রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১১:৪২ পূর্বাহ্ন
: মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী:
১৯০৭ সালে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান শাস্ত্রীয় পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপালের রাজ দরবারের রয়্যাল লাইব্রেরী থেকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন চর্যাপদ উদ্ধার করে আনেন। যা আমাদের বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনকালের ইতিহাস ঐতিহ্য হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। চর্যাপদের ৪৭টি রচনায় ২৪ জন কবি-লেখকের লেখা রয়েছে।
চর্যাপদ এর বেশীর ভাগ রচনায় সিলেটের টিলা পাহাড় ও হাওর, বিল, ঝিল এর বিবরণ রয়েছে। এতে করে চর্যাপদ এর বেশিরভাগ কবি-লেখকদের বাড়ি সিলেটের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং বর্তমান ভারতের আসামের করিমগঞ্জ, সিলচার বলে ধারণা করা হয়।
চর্যাপদ এর রচনাকাল খ্রীস্টাব্দ নবম থেকে দ্বাদশ বলে পন্ডিতদের ধারণা। স্বাধীন বাংলার স্থপতি রাজা শশাঙ্ক বাংলা ভাষাকে এবং বাংলা সনকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা প্রদান করেছিলেন ৬০৮ থেকে ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে। রাজা শশাঙ্কের পরে বাংলার চার শ’ বছরের পাল শাসনামলে বাংলা এবং পালি ভাষাকে রাস্ট্রীয়ভাবে মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল।
সেন রাজাদের আমলে ১০৯৫ সালে বাংলাভাষার উপর স্টীম রোলার চালানো হয়। বাংলাভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাভাষার কবি-লেখকদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হয়। যার ফলে বাংলাভাষার কবি-লেখকগণ কেউ কেউ নেপালে এবং কেউ কেউ আরাকানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যে কারণে নেপালের রাজ দরবারে চর্যাপদ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল। যার ফলে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পক্ষে উদ্ধার করে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল।
মহান জ্ঞান তাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর গবেষণায় বলেছেন- গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকেই বাংলাভাষার উদ্ভব এবং গৌড়ীয় প্রাকৃত এর উৎপত্তিস্থান হচ্ছে অসমিয়া কামরূপ। সুতরাং সিলেট অঞ্চল হচ্ছে প্রাচীন বাংলাভাষার উৎপত্তিস্থলের অংশ বিষয়।
বাংলাভাষার জন্য শুধু ঢাকায় রক্ত দেয়া হয়নি, ১৯৬১ সালে আসামের বরাক উপত্যকায় সিলচরে ১১ জন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে ভারতের বুকে বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতান এর বাড়ি সিলেটে ছিল। যিনি দ্বৈর্থহীন কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন-
“যারে যেই ভাষে প্রভু করিলেন সৃজন,
সেই ভাষ হয় যেন তার অমূল্য রতন।”
মধ্যযুগে সিলেটের অনেক অনেক লোককবিদের গান, গজল, গীতও আমাদের বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধশালী করেছে। যাদের নাম আমরা অনেকই জানি না। তাদের মধ্যে সৈয়দ শাহনূর (রহ.) অন্যতম।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্নে ও সিলেটের মরমী সাধক, কবি-লেখকদের শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে আমাদের বাংলা সাহিত্যে। যাদের মধ্যে অন্যতম দেওয়ান হাছন রাজা, রাধারমণ দত্ত, মৌলানা ইয়াসিন (রহ.), ইব্রাহিম তশনা, আরকুম শাহ, শিতালং শাহ, ছাবাল আকবর আলী, আনফর শাহ, আছকির শাহ প্রমুখ। উপমহাদেশের শক্তিমান লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বাড়িও সিলেটের মৌলভীবাজারে।
চতুর্দশ শতকে হযরত শাহজালাল (রহ.) ও ৩৬০ আউলিয়ার আগমনের ফলে সিলেটে সুফি ভাবাদর্শের গান, গজল, গীত রচিত হয়েছে প্রচুর। প্রাচীন বাংলাভাষা ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সিলেটের কবি-লেখকদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। যার পরিপূর্ণ বিবরণ লিখে প্রকাশ করলে কয়েক ফর্মার বই পুস্তকে বিশ্লেষণ করা দরকার। তাই সংক্ষিপ্ত আকারে আজকের মতো এ টুকু-ই তুলে ধরলাম।
মহান জ্ঞান তাপস ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাভাষার উৎপত্তিস্থল অসমিয়া কামরূপ উল্লেখ করেছেন। তার বিচরণক্ষেত্র হচ্ছে, বৃহত্তর সিলেট আসামের বরাক উপত্যকা, কাছাড়, মেঘালয়া, ত্রিপুরা এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ। সুতরাং সিলেট অঞ্চল হচ্ছে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের লীলাভূমি। যার প্রমাণ চর্যাপদ এর বেশিরভাগ রচনায় প্রমাণিত।
১৩/১২/২০২৪ইং, সাহিত্য কুটির, সিলেট।
লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, কলামিস্ট, কবি, চেয়ারম্যান- বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাব ও বাংলাদেশ লোকসাহিত্য গবেষণ পরিষদ।