মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০০ অপরাহ্ন
সৈয়দ মহসীন পারভেজ :: সমাজপতিদের কড়া নির্দেশনা এদের বাড়ি যাওয়া যাবে না, বসা যাবে না। তাদের দোকান থেকে কেনাকাটাও করা যাবে না। যে কেনাকাটা করবে সেই হবে সমাজচ্যুত। সমাজপতিদের এমন সিদ্ধান্তে মৗলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কোরবানপুর গ্রামের তিনটি পরিবার নয় মাস ধরে মানবেতন জীবনযাপন করছেন। ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে আদালতে মামলা করায় সমাজচ্যুত করে রাখা হয় কাজল আহমদ, আকমল হোসেন ও জুবেল আহমদের পরিবারকে। এনিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না ভূক্তভোগী পরিবার।
ভূক্তভোগী পরিবারের সূত্রে জানা যায়, জায়গা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তার দাদার ভাই তোরাব আলীর নাতী পাখি মিয়ার সাথে বিরোধ চলছিল। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সালিশকারী ও পঞ্চায়েত কমিটি সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের কাছে গেলে তারা উভয়পক্ষের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা জামানত নিয়ে সালিশের সময় দেন ২০২০ সালের ১৯ জুন। সালিশের দিন জায়গার কাগজপত্র নেন। সালিশে তিনি কাগজ অনুযায়ী ন্যায় বিচারের দাবি করেন। রেকর্ডে এক শতাংশ জায়গার মালিক হলেও গ্রাম্য পঞ্চায়েতে সালিশকারীগণ তাদের জায়গা বুঝিয়ে দেননি। এটি নিয়ে ন্যায় বিচারের জন্য গত ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে স্বত্ব মামলা (মামলা নং ৯৭/২০২০ ইং) দায়ের করেন। আদালতে মামলা করায় সালিশকারীগণ ক্ষীপ্ত হয়ে ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর কোরবানপুর গ্রাম থেকে সমাজচ্যুত করে পঞ্চায়েত কমিটি। সমাজচ্যুত হওয়া কাজল আহমদ, আকমল হোসেন ও জুবেল আহমদের পরিবার এখন দিশেহারা।
সমাজচ্যুত হওয়া কাজল আহমদ বলেন, সমাজচ্যুত করার কারণে গত ১৪ ডিসেম্বর থেকে চরম দুর্ব্যবহার, স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায়ে বিভিন্ন ধরণের বাধা বিপত্তি দেয়া হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লোকজন না আসা এমনকি গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বার্তা বলিতে না দেওয়া সহ স্বাভাবিক জীবন যাত্রা পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এবিষয়ে মৌলিক অধিকার হরণ, মানবাধিকার লঙ্গনের জন্য বিবাদী পাখি মিয়া, পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নজরুল মিয়া, সদস্য চেরাগ মিয়া, চুনু মিয়া, হান্নান মিয়া, কাদির মিয়ার নামোউল্লেখ করে সমাজচ্যুত করার কারণ জানতে চেয়ে একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করি। ঐ লিগ্যাল নোটিশের কোন সন্তুষজনক জবাব তারা দেয়নি। উপরন্তু তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করায় আরও ক্ষীপ্ত হয়ে সালিশকারীগণ বিবাদী পাখির মিয়ার বাড়িতে আবারও বসে তাদেরকে ৫ বছরের জন্য চুড়ান্তভাবে সমাজচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নজরুল মিয়া প্রভাবশালী লোক। তার বিরোদ্ধে এলাকায় কেউ কথা বলতে চায় না। তার বিরোদ্ধে কেউ গেলে তাদেরকেও সমাজচ্যুত করা হয়। সালিশে আমাদের জমাকৃত টাকা ও জায়গার কাগজপত্রাদি সমূহ সালিসকারীগণ আমাদের এখনো বুঝিয়ে দেননি। এছাড়াও বর্তমানে তাদের ছেলে-সন্তানরা মক্তবে গিয়ে কুরআন শিক্ষা করতে পারছে না সমাজচ্যুতের কারণে। তাদেরকে সমাজের অন্যান্য ছোট্ট সন্তানরা হেয় করে কথা বলছে। যার জন্য তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আমাদেরকে সমাজচ্যুত করার পর থেকে প্রশাসন, থানা পুলিশ ও জনপ্রতিনিধি সহ সকলের কাছে ঘুরতে ঘুরতে আমরা এখন অনেকটাই ক্লান্ত। আমাদের পরিবারের কোনো সদস্যদের মসজিদে নামাজ পড়তে বাঁধা সহ সমাজের কাউকেই আমাদের সাথে কথা বলতে দিচ্ছেনা পঞ্চায়েত কমিটি। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামবাসীরা জানান, সালিশকারীগণ এলাকার লোকদেরকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে না যাবার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ দিয়েছেন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গেলে তাদেরও পরিণতি তার মতো হবে। সমাজচ্যুত করার পর মসজিদের ইমামের বেতন ও মক্তবের জন্য সাপ্তাহিক যে চাঁদা নেয়া হতো তাও নিতে নিষেধ করা হয়েছে। এমনকি সমাজচ্যুত হওয়া পরিবারের কেউ মারা গেলে বা অসুস্থ হলে বাড়িতে না যাবার জন্য পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হয়। এসব নিয়ে যে কথা বলবে তাকে সমাজচ্যুত করা হয়।
এবিষয়ে গ্রাম্য পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নজরুল মিয়া বলেন, আমাদের গ্রামে এই ধরণের কোন ঘটনা ঘটেনি। মসজিদে নামাজ পরতে বাধা দেয়ার আমাদের কোন অধিকার নেই। তারা মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনও তদন্ত করছে।
কুলাউড়ার ভূকশীমইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, এই পঞ্চায়েত কমিটির মধ্যে সমস্যা আছে। তারা একেক সময় একেক পরিবারকে সমাজচ্যুত করে।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, আইনগতভাবে রাস্ট্রের কোন নাগরিককি সমাজচ্যুত করে রাখার অধিকার কারো নেই। বর্তমান সময়ে এরকম ঘটনা সত্যিই মর্মান্তিক। সভ্য সমাজে এরকম সমাজচ্যুতের ঘটনা ঘটতে পারে না। আমি ভূক্তভোগী পরিবার ও পঞ্চায়তের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি।