শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৪৮ পূর্বাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানকে বলা হয় জীববৈচিত্র্যের আধার। ১ হাজার ২৫০ হেক্টরের এ বনে রয়েছে বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী। দেশের মধ্যে শুধু এখানেই রয়েছে আফ্রিকান টিকওক গাছ। আছে বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন চীনা বনরুইসহ অনেক বিপন্ন প্রাণী।
তবে অব্যবস্থাপনা, বনের জমি দখল, অপরিকল্পিত পর্যটনকেন্দ্র, বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়ক ও রেলপথের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে এখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ বনটিই হুমকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
বিরল উদ্ভিদ ও মহাবিপন্ন প্রাণীর আভাস
লাউয়াছড়া বনে রয়েছে বিশ্বব্যাপী মহাবিপন্ন অনেক প্রাণী। এর মধ্যে অন্যতম চশমাপরা হনুমান ও বনরুই। যুক্তরাষ্ট্রের ডেল্টা স্টেট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. এ এইচ এম আলি রেজা ২০১০ সালে লাউয়াছড়ায় গবেষণা চালিয়ে ৪৫ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১৫ প্রজাতির উভচর প্রাণীর সন্ধান পান।
এরপর ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এখানে গবেষণা চালায় ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স নামের একটি সংগঠন। বন বিভাগের সহযোগিতায় এ গবেষণায় লাউয়াছড়ায় ৫১ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২০ প্রজাতির উভচর প্রাণী পাওয়া যায়। নতুন পাওয়া এই ১১ প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব বাংলাদেশেই নতুন বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
সবশেষ গবেষণা দলের প্রধান শাহারিয়ার রহমান সিজার বলেন, ‘আমরা বনে নতুন অনেক প্রাণী পেয়েছি। দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রতিটি প্রজাতিকে স্বচক্ষে দেখে, যাবতীয় তথ্য নিয়ে আলাদাভাবে শনাক্ত করেছি।’
তিনি জানান, লাউয়াছড়ায় উভচর প্রাণীদের মধ্যে ১৯ প্রজাতির ব্যাঙ ও এক প্রজাতির সিসিলিয়ান জাতীয় প্রাণী পাওয়া গেছে। আর সরীসৃপ শ্রেণির মধ্যে পাওয়া গেছে ২ প্রজাতির কচ্ছপ, ১৪ প্রজাতির টিকটিকিজাতীয় (২ প্রজাতির গুইসাপসহ) এবং ৩৫ প্রজাতির সাপ। এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে রাজগোখরা, অজগর ও পাহাড়ি হলুদ কচ্ছপ ইতোমধ্যে মহাবিপন্ন বা বিপন্ন তালিকায় রয়েছে।
অন্যদিকে চিকিলা, বাইবুন গেছো ব্যাঙ, বিথের সাপের মতো প্রজাতিও লাউয়াছড়ায় পাওয়া গেছে। এগুলো প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের (আইইউসিএন) লাল তালিকায় রয়েছে।
বানর গবেষক তানভির আহমেদ জানান, বাংলাদেশের মোট ১০ প্রজাতির বানরের মধ্যে ছয় প্রজাতিই লাউয়াছড়া বনে পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লুক, চশমাপরা হনুমান ও লজ্জাবতী বানর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা পৃথিবীব্যাপী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রায় ৪০টি উল্লুক এবং কমপক্ষে ১২৯টি চশমাপরা হনুমান রয়েছে। লজ্জাবতী বানরও রয়েছে অনেক। লাউয়াছড়ার মতো ছোট বনে যতগুলো বানরজাতীয় প্রাণী রয়েছে, দেশের অন্য অনেক বনেই তা নেই।’
এ ছাড়া এই বনে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। এর মধ্যে আফ্রিকান টিকওক গাছ দেশের মধ্যে শুধু এই বনেই পাওয়া যায়।
জানা গেছে, ১৯৩০ সালে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা লাউয়াছড়ায় টিকওক গাছের কয়েকটি চারা রোপণ করেন। এর মধ্যে দুটি গাছ টিকে ছিল। ২০০৬ সালে একটি গাছ ঝড়ে উপড়ে যায়। বর্তমানে জীবিত থাকা গাছটির উচ্চতা ১৫০ ফুট উঁচু।
আফ্রিকান টিকওক গাছের কাঠ ড্রামস ও কফিন বানাতে ব্যবহৃত হয়। ভেষজ ঔষধি গাছ হিসেবে আফ্রিকায় এর পাতা ও বাকলের ব্যবহার রয়েছে। এ গাছের কষ এক ধরনের অ্যান্টি-টিউমার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে।
গবেষক রফিকুল হায়দার বলেন, ‘টিকওক খুবই বিরল প্রজাতির গাছ। এটি অনেক উপকারী। আমি গাছের টিস্যু সংগ্রহ করেছি। টিস্যু থেকে চারা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
হারিয়ে যাচ্ছে
লাউয়াছড়ায় একদিকে যেমন নতুন প্রজাতির প্রাণীর সন্ধান পাওয়া গেছে, অন্যদিকে পুরোনো অনেক প্রজাতি হারিয়েও গেছে।
গবেষকরা জানান, উদ্যানের ভেতরের ছড়া এবং ঝিরিপথগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ঝিরিপথ দিয়ে আশপাশের বিভিন্ন চা বাগানে ব্যবহৃত কীটনাশক এসে মিশে যায়। ফলে এখানকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রায় পাঁচ বছর ধরে লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজ করছেন হাসান আল-রাজী ও মার্জান মারিয়া দম্পতি। তারা জানান, বনের ভেতরের ছড়া ও ঝিরিগুলো শুকিয়ে যাওয়ার কারণে অনেক প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে, বিশেষত পানির ওপর নির্ভরশীল প্রাণীগুলো।
তারা বলেন, চা বাগানের কীটনাশকের কারণেও অনেক ছোট কীটপতঙ্গ হারিয়ে গেছে। বনের মধ্যে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রাণীদের আবাসস্থল নষ্ট হয়েছে, তাতে আগামী ১০-১৫ বছরে বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আবাসন ও খাদ্যসংকট
অব্যাহতভাবে দখলের কারণে লাউয়াছড়ায় কমছে বনের জমি। অন্যদিকে গাছ চুরির কারণেও কমে আসছে বনাঞ্চলের পরিমাণ। গাছ কমায় বন্যপ্রাণীদের আবাসন ও খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। যার কারণে প্রায়ই লোকালয়ে চলে আসে বন্যপ্রাণী। এ ছাড়া বন্যপ্রাণী শিকারের ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। এর মধ্যে হরিণ এবং শূকর শিকারের ঘটনাই বেশি ঘটে।
শ্রীমঙ্গলের বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন পরিচালক সজল দেব বলেন, ‘লাউয়াছড়ার আশপাশের লোকালয় থেকে গত ১০ বছরে আমরা ৪৫০টি প্রাণী উদ্ধার করেছি। মূলত খাদ্যসংকটের কারণেই প্রাণীগুলো বন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে।’
গবেষক সাবিত হাসান বলেন, ‘লাউয়াছড়া উদ্যানে বেশ কিছু কেব্লের ফাঁদ দেখেছি, যেগুলো মোটরসাইকেলের ব্রেক এবং ক্লাস দিয়ে তৈরি। এগুলো দিয়ে মূলত হরিণ ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয়। কোনো প্রাণী পানি খাওয়ার জন্য গেলে সেই ফাঁদে আটকা পড়ে।’
লাউয়াছড়া বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক সামছুল হক বলেন, ‘লাউয়াছড়ার আশপাশে বনভূমি এবং চা বাগান থাকায় প্রায়ই বন্যপ্রাণীরা এসব এলাকায় যায়; যেখানে শিকারিরা ফাঁদ পেতে রাখে। বিশেষ করে ডলুছড়া, ছনকলা, ফুলবাড়িয়া চাবাগান এলাকায় শিকার বেশি হয়ে হয়।’
তা বন্ধ না করতে পারলে লাউয়াছড়ার অস্তিত্বই সংকটে পড়তে পারে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুনতাসির আকাশ। ‘থাইল্যান্ডে আমাদের চেয়ে কয়েক গুণ সমৃদ্ধ একটি বন ছিল। কিন্তু শুধু কেবল দিয়ে শিকার করার কারণে সেই বনে এখন প্রাণী নেই। লাউয়াছড়ায় একই কাজ করা হচ্ছে।’
মৃত্যুফাঁদ সড়ক-রেলপথ
লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে গেছে সাড়ে ছয় কিলোমিটারের সড়কপথ। এ ছাড়া রেলপথ রয়েছে প্রায় আট কিলোমিটার। এই দুই পথে প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে প্রাণী।
স্থানীয়রা জানান, চলাচলের সময় হঠাৎ করে সামনে চলে আসা যানবাহনের আলোয় প্রাণীরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তখন দ্রুতগামী গাড়ির ধাক্কায় অনেক প্রাণী মারা যায়। বনের ভেতর থেকে সড়ক ও রেলপথ সরানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানো হলেও তা বাস্তবায়নের দেখা নেই।
হুমকির মুখে লাউয়াছড়ার ক্ষুদ্র প্রাণিকুল
