রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৪ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : মাথায় সবুজের ঘন স্তুপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের ভাঁজে নিজেকে হারাতে চান কিংবা শীতল পানিতে ডুব দিয়ে পাথর খোঁজতে চান, আপনাকে যেতে হবে সিলেট।
ঝর্ণার কলকল গানের মাঝে কান পেতে হয়তো শুনতে পারেন কোন পাহাড়ি কন্যার প্রেমের গল্প। কখনো রূঢ় হয়ে বান ডেকে নদীর খরস্রোতা সূরে শোনাতে পারে বিষাদের দিনগুলোর কথা!
আর যদি ছলাৎ ছলাৎ পানির শব্দে ছিপ নৌকায় বসে পাখির কূজনে ডুব দিতে চান তবে চলে আসুন সিলেটের রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে।
রাতারগুল বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সিলেটের গোয়াইন নদীর তীরে গোয়াইনঘাট এলাকায় ফতেহপুর ইউনিয়নে এই পর্যটন এলাকাটি অবস্থিত।
১৯৭৩ সালে প্রায় ৫০৪ একর বনকে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং পরবর্তীতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জলাবনের মধ্যে অন্যতম হলো সিলেটের এই রাতারগুল জলাবন।
এই জলাবনের উদ্দেশ্যে বের হলাম সকাল বেলা। আমাদের জন্যে অপেক্ষমান বাসে উঠে বসতে না বসতেই পাহাড়ি কন্যার নুপুরের শব্দে স্বাগত জানালো ঝুম বৃষ্টি। এ যেন আমাদেরকে প্রকৃতির উদাত্ত অভ্যর্থনা জানানোর পদ্ধতি। ছোট্ট রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম ফতেহপুরের দিকে।
পূর্বে যারা রাতারগুল বেড়িয়ে এসেছে তাদের গল্পে মন হারাচ্ছিলো বারবার। পানির মধ্যে অর্ধ নিমগ্ন গাছগুলো বাঁকা বাঁকা অজগরের মতো ডালপালা বিছিয়ে থাকে। ভাগ্যের সুপ্রসন্নতায় হয়তোবা দেখা মিলতে পারে বড় বোয়ালের লেজ নাড়ানো।
ইত্যাদি গল্পের মাঝে সত্যি নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন। ভাববেন, এমন ও কি সম্ভব! বর্ষাকালে এই জলাবন প্রায় ২০ থেকে ৩০ ফুট অথৈ পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে পুরো চারমাস ধরে।
বাকি সারা বছর পানির উচ্চতা থাকে ১০ ফুটের মতো। শুষ্ক মৌসুমে ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে-চলা পথ। আর পানির আশ্রয় হয় বন বিভাগের খোঁড়া বিলগুলোতে। সেখানেই আশ্রয় নেয় জলজ প্রাণীকূল।
সিলেট শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা উপস্থিত হলাম স্বপ্নের রাতারগুলের ধারে। এবার ডিঙি নৌকায় যাত্রা শুরু। মনে মনে চেয়েছিলাম একজন চঞ্চল মাঝি হোক নৌকায়। পেয়ে গেলাম।
সদ্য কৈশোরে পা রাখা নদীর পানিরর মতো উচ্ছ্বল মাঝি। জিজ্ঞেস করে নিলাম গান গাইতে পারে কিনা। লাজুক সুরে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিতেই আমরা নিজেদের আর থামলাম না।
সিলেটের বিখ্যাত পণ্যগুলোর মাঝে ‘শীতল পাটি’ বেশ নাম করা। প্লাস্টিক এসে পাটির স্থান দখল করে নিলেও গ্রামে-গঞ্জে সিলেটি শীতল পাটির কদর এতটুকুও কমেনি।
পাটি বানানোর গাছ মুর্তা বা পাটি গাছের স্থানীয় নাম রাতা গাছ। এই জলাবনে অন্যান্য বড় গাছের ছায়ায় ঝোপাকৃতিতে বেড়ে উঠেছে রাতা গাছের সারি। সেই রাতা গাছের নামানুসারে এ বনের নাম হয়েছে রাতারগুল।
ডিঙি নৌকার সঙ্গে পানির ঘর্ষণে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে এগিয়ে যেতে থাকলাম সবুজের আরো কাছাকাছি। দূর থেকে মাথায় সবুজের পাগড়ি পড়া গাছগুলোর কাছে যেতেই বুঝলাম রাতারগুল নিয়ে পর্যটকেরা অত্যুক্তি করেননি একেবারেই।
