বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৭ পূর্বাহ্ন
: আফতাব চৌধুরী:
অনেকের-ই হয়তো জানা নেই যে, নজরুলই প্রথম বাংলায় সার্থক ইসলামি সঙ্গীতের প্রচলন করেন। এ ব্যাপারে নজরুল নজরুলই, তাঁর দ্বিতীয় নেই। তাঁর আল্লাহ প্রেমের মহৎ বেদনা বা অনুরাগ থেকে বাংলা সাহিত্যের ভÐারে যে সোনালী ফসল উঠে এল তাঁর সৌরভের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়াই এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়।
ভারতীয় লেখক আব্দুল আজিজ আল-আমান সম্পাদিত ‘নজরুলগীতি অখÐ’ বইতে প্রায় দু’শটি ইসলামী সঙ্গীত রয়েছে। এসব গানের বাণীর অর্থমূল্য ও ধ্বনিমূল্য দুই-ই আশ্চর্য সমুন্নতি লাভ করেছে। সুরারোপ ছাড়াও তাঁর অধিকাংশ সঙ্গীতকে রসোত্তীর্ণ গীতিকবিতা হিসেবে পাঠ করা চলে। বাণী থেকে সুরের আবরণ খসে গেলেও কথার হীরক ঔজ্জ্বল্য কিছুমাত্র নি®প্রভ হয় না, উপমা-উৎপ্রেক্ষার মহত্তম দীপ্তিতে আকৃষ্ট না হয়ে উপায় নেই, রসলোকে তাদের অবদান সমান থেকে যায়। বাংলার গীতিসাহিত্যের ইতিহাসে তার বড় একটা নজির মিলে না। নিম্নোক্ত গানটি লক্ষ্য করা যাকÑ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর/বদনসীব আয়, আয় গুনাহগার, নতুন করে সওদা কর। /জীবন ভরে করলি লোকসান আজ হিসাব তার খতিয়ে নে/বিনিমূল্যে দেয় বিলিয়ে সে যে বেহশ্তী নজর।/ক্বোরআনের ঐ জাহাজ বোঝাই হীরা-মুক্তা পান্নাতে/লুটেনে রে লুটেনে সব ভরে তোল্ তোর শূন্য ঘর/ কলেমার ঐ কানাকড়ির বদলে দেয় এই বণিক/ শাফায়তের সাতরাজার ধন, কে নিবি আয়, ত্বরা কর/কিয়ামতের বাজারে ভাই মুনাফা যে চাও বহুৎ/এই ব্যাপারীর হও খরিদ্দার লও রে ইহার শীলমোহর/আরশ হতে পথ ভুলে এ এল মদিনা শহর/নামে মোবারক মোহাম্মদ, পূজি ‘আল্লাহ আকবর’।’
ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভেদজ্ঞান, হানাহানি নজরুলের অন্তরে ব্যথার সঞ্চার করেছিল। ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে বলতে গিয়ে হযরত মুহম্মদ (দঃ) কে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি যে মিম্নোক্ত গানটি রচনা করেন ভাষাশৈলীর কারুকালে তা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে বহুলাংশেইÑ ‘তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ, ক্ষমা করো হযরত/ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ তোমার দেখানো পথ/বিলাস বিভবে দলিয়াছ পায়ে, ধূলি সম তুমি প্রভু/তুমি চাও নাই আমরা হইব বাদশ্Ñানওয়াব কভু।/এই ধরণীর ধনসম্ভার/সকলের তাহে সম-অধিকার,/তুমি বলেছিলে, ধরণীতে সবে সমান পুত্রবৎ।/তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে/আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।/ভিনধর্মীর পূজা-মন্দির/ভাঙিতে আদেশ দাওনি, হে বীর,/আমরা আজিকে সহ্য করিতে পারি নাকো পরমত্।/তুমি চাহ নাই ধর্মের নামে গøানিকর হানাহানি/তলওয়ার তুমি চাও নাই হাতে, দিয়াছ অমর বাণী/মোরা ভুলে গিয়ে তব উদারতা/সার করিয়াছি ধর্মান্ধতা/বেহেশত হতে ঝরে নাকো আর তাই তব রহমত।’
বাঁধনহারা কবি নজরুল ইসলাম। কোনও এক স্থানে স্থির হয়ে থাকার তাঁর উপায় নেই। আল্লাহর প্রতি অনুভূতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘…..যুদ্ধভুমিতে তাঁকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাঁকে দেখেছি, ফাঁসির মঞ্চে তাঁকে দেখেছি। আমার গান সেই সুন্দরকে রূপে রূপে অপরূপ করে দেখার স্তবস্তুতি:
