রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট: বর্তমানে বাংলাদেশ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করছে। এটা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। এ কারণে আগামী বাজেটেও করোনা পরিস্থিতি উত্তরণের একটি সুনিদিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও বাজেটে গুরুত্ব দিতে হবে। গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই),দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল ২৪ যৌথভাবে আয়োজিত ওয়েবিনারে ‘প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা ও ব্যবসায়ীরা এ দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এবং ব্র্যাক-এর চেয়ারপার্সন ড. হোসেন জিলুর রহমান অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন।
ড. মসিউর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে এবং এটিকে সকল জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, শুল্ক বা করের হার গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে না থাকলে, তা ব্যবসা-বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে। তিনি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত না করে কি হারে রাজস্ব বাড়ানো যায় তার একটি দিক-নির্দেশনা সরকারকে প্রদানের আহŸান জানান। উপদেষ্টা বলেন, ৭-১০ বছরের জন্য একটি টেকসই ও সহনশীল কর কাঠামো দেশে বিনিয়োগ সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া তিনি দেশের জিডিপিতে করের অবদান বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন এবং বিভিন্ন খাত কে বিভিন্ন হারের কর অব্যাহতি দেয়ার কারণে জিডিপিতে করের অবদান কমছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি উলেখ করেন, ট্যাক্সের হার নির্ধারণ ও সরকারের ব্যয়ের বিষয়ে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে, সেই সাথে নাগরিকদের উপর আরোপিত ট্যাক্স সেই নাগরিকের নিকট গ্রহণযোগ্য কিনা সেবিষয়ে নজর দেয়া প্রয়োজন। উপদেষ্টা আরো বলেন, বিভিন্ন পর্যায়ে মূসক আদায়ের ফলে অনেক ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে এর হার বেড়ে যায়। সেই সাথে ঘন ঘন করের হার বাড়ানো-কমানো ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন।
ড. হোসেন জিলুর রহমান বলেন, বাজেট শুধুমাত্র কর আহরণের বিষয় নয়, এটি সরকারের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের একটি রপরেখা। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করছি, যেটা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে এবং বাজেটে করোনা পরিস্থিতি উত্তরণের একটি সুনিদিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে, সেই সাথে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টিও বাজেটে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, দেশের এসএমই খাত কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে এবং এসএমই খাতের জন্য আর্থিক সহায়তা নিশ্চিতকল্পে মাইক্রো ফাইন্যান্স ইন্সটিটিউট (এমএফআই) গুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে এবং প্রণোদনা প্যাকেজ কিভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের নিকট পৌঁছানো যায়, সে লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স এর পর আমাদের প্রবৃদ্ধির নিয়ামকগুলো কি হবে, সেগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। সেই সাথে তিনি দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে আমাদের একটি যুগান্তকারী পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন, যেখানে সরকার ও বেসরকারিখাত একযোগে কাজ করার আহŸান জানান। তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য খাত নিয়েও চিন্তা করতে হবে এবং বিশেষ করে গ্রামীণ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ খুবই জরুরি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, সরকার ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব ব্যবস্থা, শিল্পায়নের বিকাশ এবং উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে যেতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। করোনা পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব বিবেচনায় বেসরকারিখাতের প্রত্যাশা পূরণে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ যেমন; আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর, আর্থিক খাত, শিল্প ও বাণিজ্য এবং জ্বালানি, যোগাযোগ ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাত প্রভৃতি খাত সমূহকে বাজেটে গুরুত্ব প্রদান করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
ওয়েবিনারে ৪টি খাতের উপর সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেতাদের মতামত প্রদান করেন। ‘আর্থিক খাত’ সেশনের আলোচনায় আইপিডিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ-এর সিইও নাসের এজাজ বিজয়, নগদ-এর সিইও রাহেল আহমেদ এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম অংশগ্রহণ করেন। মমিনুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে বন্ড মার্কেট উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের জন্য ব্যাংকের উপর চাপ কমানো সম্ভব হবে।
নাসের এজাজ বিজয় বলেন, এসএমইদের ঋণ সহায়তা পেতে হলে একটি স্কিম থাকা প্রয়োজন। তিনি ভূমির মৌজা ভ্যালু কমানোর প্রস্তাব করেন, সেই সাথে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য সহায়তা আরো বাড়ানো আহŸান জানান।
রাহেল আহমেদ বলেন, ডিজিটাল লেনদেন কার্যক্রমে প্রণোদনা দিতে হবে এবং ডিজিটাল লেনদেনে মোবাইল অপারেটরদের যে চার্জ আছে তা কমানো প্রয়োজন, সেই সাথে স্মার্ট ফোন আমদানি ও উৎপাদনে কর অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করেন।
আসিফ ইব্রাহীম বলেন,তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমানো প্রয়োজন এবং লিস্টেড কোম্পানির কর্পোরেট কর হার কমানো প্রয়োজন। তিনি এসএমই কোম্পানি সমূহকে স্টক মার্কেটে আসার জন্য তালিকাভুক্ত হওয়ার ৫ বছর পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে কর সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করেন। ‘শিল্প ও বাণিজ্য’ সেশনের আলোচনায় বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ওনার্স এসোসিয়েশন’র সভাপতি কাজী ইনাম আহমেদ, বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হক, বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ-এর ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ড. মো. মাসুদুর রহমান অংশগ্রহণ করেন।
কাজী ইনাম আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০০টির মত সুপারশপ রয়েছে। করোনো পরিস্থিতিতেও সুপারশপ সমূহ নির্ধারিত মূল্যে পণ্য প্রদান করছে এবং অসংখ্য তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি রয়েছে। সুপার মার্কেটের পণ্যের উপর ৫% হারে ভ্যাট আরোপের ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অনেক সুপার শপ বন্ধ হয়ে গেছে।
মো. ফজলুল হক বলেন, গার্মেন্টে খাতে সবুজ কারখানা বাংলাদেশে পৃথিবীতে আলোড়ন তৈরি করছে, তবে ইটিপি স্থাপনে প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও কেমিক্যাল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে যা অব্যাহতি প্রদান করা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির জন্য বাজেটে পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন এবং করোনো মোকাবিলায় প্রণোদনার প্যাকেজের ঋণের টাকা ফেরতের সময়সীমা বাড়ানো প্রয়োজন।
মো. জসিম উদ্দিন বলেন, করোনো মোকাবিলায় সকল শিল্পখাতের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ সুবিধা অব্যাহত থাকা প্রয়োজন, সেই সাথে বিশেষকরে কুটির শিল্পের জন্য ভ্যাট ও ট্যাক্স সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে বাজেটে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন। মুক্ত আলোচনায় বিল্ড-এর চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান বলেন, আমরা বর্তমানে মহাসংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, এ অবস্থায় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে চাহিদা ধরে রাখা প্রয়োজন। তিনি শিল্পখাতে গবেষণা কাজেব্যবহৃত বরাদ্দ কে কর অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব করেন। এছাড়া উত্তরা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর চেয়ারম্যান মাতিউর রহমান আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, করোনা মহামারির কারণে সংবাদপত্র মারাতœক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি উলেখ করেন, সংবাদপত্র শিল্প প্রায় ৩৭ শতাংশ কর দিয়ে থাকে, যার মধ্যে কর্পোরেট কর সাড়ে ৩২.৫ শতাংশ এবং নিউজ প্রিন্ট আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ । তিনি নিউজপেপার আমদানি শুল্ক শূন্য হারে নামিয়ে আনার আহŸান জানান। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারা চলমান বজায়ে রাখার লক্ষ্যে আগামীতে এ ধরনের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।