শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:২৭ অপরাহ্ন
বিশ্বজিৎ রায় :: অনেকেই সনাতন ধর্মের মূর্তি পূজা নিয়ে প্রশ্ন করেন। মানুষের বানানো প্রাণহীন মূর্তির কেন উপাসনা করা হয়? এ প্রশ্ন যে শুধু অন্য ধর্মের লোকেরা করেন তাই নয় বরং অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও করেন। অনেক হিন্দু মনে করে হিন্দুরা মূর্তি পুজা করে এবং মানুষের বানানো মূর্তিকে প্রণাম করে। আমরা শতকরা ৮০ ভাগ হিন্দুই এর সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারিনা বলেই আমরা অন্যের কাছে হিন্দু ধর্ম কে হাসির পাত্র করি। আর এর মূল কারণ হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার অপ্রতুলতা।
মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় যেভাবে একজন মানুষ তার শিশু অবস্থায় মক্তবে নূন্যতম ধর্মীয় শিক্ষা নেয়ার সুযোগ আছে, হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় তা অনুপস্থিত। নামাজ পড়া, রোজা রাখা ইত্যাদি ধর্মীয় কাজগুলো পালনে মুসলমান সমাজে বাধ্যবাধকতা রয়েছে , যারা এসব ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়মিত পালন করেন না তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। পক্ষান্তরে আমাদের হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় ঘটছে তার ঠিক উল্টোটি। জপমালা গ্রহন, তিলক ধারণ, আহ্নিক, একাদশী পালনসহ বিভিন্ন নিত্যকর্মের রীতি হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় থাকলেও তা পালকারীর সংখ্যা একেবারেই নগন্য। আমাদের সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায় শিশু অবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা নেওয়ার রেওয়াজ যেমন নেই ঠিক তেমনি পরবর্তীতে স্কুল পর্যায়ে যে সনাতন ধর্ম সম্বন্ধে পাঠ দান করা হয় । সনাতনী শিক্ষার্থীদের কাছে তা ধর্মীয় জ্ঞানার্জন হিসাবে বিবেচিত না হয়ে শুধু মাত্র পরীক্ষা পাশের নিমিত্তেই পাঠ গ্রহনের রেওয়াজে পরিণত হওয়ায় কোন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা মোট সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীর শতকরা ১ ভাগ শিক্ষার্থীও সঠিক ভাবে গীতার একটি শ্লোক ও তার অর্থ যথাযত ভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেনা। বিশেষ করে আমরা যারা অভিবাবক তাদের মধ্যে সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার কোন মানসিকতা না থাকায় ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের বিষযটিও এখন একটি ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এভাবেই ক্রমশঃ আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্য থেকে ধর্মীয় চেতনা বোধ হারিয়ে যাওয়ার কারনে কেউ ধর্র্মীয় কোন বিষয় নিয়ে কোন প্রশ্ন করলে আমরা তার সঠিক উত্তর দিতে পারি না।
এবার আসি মূল কথায়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কি মুর্তি পূজা করে ? কেন করে ?
সনাতন ধর্মবলম্বীরা কখনোই মুর্তিকে পূজা করেনা। আমরা যেটাকে মুর্তি হিসাবে ধরে নেই সেটা হলো বিগ্রহ বা প্রতীমা। সর্বগুণময় ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণের রূপকল্প বা প্রতীক এই প্রতীমা বা বিগ্রহ। এক কথায় নিরাকার ঈশ্বরের বিভিন্ন গুনের সাকার প্রকাশই হলো এক একটি প্রতিমা। পূজার সময় পূজারী ব্রাহ্মণগন মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে এসব প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা অর্চনা করেন। তাই একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী যখন মাটির প্রতিমায় এই প্রতীক পূজা করেন তখন তিনি মনে করেন স্বয়ং ভগবানকেই পূজা করছেন। তিনি সে সময় কখনও মনে করেননা কোনও জড় মূর্তি বা খড় বা মাটির উপাসনা করছেন। অতএব একটি বিষয় পরিস্কার যে, আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবতার মূর্তিকে শুধুমাত্র ভগবানের এক একটি প্রতীক হিসাবে মনে করি এর বেশি কিছু নয়।
পূজার সমাপ্তির কাঠ,মাটি ও জল সহ পঞ্চ মহতত্বে তৈরী এই প্রতিমায় আর প্রাণ থাকে না। তখন সেটি একটি মাটির তৈরি মূর্তি হয়ে যায়। তাকে আবার সেই পঞ্চমহতত্তে¡র একটিতেই(তার মধ্যে জল একটি) বিসর্জন দেওয়া হয়। এই বিসর্জনের মধ্যদিয়েই সনাতন ধর্মের আরেকটি চিরন্তন সত্য বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। আর সেটি হলো সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় । যা এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের আপনি আমি আমরা সবাই এবং সবকিছুর ক্ষেত্রেই একই চিরন্তন সত্য।
এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “মূর্তিপূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া। মৃন্ময় মাঝে চিন্ময় হেরে(দেখে) হয়ে যাই আত্মহারা।।” (ঐওঘউটঝ ফড়হ’ঃ ঢ়ৎধু ঃযব রফড়ষ, ঃযবু ঢ়ৎধু ঃযব রফবধষ.)
