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবনের ব্রত। ১৯২২ সালে সাংবাদিক-কবি কাজী নজরুল ইসলামের পত্রিকা ‘ধুমকেতু’তেই সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপতি হয়েছিল।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে পূর্ববাংলার (যা আজকের বাংলাদেশ) মানুষের ওপর চেপে বসা ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ, বঞ্চনা, ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে সচেতন করার দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন এদেশের একদল মনিষী রাজনীতি ও সাংবাদিকতাকে পুঁজি করেই। এঁদের নিবিড় সম্পর্ক থাকার কারণেই সংবাদপত্র-সাংবাদিকতার জগৎটি অর্জন করেছিল সম্মোহনী শক্তি।

এ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, খায়রুল কবীর, রণেশ দাসগুপ্ত, জহুর হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ নূর উদ্দিন, আব্দুস সালাম, মাহবুবুল হক, সিকান্দার আবু জাফর, সন্তোষ গুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের নাম বাঙালির মানসপটে চিরভাস্বর হয়ে আছে।

আজকের বাংলাদেশে ‘জননী সাহসিকা’র মর্যাদায় আসীন কবি বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মালিকানা এবং পরিচালনায় কবি নজরুল ইসলাম বের করেছিলেন কলকাতার প্রথম সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’।

স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ও সংগ্রামীজীবনের চালিকাশক্তিই ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র দৈনিক ইত্তেফাক এবং এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। পত্রিকাটি প্রথম সাপ্তাহিক হিসেবে বের করেছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তানি আমলে দৈনিক ইত্তেফাকই বাঙালির স্বাধিকারের চেতনাকে জনগণের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিল সফলভাবে।

১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে এদেশের প্রগতিশীল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাও অনস্বীকার্য। ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী আমলে সাড়া-জাগানো ‘সমকাল’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক এবং সমকাল প্রকাশনীর কর্ণধার সিকান্দার আবু জাফর কর্তৃক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই, আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ গানটিতেই প্রথম বলা হয়েছিল, ‘প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত’।

আর পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জয় বাংলা এবং বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে যেভাবে প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছিল, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ওইসব সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক-সাংবাদিকদের সবাই ছিলেন দেশ, জনগণ ও তাদের নিজেদের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ আর সে কারণে আজও তাঁদের স্মরণ করা হয় শ্রদ্ধাভরে।

সাংবাদিকতা-সাহিত্য ও রাজনীতির জগতের সে সব মনীষীদের আজীবন সংগ্রাম ও সাধনার ফসল হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা যে এক সম্মোহনী ও আকর্ষণীয় শক্তির অধিকারী হয়ে উঠেছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজ একদিকে তার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, অপরদিকে সেই সংবাদপত্রগুলোর অধিকাংশ বিলুপ্তও হয়ে গেছে।

আদর্শিক পথের যাত্রীদেরই হোক, আর স্বার্থান্বেষী গ্রæপেরই হোক তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত অসংখ্য সংবাদপত্র-পত্রিকা-সাময়িকীর ক্ষেত্রে এই বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। সময়ের পরিবর্তন, বিবর্তন ও রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় বিলুপ্ত এ সব পত্র-পত্রিকার কোনো কোনো নাম ব্যবহার করে পরবর্তীকালে তা শুধু নাম হিসেবে টিকে থাকলেও, এসবের বৈশিষ্ট্যগত অবস্থান একেবারেই ভিন্ন এবং তা স্বাভাবিকও বটে।

কারণ সংবাপদপত্র সমাজের দর্পণ-একথাটি যেমনই সত্য তেমনই সত্য হচ্ছে, পরিবর্তিত, বিবর্তিত ও রূপান্তরিত পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র প্রকাশনা এবং এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মালিকানা-ব্যবস্থাপনার ধরনও ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। আর সে কারণেই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিলুপ্ত সংবাদপত্র নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে আলোচনার জন্য সংবাদপত্র প্রকাশিত হওয়ার সময়কে কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে-১. ব্রিটিশ আমল, ২. পাকিস্তান আমল ও ৩. বাংলাদেশ আমল-ক. ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯০’এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় এবং গ. ১৯৯০’এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর থেকে বতর্মান সময় পর্যন্ত প্রকাশিত ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সংবাদপত্রগুলোর খতিয়ান।

ব্রিটিশ আমলে প্রকাশিত ও বিলুপ্ত সংবাদপত্রসমূহ:
ব্রিটিশ আমলে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত ও বিলুপ্ত সংবাদপত্রসমূহের তালিকাটি দীর্ঘ; কিন্তু আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রভাব বিস্তারকারী যেসব বিলুপ্ত সংবাদপত্র আজও স্মরণযোগ্য সেগুলো হচ্ছে-১৮৪৭ সালে রংপুর থেকে প্রকাশিত ‘রঙ্গপুর বার্তাবহ’, ঢাকা থেকে ‘ঢাকা প্রকাশ’, ১৮৬২ সালে ‘চিত্তরঞ্জিকা’, ১৮৬৩ সালে ‘ঢাকা দর্পণ’, কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে ১৮৬৩ সালে ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ১৮৬৫ সালে ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক ‘বীণাপানি’, ‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’, ১৮৬৮ সালে যশোহর থেকে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ১৮৭০ সালে ‘বঙ্গবন্ধু’, ১৮৭৪ সালে মানিকগঞ্জের পারিল গ্রাম থেকে ‘পাক্ষিক বার্তাবহ’ ১৮৯০ সালে কুষ্টিয়া থেকে ‘পাক্ষিক হিতকরী’, ১৯০৬ সালে ঢাকা থেকে মহিলাদের জন্য প্রথম পত্রিকা ‘ভারত মহিলা’, ১৯১১ সালে ‘কৃষি সম্পদ’, ১৯১২ সালে ‘প্রতিভা’ ও ‘ঢাকা রিভিউ অ্যান্ড সম্মেলন’, ১৯৩১-৩২ সালে সাপ্তাহিক ‘সোনার বাংলা’ ও ‘জয়শ্রী’। ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রকাশিত সবক’টি পত্রিকার মধ্যে একমাত্র ‘ঢাকা প্রকাশ’- এর ধারাবাহিকতা ছিল। (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের সংবাপদপত্র, ১৭৮০-১৯৪৭, প্রকাশক;বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, প্রকাশ সাল- ২০০৩, পৃষ্ঠা:৪০-৪৭)।

১৯১৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘সওগাত’ বাংলায় মুসলিম সাংবাদিকতায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিল বলা চলে এই কারণে যে, পত্রিকাটি কিছু দিন বিরতি দিয়ে পাকিস্তান আমলেও এর প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের চাঁদপুরের সন্তান মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ‘সওগাত’ সম্পাদক হিসেবে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।

এ সময়ে কুমিল্লা শহর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র হচ্ছে- ‘ত্রিপুরা বার্ত্তাবহ’ (১৮৭৯), ‘প্রতিনিধি’ (১৯০৩), ‘চুন্টা প্রকাশ’ (১৯২৬), ‘প্রজাবন্ধু’ ও ‘পল্লীপ্রদীপ’ (১৯২০) ‘ত্রিপুরা হিতৈষী’ (১৮৯৬), (রজতনাথ নন্দী, মামুন সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা: ১৪-১৭)।

ব্রিটিশ আমলে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে একমাত্র দৈনিক পত্রিকাটির নাম ‘জ্যোতি’। এটি ১৯১৬ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হলেও, স্বল্পায়ু হয়েছিল। তাই নামও বিলুপ্ত। ওই সময় অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতাই ছিল সংবাদপত্র প্রকাশনার কেন্দ্রস্থল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০-এর দশকের শুরুতে নতুন প্রেক্ষাপটে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলামের মতো মনীষীরা কলকাতা থেকে প্রকাশ করেছিলেন ‘নবযুগ’, ‘ধুমকেতু, ‘লাঙ্গল’, ‘স্বরাজ’।

এ সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিক-কলামিস্ট সোহরাব হোসেন লিখেছেন, এ পত্রিকাগুলো সাম্প্রদায়িকে স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নিলেও, বৃহত্তর সমাজকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হলে এই বিভক্তি আরও প্রকট হয়ে উঠে। কলিকাতা’র বনেদী পত্রিকাগুলোর একপেশে নীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজকে আশাহত করে।

১৯৩৬ সালে মওলানা আকরম খাঁর সম্পাদনায় ‘বাংলা ও আসামের মুসলমানদের মুখপত্র’ হিসেবে বের হয় ‘দৈনিক আজাদ’। পত্রিকাটি ছিল গোঁড়াপন্থি ও পাকিস্তান আন্দোলনের উগ্র সমর্থক। ‘আজাদ’ গোষ্ঠী পাকিস্তানের বিনিময়ে বাঙালিত্ব বর্জনেরও পক্ষপাতী ছিল। অপরদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠিত ‘ইত্তেহাদ’ পাকিস্তান ও বাঙালি সত্তার মধ্যে একটা আপোষ রফার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ‘ইত্তেহাদ’ পাকিস্তানের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাগের বিরোধী ছিল।

ফজলুল হকের ‘নবযুগ’ (১৯৪০) প্রথম দিকে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। পরবর্তী সময়ে তিনি জিন্নাহর সঙ্গে আপস করে ফের মুসলিম লীগে ফিরে আসেন, তার আগেই অবশ্য ‘নবযুগ’ বন্ধ হয়ে যায়। …পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস আগে ‘পূব পাকিস্তান’ নামে একটি দৈনিক প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। প্রকাশের তারিখ ২৩ মে ১৯৪৭। (তথ্য সূত্র : সেমিনার, পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সংবাদপত্র, মূল প্রবন্ধ, ১০ মে, ২০০০, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, পৃষ্ঠা : ২-৩)

পাকিস্তান আমল :
এ সম্পর্কে সোহরাব হোসেন লিখেছেন, ‘একই বছর (১৯৪৭) আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে যথাক্রমে প্রকাশ পায় ‘দৈনিক পয়গাম’ ও ‘জিন্দেগী’। এ সময় ঢাকা ও অন্যান্য শহর থেকে যেসব সাপ্তাহিক, অর্ধসাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকা বের হতো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ‘নবনূর’, ‘কাফেলা’, ‘খাদেম’, ‘ইনসাফ’, ‘যুগের দাবি’, ‘জনমত’, ‘বেগম’, ‘ফরিয়াদ’, ‘নওরোজ’।
এসব পত্রিকা নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতি যত অনুরক্ত ছিল, পেশাদারিত্বের প্রতি তত মনোযোগী ছিল না। ফলে বেশির ভাগ পত্রিকাই হয়েছে স্বল্পায়ু। যেগুলোবা টিকেছিল সেগুলোও পাঠক সমাজে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা: ৩)।

উল্লেখ্য, ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন প্রতিষ্ঠিত ‘বেগম’ বাংলা ভাষায় প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক। সাহিত্য ক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পত্রিকাটি ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি ১৯৫০ সালে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম দীর্ঘ দিন পত্রিকাটি সম্পাদনা করে এদেশের নারী জাগরণে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করেন।

২০১৬ সালে তার ইন্তেকালের পর পত্রিকাটি বিলুপ্ত না হলেও বর্তমান বাস্তবতায় নারী পাঠক সমাজে এর আবেদন আগের মতো নেই। এর বড় কারণ, বর্তমান অধিকাংশ সংবাদপত্রই আলাদাভাবে নিজস্ব নারী পাতা/মহিলা পাতা বের করছে। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রথম দৈনিক ‘আজাদ’ ঢাকা থেকে বের হয় ১৯৪৮ সালের ১৯ অক্টোবর। পত্রিকাটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার বিকাশে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছে। এটি টিকেছিল ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। অপরদিকে ঢাকা থেকে প্রথম দৈনিক, ইংরেজি দৈনিক ‘অবজারভার’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালের ৯ মার্চ। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের তৎকালীন আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দীনতার একটি চিত্র এখানে খুঁজে পাওয়া যায়।