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘আমরা বনের ভেতরের সড়ক বন্ধ করার দাবি জানিয়েছিলাম, অথচ এই সড়ককে আরও বড় করা হয়েছে। ফলে গাড়ির গতি বেড়েছে। এতে প্রাণী মৃত্যুর হার বেড়েছে।’
সড়ক ও রেলপথে প্রতিদিন কী পরিমাণ প্রাণী মারা যায় এ নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো গবেষণা নেই। তবে পুরোনো কিছু গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন অন্তত তিনটি প্রাণী মারা যায়। এর মধ্যে বেশির ভাগই সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী।
লাউয়াছড়ায় সড়ক ও রেলপথে প্রাণীর মৃত্যু নিয়ে গবেষণা করে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স। তাদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হয় ২০১৩ সালে। ১৪ মাসে তারা লাউয়াছড়ার ৫০৩টি প্রাণীর মরদেহ খুঁজে পায়। যেগুলো প্রাণ হারিয়েছে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়।
এই দলের গবেষক শাহারিয়ার সিজার বলেন, ‘মৃত প্রাণীর বেশির ভাগেরই দেহ পাওয়া যায় না, কারণ শিয়ালসহ কিছু প্রাণী মরদেহগুলো খেয়ে ফেলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণা সাত বছর আগে হলেও এখনও সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এখনও প্রতিদিন গড়ে তিনটি প্রাণী মারা যাচ্ছে সড়ক ও রেলপথে।’
২০১৭-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীরা একই বিষয়ে একটি গবেষণা করেন। সেই দলের সদস্য মো. সালাহউদ্দীন বলেন, ‘আমরা এক দিনেই বনে ১৬৫টি প্রাণীর মরদেহ খুঁজে পেয়েছি।’
প্রাণীর মৃত্যুরোধে লাউয়াছড়ার বাইরে দিয়ে বিকল্প সড়ক ও রেলপথ তৈরির প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে বন্যপ্রাণী গবেষক তানভির আহমেদ বলেন, ‘তার আগে সড়কে ঘন স্পিড ব্রেকার তৈরি করতে হবে। রেললাইনের ওপর রশি দিয়ে তৈরি করা সেতুর কার্যকারিতাও পরীক্ষা করতে হবে।’
হুমকির মুখে লাউয়াছড়ার ক্ষুদ্র প্রাণিকুল
পর্যটকও যখন সমস্যা
লাউয়াছড়ার নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে পর্যটন। ১৯৯৬ সালে এটিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর থেকেই এখানে পর্যটক সমাগম বেড়েছে। দিনে পাঁচ হাজারের অধিক পর্যটকও ঢুকছেন বনটিতে। পর্যটকদের চাপেও বন ছেড়ে পালাচ্ছে প্রাণী। এ ছাড়া উদ্যানের আশপাশে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রিসোর্টের উচ্চশব্দের কারণেও হুমকিতে পড়েছে এখানকার প্রাণীগুলো।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘উচ্চশব্দ ও আতঙ্কের কারণে বন্যপ্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়। অতিমাত্রায় পর্যটকদের উপস্থিতির কারণেও অনেক প্রাণী বন ছেড়ে চলে যায়।’
কী ভাবছে বন বিভাগ
উদ্যানে দুর্ঘটনায় প্রাণীর মৃত্যু ও শিকার ঠেকাতে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন বিভাগীয় বন র্কমকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা গাছ চুরির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। লাউয়াছড়া এবং আশপাশে মারা যাওয়া প্রাণীর ডাটাবেস সংরক্ষণ শুরু করেছি। লাউয়াছড়ার গেটে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছি।
‘পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট সীমানা করে দিতে এবং উদ্যানের ভেতর থেকে পর্যটন স্থান একপাশে সরিয়ে নিতে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। পর্যটকের চাপ কমিয়ে তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনারও চেষ্টা চলছে।’
এই বন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বনের ভেতর থেকে সড়ক সরানো এবং ট্রেনের গতি সীমিত করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বনের উভয় পাশে দুটি চেকপোস্ট বসবে, যাতে বনের ভেতর গাড়ি প্রবেশ করলে তার গতি নিয়ন্ত্রিত থাকে।’