আমরা জানি যে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তাহলে প্রতিমারুপী এই দেবতারা কারা ?
হিন্দু শাস্ত্র মতে , ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন ¯্রষ্টা নেই, তিনি নিজেই নিজের ¯্রষ্টা। ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই(নিরাকার ব্রহ্ম) তাই তিনি অরূপ, তবে তিনি যে কোন রূপ ধারন করতে পারেন কারণ তিনিই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ঈশ্বর এক হলেও দেবতা কিন্তু অনেক। দেব-দেবীগন ঈশ্বরের স্ব-গুনের প্রকাশ। অর্থাৎ ঈশ্বরের এক একটি গুনের সাকার প্রকাশই দেবতা। তাই ঈশ্বরের শক্তির স্বগুন রূপ দুর্গা, কালী, পার্বতী; বিদ্যার স্বগুন রূপ সরস্বতী; ঐশ্বর্যের স্বগুন রূপ ল²ী, মৃত্যুর রূপ যম। তেমনি ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন তখন ব্রহ্মা ( ব্রহ্ম নয়), যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু আর প্রলয় রূপে শিব। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, দেব-দেবী অনেক হতে পারে কিন্তু ঈশ্বর এক এবং দেবতাগণ এই পরম ব্রহ্মেরই বিভিন্ন রূপ।
এ প্রসঙ্গে ঋক্ বেদে বলা আছে- ‘একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি (ঋক-১/৬৪/৪৬) অর্থাৎ সেই এক ঈশ্বরকে পন্ডিতগণ বহু নামে বলে থাকেন। ‘একং সন্তং বহুধন কল্পায়ান্তি’ (ঋক-১/১১৪/৫) অর্থাৎ সেই এক ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে। ‘দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত’ (ঋক-১০/৭২/৭) অর্থাৎ দেবতারও পূর্বে সেই অব্যাক্ত(ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগত উৎপন্ন হয়েছে।
এ থেকেই প্রমানিত হয় যে সনাতন ধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। যারা ঈশ্বরের অব্যক্ত বা নিরাকার উপাসনা করেন তাঁদের বলে নিরাকারবাদি। আর যারা ঈশ্বরের সাকার রূপের উপাসনা করেন তাঁরা সাকারবাদি। এই হিসাবে যারা প্রতীমা পূজা করেন তারা সাকারবাদি। যাবতীয় জড় জাগতিক মোহ থেকেই সাকার উপাসনার উৎপত্তি।
সেই আদিকালে মুনি-ঋষিদের যুগে বেদ যখন রচিত হয় তখন তখন নিরাকার, নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করা হতো। যজ্ঞের মাধ্যমে হোমানল জ্বালিয়ে তখন দেবতাদের আহŸান করা হত, অগ্নির মাধ্যমেই দেবতাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া হতো পুষ্পাঞ্জলি । তখানকার সময়ের সেই উচ্চ মার্গের উপাসনা বর্তমান কলিযুগের মানুষদের পক্ষে খুবই ক্লেশকর। পার্থিব জগতের নানা বিষয় বাসনায় আবদ্ধ আমাদের মন এতই চঞ্চল যে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। আমরা চাইলেই এই কামনা বাসনা বা কোন কিছু পাবার আকাংক্ষা থেকে মুক্ত হতে পারি না। তীব্র গতির এই মনকে সংযত করা, স্থির করার ব্যবস্থা করা হয় এই স্বগুন ঈশ্বরের বিভিন্ন রুপের মাধ্যমে। আর এটাই হলো সাকার উপাসনা।
শ্রীমদ্ভাগবত গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন যে, অব্যক্ত উপাসনা দেহাভিমানী জীবের পক্ষে সম্ভবপর নয়। তাই, দেহাভিমানী জীবের জন্য স্বগুণ সাকার উপাসনাই শ্রেষ্ঠ ও সহজতর। আর এই সকল কারনেই, বর্তমান কলিযুগে আমরা হিন্দুরা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিমা পূজার মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনা করে থাকি।
বিশ্বজিৎ রায়, সাংবাদিক, লেখক, সভাপতি,বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ, কমলগঞ্জ পৌরশাখা, আহ্বায়ক, জাগো হিন্দু পরিষদ,কমলগঞ্জ উপজেলা শাখা ।