ঘটনাটি এরকম- প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ওই সময় একটি বাংলা দৈনিকই বের করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু বাংলা টাইপের সংকটের কারণে তিনি ইংরেজি কাগজ বের করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সম্পর্কে ‘অবজারভার’ এর প্রথম সম্পাদক শেহাবউল্লাহর ভাষ্য হলো: ‘When we were almost sure that Bengali daily ‘Al Helal’ will be published soon, we found that the import of Bengali types from Calcutta was banned by the Pakistan Government after the Azad Press got their supply from Calcutta. The Azad treated ‘Al Helal ‘as their potential rival.Whenwe found that it was impossible to get Bengali types for the Daily ‘Al Helal’ from Calcutta, we changed our strategy and decided to bring out an English daily instead’. পত্রিকার ইংরেজি টাইপ আনা হয়েছিল লাহোর থেকে বিমানযোগে। পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৫)। এই ‘পাকিস্তান অবজারভার’ বাংলাদেশ আমলে ‘দ্য বাংলাদেশ অবজারভার’ নামে দেশের ইংরেজি সাংবাদিকতার বিকাশে পথিকৃতের ভ‚মিকা পালন করলেও, মালিকানার দ্বন্দ্বের পরিণতিতে বর্তমানে বিলুপ্ত পত্রিকাটি। এর সর্বশেষ সম্পাদক, সাংবাদিক- নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর মালিকানায় ‘দ্য ডেইলি অবজারভার’ নামে বর্তমানে একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশিত হলেও, হামিদুল হক চৌধুরীর আল হেলাল প্রেসের বিখ্যাত ‘অবজারভার’- এর প্রভাব-পরিসর, আর্থিক প্রতিপত্তি ও জনপ্রিয়তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। এই আল হেলাল প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ ও সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ ও এখন সাংবাদিকতার গবেষণা ও ইতিহাসের অংশ।

অন্যান্য পত্রিকা :
গবেষক শামসুল হকের ভাষ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান আমলে পাঁচশ’র মতো পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি দৈনিক, ১২৮টি সাপ্তাহিক, ৫৭টি পাক্ষিক, ২০১টি মাসিক, ১৭টি মহিলাবিষয়ক, ৩৩টি কিশোরবিষয়ক, ২৭টি ত্রৈমাসিক। এ পত্রিকাগুলোকে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগে ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে নবীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা, অন্যভাগে ছিল রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে অস্বীকার না করেও বাঙালির আত্মানুসন্ধান তথা তার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো। আজাদ, পয়গাম, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থি পত্রিকা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের বিরোধিতা করেছে।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ প্রতিষ্ঠিত ‘নওবেলাল’ চিন্তাভাবনায় পাকিস্তানপন্থি হলেও, বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। যেমন- করেছে ইনসাফ, কাফেলা, ফরিয়াদ, নবনূর, জিহাদ, ইত্তেহাদ, জনতা, মিল্লাত। এদের মধ্যে পঞ্চাশের দশকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা ছিল ‘ইত্তেহাদ’ ও ‘মিল্লাত’। ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি সময় মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সম্পাদনায় ‘দৈনিক মিল্লাত’ প্রকাশিত হয়।

এ পত্রিকাটি কয়েক বছর টিকেছিল। অনুরূপ ভাগ্য বরণ করে ১৯৫৪ সালে দৈনিক ইত্তেহাদ-ও। সে সময়কার সংবাদপত্র ও সাময়িকীর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গবেষক ইসরাইল খান তাঁর ‘পূর্ববাংলার সাময়িকপত্রে’ লিখেছেন, ‘বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন বা রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম মুক্তিকামী জনসমাজকে উদ্দীপিত করেছিল।