‘দেশে দেশে গেয়ে বেড়াই তোমার নামের গান/হে খোদা, এ যে তোমার হুকুম, তোমারই ফরমান।/এমনি তোমার নামের আছর/নামাজ রোজার নাই অবসর/তোমার নামের নেশায় সদা মশ্গুলমোর প্রাণ/তকদিরে মোর এই লিখেছÑহাজার গানের সুরে/নিত্য দিব তোমার আজান আঁধার মিনার-চূড়ে।/কাজের মাঝে হাটের পথে/ রণ-ভূমে এবাদতে/আমি তোমার নাম শোনাব, করব শক্তি দান।’
ছন্নছাড়া বাঁধনহানা কবি নজরুল ইসলাম উপাসনা তথা নামাজ-রোজার বদলে স্বর্গকামনা করেন নি, কামনা করেন কেবল আল্লাহ বা খোদার সান্নিধ্য। এই বিশ্বপ্রকৃতি যেমন করে প্রতিনিয়তই তাঁর তপস্যায় নিমগ্ন তিনিও যেন এর ব্যতিক্রম নন। এই উপলক্ষে তাঁর বিরচিত নিম্নোক্ত গানটি বাংলা সাহিত্যের সরাইয়ে (হাঁড়িতে) কী রূপ মণি-মুক্তার জোগান দিয়েছে, তা লক্ষ্য করা যাক-
খোদার প্রেমের শারাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে রই পড়ে/ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।/দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ রোজার বদলাতে/চাই না বেহেশ্ত খোদার কাছে নিত্য মোনাজাত করে।/কয়েস যেমন লায়লী লাগি লভিল মজনু খেতাব/যেমন ফরহাদ শিরীর প্রেমে হল দীওয়ানা বেতাব/বে-খুদীত মশগুল আমি তেমনি মোর খোদার তরে।/পুড়ে মরার ভয় না রাখে, পতঙ্গ আগুনে ধায়;/সিন্ধুতে মেটে না তৃষ্ণা, চাতক বারিবিন্দু চায়।/চকোর চাহে চাঁদের সুধা চাঁদ সে আসমানে কোথায়;/সুরয্ থাকে কোন সুদূরে, সূর্যমুখী তারেই চায়/তেমনি আমি চাহি খোদায়, চাহি না হিসাব করে।’
আমরা আরব্য উপন্যাসে আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্প পড়েছি, পড়েছি আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনীও। কিন্তু কোথাও এরূপ বাসনা কারও মুখে শুনিনি। সুদূর বায়লা ভুখÐে জন্মগ্রহণ করেও কবি নজরুল আরব দেশের মাটি বা ভূখÐে হতে চান, চান মদিনার পথঘাট তথা ধুলো-মাটি হতে। তাঁর এই বাসনা নিয়ে রচিত নিম্নোক্ত গানটি বাঙালি পাঠকসত্তায় কীরূপ রসের সঞ্চার করে, তা একটু খতিয়ে দেখা যাকÑ
‘আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ/এই পথে মোর চলে যেতেন নুর-নবী হযরত/পয়জা তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে,/আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে/সেই চিহ্ন বুকে পুরে/পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে/সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত।/মা ফাতেমা খেলত্ এসে আমার ধূলি লয়ে/আমি পড়তাম তাঁর পায় লুঠিয়ে ফুলের রেণু হয়ে/হাসান-হোসেন হেসে হেসে/নাচ্ত আমার বক্ষে এসে/চক্ষে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত।/ আমার বুকে পা ফেলেরে বীর অস্হাব যত/ রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর ক্ষত/কুল্ মুসলিম আসত কাবায়/চলতে পায়ে দল্ত আমায়/ আমি চাইতাম খোদার দীদার শাফায়ৎ জিন্নত।’
নজরুলের ইসলামি সঙ্গীতের সাহিত্যিক মূল্যায়নই যেহেতু এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়, সেসঙ্গে এ সম্পর্কে একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক। গানে কাব্যে মনের ভাবা বা বাণী ভাষার কারুকার্যে সাহিত্য-রসের সৃষ্টি করে থাকে। তাই এদিক থেকে ‘কথা’ বা ‘বাণী’র মূল্য অপরিসীম। নজরুল সাহিত্য কবির ‘কথা’ বা ‘বাণী’র গূঢ় অর্থ না বুঝে, বলতে গেলে বোঝার চেষ্টা না করে অনেকেই অযথা হইচই করেছেন, গেল গেল বলে রব তুলেছেন এবং বিরূপ মন্তব্য করেছেন। বোধকরি এখনও এর বিরাম নেই। এ সম্পর্কে নজরুল নিজেই বলেছেন,
‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি, ও দু’টোর কিছু নয়।…আপনারা জেনে রাখুনÑআল্লাহ ছাড়া আর কিছু কামনা আমার নেই। …আজ মোল্লা-মৌলভী সাহেবদের মুসলমানীর ফখরের কাছে টেকা দায়। কিন্তু তাঁদের আজ যদি বলিÑযে ইসলামের অর্থ আত্মসমর্পণÑআল্লাহতালায় সেই পরম আত্মসমর্পণ কার হয়েছে? আল্লাহে পূর্ণ আত্মসমর্পণ যাঁর হয়েছে তিনি এই দুনিয়ার এই মুহূর্তে ফেরদৌসে (স্বর্গে) পরিণত করতে পারেন। আমরা কথায় কথায় অন্য ধর্মাবলম্বি ও নিজ ধর্মের জ্ঞানবাদীদের কাফের বলে থাকি। এই কাফেরের অর্থ আবরণ বা যা আবৃত রাখে।…আল্লাহ। ও আমার মাঝে যতক্ষণ আবরণ রইল, ততক্ষণ কাফের, অর্থাৎ আমার পরম তত্ত¡ আমার শক্তি ও সত্য ততক্ষণ আবৃত। এমন একজন মুসলমানেরও যদি বাংলায় কেন, সারা দুনিয়ায় সন্ধান পানÑআমি তাঁর কাছে মুরীদ (শিষ্য) হতে রাজি আছি। আমার মধ্যে যতক্ষণ আবরণ অর্থাৎ ভেদাভেদ-জ্ঞান, সংস্কার, কোনও প্রকার বাধা-বন্ধন আছেÑততক্ষণ আমার মাঝে ‘কুফর’ ও আছে। আমি সর্ববন্ধন-মুক্ত, সর্ব ভেদাভেদ-ঝাহন মুক্ত না হলেÑসেই পরম মুক্ত আল্লাহকে পাব না আমার শক্তিতে। শক্তিমান পুরুষই কওমের, জাতির, দেশের, বিশ্বের ইমাম হনÑঅধিনায়ক হন। অনন্ত দিক যাঁকে ধরতে পারেনি, সেই পরম দিগম্বরের করুণা পাবে এইসব দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য লোভীর দল ? যে জাতির পবিত্র ক্বোরআনের প্রথম শিক্ষাÑ‘আলহামদুলিল্লাহে রাব্বুল আলামিন’Ñসমস্ত প্রশংসা, মহিমা, যশ, খ্যাতি আল্লাহর প্রাপ্য আমার নয় Ñসেই আয়াত দিনে শতবার উচ্চারণ করেও যাঁরা ভোগের পাকে পড়ে রইল কর্দ্দম-বিলাসী মহিষের মতÑতাঁরা আর যাই হনÑআল্লাহর ও তাঁর রসুলের কৃপা পাননি।’ (দ্রঃ ১৯৪০ সালে ২৩ ডিসেম্বর কলিকাতা মুসলিস ছাত্র সম্মেলনের অধিবেশনে সভাপতিরূপে কবিপ্রদত্ত ভাষণ)।
উল্লেখ্য, উপরোক্ত ভাষণে নজরুল বলেছিলেন, আল্লাহ ছাড়া আর কোনও কিছুতেই কামনা নেই তাঁর। এই অভিব্যক্তি ভাষাশৈলীর জাদুস্পর্শে অক্ষয় হয়ে ফুটে উঠেছে নিম্নোক্ত গানেÑ
‘প্রভু তোমাতে যে করে প্রাণ নিবেদন ভয় নাহি আর তার।/শত সে বিপদে আপদে তাহার হাত ধরে কর পার/তার দুঃখে-শোকে ভাবনায় ভরে/তব নাম রাজে সান্ত¡না হয়ে,/ সে পার হয়ে যায় তব নাম পেয়ে দুস্তর পাবাবার/ঝড়-ঝঞ্ঝায় প্রাণশিখা তার শান্ত অচঞ্চল,/টলমল করে রূপেরসে তার জীবনের শতদল।/যেমন পরম নির্ভরতায় শিশু তার মার বক্ষে ঘুমায়/তোমারে যে পায় সেজন তেমনি ভরে না ত্রিসংসার।’
কবি গানে গানে আরব দেশের মাটি হতে চেয়েছিলেন, হতে চেয়েছিলেন ‘মদিনারই পথ’।Ñঅনেক অপূর্ণ ইচ্ছার মাঝে অন্তিম হয়তো এই একটি ইচ্ছাই তার পূর্ন হয়েছেÑ
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।/যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।/ আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,/পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।/গোর আজাব থেকে থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।/ কত পরহেজ্াগার খোদার ভক্ত নবিজির উম্মত/ঐ মসজিদে করে রে ভাই ক্বোরআন তেলাওত্।/সেই ক্বোরআন শুনে যেন আমি পরান জুড়াই/কত দরবেশ ফকির রে ভাই মসজিদের আঙিনাতে/আল্লার নাম জিকির করে লুকিয়ে গভীর রাতে/আমি তাদের সাথে কেঁদে কেঁদে/আল্লার নাম জপিতে চাই।’
উল্লেখ্য, মৃত্যুর পর কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাঁর আত্মার শান্তি দিন! সাংবাদিক-কলামিস্ট
২২.০৫.২০২৫