শুক্রবার, ২১ মার্চ ২০২৫, ০৪:২১ পূর্বাহ্ন
আফতাব চৌধুরী: রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। এক বছরে মানুষের শরীরে যে বাড়তি মেদ বা বিষাক্ত পদার্থ জমে ওঠে, রমজানের ১ মাসে সারাদিন উপবাস থাকার কারণে তা পুড়ে গিয়ে শরীরকে রক্ষা করে। রমজানের রোজা মনের কু প্রবৃত্তি গুলোকে নিবৃত করে মনে ও প্রাণে পবিত্রতার ভাব এনে দেয়।
সিয়াম বা রোজা হচ্ছে আধ্যাত্মিক জেহাদ। এ রমজান মাস বিশ্ব মানবের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। কারণ প্রায় সকল আসমানী কিতাব এ মাসে নাজিল হয়েছে। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর উপর ১০ই রমজান নাজিল হয় “ছহিফা”, হযরত দাউদ (আঃ) এর উপর ১৮ই রমজান নাজিল হয় “যবুর”, হযরত মুসা (আঃ) এর উপর ৬ই রমজান নাজিল হয় “তৌরাত”, হযরত ঈসা (আঃ) এর উপর ১৩ই রমজান নাজিল হয় ইঞ্জিল এবং রমজানের ২৭ তারিখ রাতে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর উপর নাজিল হয় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল ক্বোরআন। এছাড়া এ মাসে রয়েছে “লাইলাতুল কদর” অর্থাৎ এ রাতের এবাদত হাজার মাসের এবাদত হতে উত্তম। পবিত্র হাদিসে আছে, “রোজা ঢাল স্বরূপ।” আল্লাহ পাক রোজা পালনের জন্য মোমিন মুসলমানদের বার বার তাগিদ দিয়েছেন। তাই মাহে রমজান আতœশুদ্ধি, আল্লাহ পাকের অসীম করুণা ও শুভ প্রতিফল লাভের এক অতুলনীয় সুযোগ।
রোজা রাখার ব্যাপার অনেকটা হৃদয় ঘটিত ব্যাপার অর্থাৎ তাকওয়া রোজার ভিত্তি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আজকাল অনেক পূর্ণবয়স্ক পুরুষ-মহিলা নানা অজুহাতে রোজা পালন থেকে বিরত থাকে। অথচ অনেক পরিবার আছে যেসব পরিবারে ৮/৯ বছরের ছেলে মেয়েকে রোজা রাখতে দেখা যায়। এটি মনের টান ও আল্লাহর গজবের ভয়ে সম্ভব হয়। ইসলাম এমন এক ধর্ম যার প্রতিটি কর্ম, প্রতিটি এবাদত বন্দেগীর মধ্যে সার্বজনীন কল্যাণ নিহিত।
আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা রোজার গুরুত্ব যে কত ব্যাপক তা প্রমাণিত হয়েছে। যারা গ্যাস্ট্রিক বা আলসারের কারণে রোজা থেকে বিরত থাকেন, বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান কিন্তু তার বিপরীতে মতামত ব্যক্ত করেছে। ডাক্তার ও অভিজ্ঞদের মত, পেপটিক আলসার রোজার উপবাসের কারণে তাড়াতাড়ি ভাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রোজার উপবাসের কারণে লিভারে প্লীহা, কিডনী, মূত্রথলি পূর্ণ বিশ্রাম পায়। রক্ত প্রবাহ, স্নায়ু, রক্ত সঞ্চালন ও দেহের গ্রন্থি সমূহের উপর রোজার সুফল ও প্রতিক্রিয়া সর্বাধিক। ডায়াবেটিস নিরাময়ে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম, অতুলনীয়। মোট কথা স্বাস্থ্য রক্ষায় রোজার ভূমিকা ও উপকারিতা অপরিসীম, অতুলনীয়।
এদিকে রোজার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তারাবীর নামাজ খাদ্য হজম করার পক্ষে বেশ সহায়ক। তেমনিভাবে সেহরীর খাবারের পর তাহাজ্জোদ ও ফজরের নামাজ আদায় করা খাদ্য দ্রব্য হজম করার পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এভাবে রোজা ও নামাজ দুই-ই একে অপরকে পরিপূর্ণতা দান করেছে। তাই আল্লাহপাক প্রত্যেক গৃহবাসী নরনারীর জন্য রোজা ফরজ বা অবশ্য পালনীয় করেছেন।
এদিকে ইসলামের পঞ্চম ভিত্তির অন্যতম হলো যাকাত। যাকাত আদায় করা প্রত্যেক বিত্তশালী মুসলমানের জন্য অবশ্য ফরজ করা হয়েছে। ইসলামের মৌলিক নীতিতে আছে ধন সম্পদ সঞ্চয় করে রাখা হারাম। এ প্রসঙ্গে ক্বোরআন শরীফে আছে যারা খোদা প্রদত্ত অনুগ্রহে কৃপণতা করে তারা যেন তাদের এ কাজ তাদের জন্য অত্যন্তমঙ্গলজনক মনে না করে বরং তা তাদের জন্য খুব খারাপ। ইসলামের মৌলিক নীতিতে আছে অর্থ বিনিয়োগের নির্দেশ। এছাড়া তাদের ধন সম্পত্তিতে সকল প্রাণী ও অভাবী লোকদের অধিকার রয়েছে। এ কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে। ইসলামে কিন্তু ধন উপার্জনে কোন বাঁধা নেই তবে তা কুক্ষিগত করে রাখার কোন উপায় নেই। ইসলামী জীবন বিধানে এটি একটি অবাস্তব ব্যাপার। এদিকে ধন সম্পদ বৃদ্ধির লোভে মালামাল মজুদ করে সাময়িক অভাব সৃষ্টি করা ইসলামে হারাম। ধনীদের দান ছদকা করা এবং যাকাত আদায় করার ফলে অতিরিক্ত টাকা তাদের হাত হতে জনসাধারণের মধ্যে চলে আসে। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে। এ যাকাত ব্যবস্থাকে তাই ঝর্ণা ও বৃষ্টি ধারার সঙ্গে তুলনা করা চলে। সাগরের পানি বৃষ্টি রূপে নেমে যেমন মৃত প্রায় ধরণীতে আনে নূতন জীবন, ঠিক তেমনি ধনীদের জাকাতের টাকা পয়সা গরীবদের মধ্যে নিয়ে আসে নূতন জীবন, সজীবতা। আনে তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা। তাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ধনীর উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রিত হয়ে পুণরায় সে টাকা ধনীর তহবিলে ফিরে আসে। এতে সাগর বা নদীর পানি বা বিলের মাছের মতো এ হাত থেকে ও হাতে ধনী হতে গরীব আবার গরীব হতে ধনীর হাতে ফিরে যায়। এক হাতে জমা থাকে না। এতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্থবিরতা কেটে গিয়ে সচলতা আসে, গতিশীলতা বাড়ায়।
যাকাত প্রদানের ফলে ধন সম্পদ জাতির প্রত্যেক ব্যক্তি পর্যন্তপৌঁছে। এর ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে সকলের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পায়, ক্ষেত খামার শস্য শ্যামলায় ভরে উঠে, যেমন খাল-বিল-নালা মাছে থাকে পরিপূর্ণ। ব্যবসা বাণিজ্যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। ইসলামের এক একটি বিধানে কিভাবে না মানব কল্যাণ নিহিত, তা পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাই অকপটে বলা যায় ইসলামী নির্দেশ চিন্তা চেতনাগুলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূরীকরণে সহায়ক। এটি সত্য এবং বাস্তব।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।