ফলে ১৯৫৩ সনের ফেব্রুয়ারি থেকে একুশের সংকলনও শহীদ দিবস সংখ্যা প্রকাশের ঐতিহ্য যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনি ১৪ আগস্ট ‘স্বাধীনতা দিবস’ (১৪ আগস্ট), বিপ্লব দিবস ও ঈদ সংখ্যা প্রকাশের মধ্য দিয়েও পাকিস্তানপন্থির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক চেতনা সঞ্চারের চেষ্টা করেছেন নানা পত্রিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাপিয়ে উঠেছে একুশের ধারাই এবং পরবর্তীকালে তা আমাদের স্বাধীকার তথা স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে’ (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১২)।

দৈনিক ‘ইত্তেহাদ’ ও ‘মিল্লাত’ অবশ্য প্রথমে পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান এগুলোর প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

ষাটের দশকের শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ, প্রতিবাদ যখন দানা বাঁধতে থাকে, তখন ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর পাকিস্তান সরকারের ট্রাস্টের পত্রিকা হিসেবে বের হয় বাংলা ‘দৈনিক পাকিস্তান’ ও ইংরেজি দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’। দেশের প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেক প্রতিভাবান সাংবাদিক, কবি সরকারি মালিকানাধীন বিশেষ করে বাংলা ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ যোগ দেন এবং পত্রিকাটি জনপ্রিয়তাও লাভ করে।

দৈনিক পাকিস্তান স্বাধীনতার পর ‘দৈনিক বাংলা’ নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং দীর্ঘদিন সরকারি ট্রাস্টের পত্রিকা হিসেবে টিকে থেকে বিগত নব্বই দশকের শেষ দিকে ট্রাস্টের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে এটিরও বিলুপ্তি ঘটে। ষাটের দশকের প্রকাশিত আরও যেসব পত্রিকা সময়ের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘আওয়াজ’, ‘জনমত’, ‘জনতা’, ‘গণদাবি’, ‘নতুন দেশ’, ‘পূর্বাঞ্চল’, ‘অধিকার’, ‘নয়াজামানা’, ‘গণদাবি’ প্রভৃতি।

ষাটের দশকে বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের পক্ষে কথা বলার জন্য অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির পক্ষে কোনো ইংরেজি দৈনিক ছিল না। সেই অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রতিভাবান ও প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক ও শিল্পোদ্যোক্তা আবিদুর রহমান বের করেন ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য পিপল’। আবিদুর রহমান ওই সময় ‘নয়া বাংলা’ নামে একটি বাংলা দৈনিকও বের করতেন।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের সংবাদ পরদিন ‘দ্য পিপল’ই সবচেয়ে সাহসের সঙ্গে প্রচার করেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের প্রবল সমর্থক পত্রিকা ‘দ্য পিপল’-এ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভূমিকাকে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করা হয় এবং এই পত্রিকা-ই প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ‘অকুপেশন আর্মি’ বলে অভিহিত করা হয়। ২৫ মার্চ দখলদার পাকিস্তান বাহিনী ‘পিপল অফিস’ ট্যাঙ্ক ও কামান দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল।
(বাংলাদেশের সংবাদপত্র: সুব্রত শংকর ধর, প্রথম প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর, ১৯৮৫, ভাষা-শহীদ গ্রন্থমালা, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-৯৮)।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পত্র-পত্রিকা :
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস জনগণের দৃঢ় মনোবল আর দীপ্র চেতনাকে অণুক্ষণ শাণিত রাখার ব্যাপারে গৌরবময় ভূমিকা রেখেছে দুটি মাধ্যম। একটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অপরটি মুক্তাঞ্চল ও মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা। প্রধানত মুক্তাঞ্চলেই ছিল এসব পত্র-পত্রিকার প্রচার এবং কখনো কখনো গোপনে অধিকৃত বাংলাদেশেও।

অধিকৃত বাংলাদেশেও গোপনে বেরিয়েছে কিছু কিছু পত্রিকা। মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের দুর্জয় চেতনাকে শাণিত করে রেখেছিল যেসব পত্র-পত্রিকা তার মধ্যে ছিল- শাশ্বত বাংলা, জয়বাংলা, স্বরাজ, বিপ্লবী বাংলাদেশ, বাংলার বাণী, দুর্জয় বাংলা, সংগ্রামী বাংলা, হাতিয়ার, সাপ্তাহিক অভিযান, সাপ্তাহিক বাংলার মুখ, সাপ্তাহিক একতা, সাপ্তাহিক দাবানল, সাপ্তাহিক স্বাধীন বাংলা, সাপ্তাহিক বাংলা, অগ্রদূত, রণাঙ্গণ, মুক্তি, জাগ্রত বাংলা, সাপ্তাহিক বঙ্গবাণী, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, মুক্তবাংলা, সাপ্তাহিক স্বাধীন বাংলাদেশ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, সাপ্তাহিক আমার দেশ, পাক্ষিক অক্ষৌহিনী, সাপ্তাহিক বিপ্লবী আন্দোলন, সাপ্তাহিক রাষ্ট্রদূত, পাক্ষিক চাবুক, পাক্ষিক স্বদেশ, রুদ্রবীণা, দর্পণ, ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার, লড়াই, দি নেশন, মুক্তিযুদ্ধ, নতুন বাংলা, স্বাধীনতা, দেশবাংলা, আমোদ, জনতা, সাপ্তাহিক প্রতিনিধি, সপ্তাহ, জন্মভূমি, মায়ের ডাক, কালান্তর এবং আরও অনেক পত্রিকা।

ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ‘দ্য পিপল’এর অফিস পুড়িয়ে দেওয়ার পর সম্পাদক আবিদুর রহমান মুজিবনগর থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে ‘পিপল’ প্রকাশ করেন ১৯৭১ সালের মে মাসে। দেশের ভেতরে এবং বাইরে পত্রিকাটির প্রচার ছিল যথেষ্ট। বস্তুত বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের খবর পৌঁছে দেওয়ায় এবং বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনে অনেকখানি ভূমিকা পালন করেছে ‘দি পিপল’ (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১১১-১১২)। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতি বৎসর প্রকাশিত দৈনিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক এবং সাপ্তাহিক পত্রিকার পরিসংখ্যান। বাংলাদেশ আমল-ক. ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত ও বিলুপ্ত সংবাদপত্র

ক. ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও সংবাদপত্রের যাত্রা-পথটা পাকিস্তানি আমলের ধারাবাহিকতাই বজায় ছিল। এ সময় সরকার কিছু পত্রিকার মালিকানা গ্রহণ করে। এই সময়ের সংবাদপত্রগুলো সরকার-পক্ষ ও বিরোধী পক্ষ দুটি ধারায় অবস্থান নেয়। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে স্বাধীন দেশের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু এদেশের সাংবাদিকতার জগতেরই নিজস্ব লোক ছিলেন বলে তাঁর সে ভাষণ ছিল সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ; কিন্তু দিন যতই যাচ্ছিল স্বাধীনতাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির সংবাদপত্রের ভ‚মিকা লাগামহীন হয়ে যায়। সরকারের কট্টরবিরোধী অবস্থান নিয়ে এক সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় বেশ কিছু সংবাদপত্র, যার মধ্যে ছিল ‘গণকণ্ঠ’, ‘হক কথা’, ‘নয়াযুগ’, ‘বঙ্গবার্তা’। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে সরকার সব সংবাদপত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে নেয় এবং চারটি ব্যতীত সকল পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
খ. ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়
এ সময়ের প্রায় পুরোটাই ছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামল। সামরিক শাসকগণ স্বভাবতই তাদের গুণকীর্তন করার জন্য তাদের নিয়ন্ত্রণে সংবাদপত্র প্রকাশে আগ্রহী হন এবং এক শ্রেণির সাংবাদিককে এ কাজে নিয়োজিত রাখতে প্রয়াস চালান। বাংলাদেশেও তাই হয়েছিল। কারণ এই দুই শাসকই ক্ষমতায় এসেছিল অগণতান্ত্রিক পন্থায়।

তাদের সময়ে সংবাদপত্র প্রকাশনার ওপর থেকে কিছু বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় বিভিন্ন জেলা, শহর থেকে অসংখ্য দৈনিক ও সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতে থাকে; কিন্তু এগুলোর মধ্যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল এমন উদাহরণ খুবই কম। সেখানে পেশাদার সাংবাদিক যেমন ছিল না, ঠিক তেমনি সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্বও গড়ে উঠেনি। এ সময় ঢাকায় যে কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘সৈনিক’, ‘ঠিকানা’, ‘কিষাণ’, ‘খবর’ ‘সাপ্তাহিক রোববার’, ‘সাপ্তাহিক যায় যায় দিন’, ‘বিচিন্তা’, ‘দেশদর্পণ’, ‘ঢাকা’ ‘স্বচিত্র স্বদেশ’, ‘সন্ধানী’, ‘খবরের কাগজ’, শক্তি’ও ‘চিত্রবাংলা’।
গ. ১৯৯০’এ নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার গঠনের পর থেকে বতর্মান সময় পর্যন্ত প্রকাশিত ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র
গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতনের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দায়িত্ব গ্রহণ করে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্র সংক্রান্ত ধারাগুলো বাতিল করে দেন। এরপর থেকে শুরু হয় সংবাদপত্র প্রকাশনার নতুন এক অধ্যায়, যা দেশের সুষ্ঠু ও গণস্বার্থের সাংবাদিকতার জন্য সুফল না-কি কুফল বয়ে এনেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ সময়ে যেসব পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, আজ বিলুপ্তির খাতায় নাম লিখিয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘আজকের কাগজ’, ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’, ‘সাপ্তাহিক সময়’, ‘পূর্বাভাস’, ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য নিউজ ডে’, দ্য ‘টেলিগ্রাফ’ ইত্যাদি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে সরকারি মালিকানাধীন অর্থাৎ ট্রাস্টের পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’, ‘বাংলাদেশ টাইমস’, ‘বিচিত্রা’, ‘আনন্দ বিচিত্রা’ বন্ধ ঘোষিত হওয়াও সাংবাদিকতার ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এর কিছুদিন পর আওয়ামী লীগ সরকার-সমর্থিত ব্যক্তি মালিকানায় ‘বিচিত্রা’ প্রকাশিত হতে থাকলেও, ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে তা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এ সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সংবাপদপত্রের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি নিঃসন্দেহে ‘দৈনিক আজকের কাগজ’।

কারণ ’৯০’এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবে দেশে মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশে ‘আমাদের চোখ খোলা, আমাদের হাত বাঁধা নেই, আমরা বলতে পারি’-এমন একিট আকর্ষণীয় স্লোগান নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকাটি এদেশের পাঠকসমাজকে নাড়াও দিয়েছিল ব্যাপক; কিন্তু মালিকানার দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন স্বার্থগত কারণে পত্রিকাটি কয়েক বছর না যেতেই প্রতিষ্ঠালগ্নের আদর্শ হারিয়ে ফেলে এবং এক সময় বন্ধও হয়ে যায়।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো বাতিল করার পর রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন ধরনের সংবাদপত্র প্রকাশের হিড়িক পড়ার পাশাপাশি এই স্বাধীনতার অপব্যবহার কী আকার ধারণ করেছিল, তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন সাংবাদিক সোহরাব হোসেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ একটি অদ্ভূত জায়গা। এখানে পাঠকের তুলনায় সংবাদপত্রের সংখ্যা বেশি। সাংবাদিকের চেয়ে সম্পাদকের দল ভারী। পৃথিবীর আর কোনো রাজধানী শহর থেকে এত বিপুলসংখ্যক দৈনিক ও সাপ্তাহিক বের হয় কি-না সন্দেহ।
ইচ্ছে করলে গিনেস বুকেও নাম ওঠানো যেতে পারে। পত্রিকার স্টলে ১২/১৩টি দৈনিক ও ২০/২২টি সাপ্তাহিকের বেশি পাওয়া যায় না; কিন্তু ডিএফপির হিসেবে ঢাকা শহর থেকে শতাধিক দৈনিক ও চার শতাধিক সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশ পাচ্ছে। এই পত্রিকাগুলোর অফিস কোথায়- সাংবাদিকরা কোথায় জানতে ইচ্ছে করে।