অতি মায়াবি চেহারায় আমাদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে মিঠাপানির জলাবন। তবে হ্যাঁ, এখানে মুহুর্মুহু বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা থাকে। হুট করেই বৃষ্টি এসে ঘিরে ধরবে আপনাকে। তাই ছাতা নিতে ভুলবেন না। অন্তত নৌকা ভাড়ার সময় সঙ্গে ছাতাও ভাড়ায় নিবেন।
এবারে চোখ দুটোকে প্রকৃতির সবুজের কাছে বন্ধক রেখে দিই সন্তর্পণে। চারিদিকে কিছু গাছের শাখা প্রশাখাও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এঁকেবেঁকে উঠা ডালগুলো দেখলেই মনে হবে কোন পাইথন (অজগর) পেট ফুলিয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে।
এরই মাঝে অন্যরকমের অনুভুতি দিবে হরেক রকম পাখির কিচিরমিচির ডাক। টলটলে পানি কেটে গা দুলিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে চলছে আমাদের ডিঙ্গি। রাতারগুল জলাবনের দক্ষিণ দিকে আবার রয়েছে দুটি হাওর: শিমুল বিল হাওর ও নেওয়া বিল হাওর।
বর্ষাকালে আলাদাভাবে হাউরগুলো চিহ্নিত করা খুবই মুশকিল। উপচে পড়া জলরাশির মাঝে মনে হবে পুরো সিলেট হঠাৎ করে হাউর ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। জলমগ্ন বলে এই বনে সাপের আবাস বেশি। হয়তো নিজের অজান্তেই পা কামড়ে ধরে আছে জোঁকও।
শুকনো মৌসুমে বেজিও দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে বানর ও গুইসাপের আস্তানা। পাখির মধ্যে আছে সাদা বক, মাছরাঙা, টিয়ার দল, বুলবুলি, টুপ করে ডুব দেওয়া পানকৌড়ি ও ঘুঘু। শীতকালে রাতারগুলে আসে বালিহাঁস ও বিশালাকারের শকুন।
মাছের মধ্যে প্রধান আকর্ষণ বড় দাড়িওয়ালা বোয়াল মাছ। আছে টেংরা, পাবদা, মায়া, কালিবাউশ ও রুই। বনের মধ্যে প্রায় ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়। যার মধ্যে বড় গাছগুলো ১৫মিটার উপরে বিস্তৃত। বনের প্রায় ৮০ ভাগ এলাকা উদ্ভিদে আচ্ছাদিত।
গাছ-পালা আর ঝোপঝাড় পেরিয়ে হঠাৎ দেখা মিলবে খোলা আকাশের। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ছয় তলার সমান ওয়াচ টাওয়ার। এই টাওয়ার থেকে এক নজরেই পুরো রাতারগুল দেখা যায়। বর্ষায় এই টাওয়ারের কিছু অংশও পানির নিচে তলিয়ে যায়।
শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে মাটির রাস্তা তৈরি হয়। খাড়া টাওয়ারে উঠতে খানিকটা কষ্ট হলেও ওঠার পর চোখ জুড়ানো দৃশ্য মিলবে। এক নিমিষেই ভুলে যাবেন সকল কষ্ট। অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসবে ওয়াও। নীল আকাশ, পানি ও সবুজ প্রকৃতি মিলেমিশে অমরাবতীর সৌন্দর্য ধারণ করেছে।
চোখের দৃষ্টিসীমায় আটকে যাবে সবুজ, সবুজ আর সবুজ। এখান থেকেই সম্পূর্ণ রাতারগুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গোগ্রাসে গেলা যায়। তবে কিছুদিন আগে ওয়াচ টাওয়ারটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।
টাওয়ার থেকে নামতেই বেলা মাথার উপর থেকে খানিকটা পশ্চিমে ঢলেছে। এবার যে যেতেই হবে! দুপুরের খাওয়া দাওয়া অপেক্ষা করছে ডাঙায়। ভাসমান কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ীর দেখা পাবেন যারা নৌকায় করে বিস্কুট, চা, চা-পাতা, আচার, পানি সহ কিছু পণ্য বিক্রি করে।
শরীরকে চাঙ্গা রাখতে এক কাপ ধূপ উঠা চা পান করতে পারেন। এমন সময়ই ঝুপ করে আবার নামলো বৃষ্টি। এই বৃষ্টিকে মাথায় নিয়েই ফিরে আসতে হলো। দুপুরের খাবার খেয়েই পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটতে হবে। সময়ের তড়িঘড়িতে আমরাও মনটাকে বেঁধে বিরহের কষ্ট চেপে ফিরে এলাম ডাঙ্গায়।
কারো মুখে কোনো কথা নেই। স্বপ্নীল সময়গুলোর আবেশ হয়তো কাটেনি। পুরনো ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে এখনো বুঝতে পারি, আসলেই রাতারগুলের আবেশ এখনো কাটেনি।