মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২৯ অপরাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ২০২১ সালে বিএনপি জনগণের মাঝে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির বেশ ভালো প্রচেষ্টা চালালেও ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় কোনও প্রভাব ফেলার মতো কিছু করতে পারেনি। বিশ্লেষকদের মতে, খেলার ধরণ যেমন পাল্টেছে, বিএনপিকেও তেমনি পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হবে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আন্দোলন ছাড়াও, বিএনপির উচিত এখন এমন কিছু করা যাতে জনগণের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জনগণ একটি কঠিন আন্দোলন দেখতে চায়। বিএনপির এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজের মতে, বিএনপির উচিত প্রথমে নিজেদের দল গোছানো, এরপর ভবিষ্যতের জন্য কৌশল নির্ধারণ করা।
২০২১ সালে কোনো অর্জন নেই
২০২১ সালের প্রথম দিনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, তারা দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে পুরোপুরি মুক্ত করে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নতুন শপথ নিয়েছে। কিন্তু দলটি তাদের অঙ্গীকার রক্ষায় তেমন কিছু করতে পারেনি।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসাসহ অন্য আরও বেশ কিছু দাবিতে বিএনপি র্যালি, মানববন্ধনসহ অনেকগুলো কর্মসূচী পালন করেছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গত ৭ জানুয়ারি সারাদেশে মানববন্ধনের আয়োজন করে বিএনপি।এছাড়া একই ইস্যুতে বছরব্যাপী বিভিন্ন সময়ে সমাবেশ ও আলোচনা সভা করেছে দলটি।
এছাড়া ‘ব্যর্থতা’ স্বীকার করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পদত্যাগ এবং সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে গত ১০ জানুয়ারি ঢাকা ও অন্যান্য শহরে মানববন্ধন করে দলটি।
গত ১৬ জানুয়ারি পৌরসভা নির্বাচনে এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে (চসিক) এবং অন্যান্য কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিলেও বিপুল ভোটে হারে দলটি।
৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা হেরে যাওয়ার পর সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে দলটি ছয় বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজন করে।
৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কারাবন্দির তিন বছর হওয়ায় সারা দেশে তারা প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করে।
৭ মার্চ দলের নীতিনির্ধারকেরা বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
দেশের করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় গত ১ এপ্রিল থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি সব ধরনের রাজনৈতিক ও দলীয় কার্যক্রম প্রত্যাহার করে। এই দীর্ঘ সময়ে দলটি অনলাইনে বিভিন্ন আলোচনা সভা ও সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলের ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তৃণমূলের নেতাদের সিরিজ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয় থেকে বর্ণাঢ্য এক র্যালি বের করে। দলের অনেক নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের করা এই র্যালি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে বিদেশে খালেদার চিকিৎসার দাবিতে মানববন্ধন, প্রতীকী অনশন, জেলা প্রশাসকদের বরাবর স্মারকলিপি জমা, সমাবেশ ও বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
একই দাবিতে ২২ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় ৩২টি সমাবেশ করেছে দলটি।বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশিরভাগ রাজনৈতিক সমাবেশে জনগণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।
নেতাদের হারিয়েছে
গত বছরে বিএনপি তাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক এমপি ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খানসহ অনেক নেতাকে হারিয়েছে।
দল পুনর্গঠন
সারা বছর ধরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি অন্যান্য আন্দোলনের জন্য বিএনপি মূলত তাদের দল পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, ২০২১ সালে ৮১টির মধ্যে ৩০টি সাংগঠনিক জেলা ইউনিটের নতুন কমিটি গঠন করেছে দলটি। এছাড়া দলটির উপজেলা, পৌরসভা ও থানা ইউনিটের তিন শতাধিক ইউনিট পুনর্গঠন করেছে।
২ আগস্ট নতুন করে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে বিএনপি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইউনিট- ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণকে পুনর্গঠন করে।
এছাড়া ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলসহ বিএনপির বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন তৃণমূল পর্যায়ে তাদের বিভিন্ন ইউনিটের নতুন কমিটি করেছে।
দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া মন্তব্য করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে আমরা পার্টি পুনর্গঠন করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম।করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আমরা অনেক জেলা ইউনিটের নতুন কমিটি গঠন করেছি।বাকি জেলা ইউনিটগুলো শিগগিরই পুনর্গঠন করা হবে।’
তিনি বলেন, বাকি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও থানার তৃণমূল কমিটি গঠন ত্বরান্বিত করার জন্য জেলা নেতাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপি অনেক নেতার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান এবং পদ ও দল থেকে অপসারণসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে।
খালেদা জিয়ার জন্য দুর্যোগের বছর
৭৬ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা ২০২১ সালের বহুল আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি ছিল। কারণ তিনি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সনকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য তার পরিবারের একটি আবেদন এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
খালেদা গত ১০ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হন এবং ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িতে চিকিৎসা নেন। তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাকে ২৭ এপ্রিল রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর অনুমতি চেয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে ৬ মে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়, কিন্তু সরকার তা নাকচ করা হয়।
২০২১ সালের ১৯ জুন বিএনপি চেয়ারপার্সন করোনা সংক্রমণ এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতার জন্য ৫৩ দিন চিকিৎসার পরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যান।
এরপর গত ১২ নভেম্বর জ্বর ও অন্যান্য কিছু স্বাস্থ্য জটিলতায় খালেদা জিয়াকে দ্বিতীয়বার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পর গত ১৩ নভেম্বর তাকে একই হাসপাতালে পুনরায় ভর্তি করা হয়। ২৮ নভেম্বর তার মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছে।
তারা বলেন, খালেদা জিয়া অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে ভুগছেন এবং চিকিৎসার জন্য তাকে অবিলম্বে বিদেশে যেতে হবে।
চিকিৎসকরা আরও জানিয়েছেন, তিনি রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, চোখ ও দাঁতের জটিলতায় ভুগছেন।
তার পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দার চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে ১১ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন।
খালেদার মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানান, লিভার সিরোসিসের কারণে নিয়মিত রক্তক্ষরণে ভুগছেন বলে তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন।
দেশে খালেদার লিভার সিরোসিস সমস্যার চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় অবিলম্বে বিদেশের কোনো উন্নত কেন্দ্রে যেতে না দিলে যেকোনো সময় খারাপ কিছু ঘটতে পারে বলে জানান তিনি।
যেতে হবে বহু দূর
বিএনপির রাজনৈতিক পারফরম্যান্স সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক আলী রিয়াজ ইউএনবিকে বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা না করে ২০২১ সালে বিএনপির ভূমিকা এবং তার প্রচেষ্টাকে মূল্যায়ন করা উচিত নয়।
তিনি বলেন, ‘সারা বছর ধরে আমাদের দেশ আরও কর্তৃত্ববাদী ও অ-রাজনীতিকরণের দিকে ধাবিত হয়েছে। ২০২১ সালে বিএনপি তার বিগত বছরের টিকে থাকার কৌশল থেকে সরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত দলকে অক্ষত রাখতে সফল হয়েছে দলটি এটিও একটি কৃতিত্ব, তবে সফল হতে এখনও বহূ দূর যেতে হবে।’
আলী রিয়াজ বলেন, বিএনপি আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারবে কি না তা নির্ভর করছে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে কি না তার ওপর।
তিনি বলেন, শুধু ২০২৩ সালের নির্বাচন নয়, দেশে বহুত্ববাদী রাজনীতি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিএনপি নেতৃত্বকে তাদের ভূমিকা বুঝতে হবে।
আলী রিয়াজ বলেন, চ্যালেঞ্জ শুধু বিএনপিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা নয়, নাগরিকদের অধিকার ফিরিয়ে আনা।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, নেতৃত্বের সঙ্কট, তাদের ভুল নীতি ও রাজনৈতিক দূরদর্শীতার অভাবে বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে এবং প্রত্যাবর্তন বা খালেদাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার জন্য সরকারের উপর সত্যিকারের চাপ সৃষ্টি করতে শক্তি জোগাড় করতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, নির্দলীয় প্রশাসন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য বিএনপিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।