রাজধানীর বাইরে তাকালে আমরা কী দেখব? দেশের ৬৪টি জেলা শহর থেকে ৩/৪টি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সাপ্তাহিকের সংখ্যা অগণন। সাবেক বৃহত্তর জেলা শহর থেকে গড়ে প্রকাশিত হচ্ছে ৮ থেকে ১০টি দৈনিক এবং বিভাগীয় শহর থেকে ন্যূনতম ১৫/২০টি দৈনিক পত্রিকা আছে’। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৭-১৮)। সাংবাদিক সোহরাব হাসানের প্রবন্ধে চিত্রায়িত এই দৃশ্যপট ২০০০ সালের। এরপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে আরও কত জল বয়ে গেছে!
আর এই জলের কী অবস্থা এদেশের সচেতন সমাজের কারও কাছে অজানার কিছুই নয়। পরবর্তীকালে থেকে সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) মাধ্যমে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল দেশের বিদ্যমান সংবাদপত্রগুলোতে ওয়েজবোর্ড অনুয়ায়ী সাংবাদিকরা সুযোগ-সুবিধা পায় কি-না তা তদন্ত করার। তখনো অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
সর্বশেষ ২০২০ সালে মার্চ মাসে বিশ্বব্য্যাপী শুরু হওয়া করোনা মহামারির সময় বাংলাদেশের সর্বস্তরের কত পত্রিকা যে বন্ধ হয়ে গেছে, তার যথাযথ হিসেব এখনো প্রকাশিত হয়নি। আর হিসেব করেও কতটুকু যথার্থ চিত্র বের হয়ে আসবে, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র জগৎটি এখন সবচেয়ে বেশি ‘অনিশ্চয়তাপূর্ণ’! প্রতিটি জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন-গ্রাম পর্যায়েও সংবাদপত্র ও সাংবাদিক পরিচয়টি এখন যে-অবস্থা ধারণ করেছে, তাতে এই ঐতিহ্যবাহী ক্ষেত্রটি আজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে দেশের সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় সম্মানসহ এমএ ডিগ্রি অর্জন করে প্রতি বছর হাজারও ছেলে-মেয়ে বের হচ্ছে; কিন্তু সাংবাদিকতায় তাদের কাজের সুযোগ কতটুকু আছে, সে বিষয়টি দেখভাল করার কেউ আছে কি-না তা স্পষ্ট নয়। সাংবাদিকতায় মেধাবী ও ভালো ফল অর্জনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতায় ঢুকে পড়ছে।
কারণ চাকরি হিসেবে এই শিক্ষকতা অনেক বেশি নিরাপদ ও সম্মানজনক। প্রশ্ন আসে সবাই শিক্ষকতায় চলে গেলে সাংবাদিকতা করবে কে? মেধাবীদের চাকরি হিসেবে সাংবাদিকতা এখন কী অবস্থায় আছে, তা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনেরা ভালো করেই জানেন।
এ অবস্থা চলতে থাকলে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতায় ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা, বাড়বে প্রকাশিত হয়ে আবার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পত্র-পত্রিকার সংখ্যাটিও- করপোরেট-পুঁজি যতই এখানে বিনিয়োগ হোক না কেন। তাই দেশের ঐতিহ্যবাহী সংবাদপত্র জগতের এই রুঢ় বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা, গবেষণা ও যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখনই সময়।

লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক। সুত্র: সাম্প্রতিক দেশকাল।

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..