শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৬ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট :: প্রতিদিন না চাইতেই পাওয়া যায় জগতে এমন যা কিছু আছে তার একটি হলো সূর্যের আলো। গরমের দেশ বাংলাদেশে সূর্যের আলো প্রচুর মেলে। সূর্যের আলোতে গরম লাগে এখানে এভাবেই হয়ত অনেকে ভাবেন।
কিন্তু শীতের দেশে একটু সূর্যের আলো দেখার অপেক্ষায় থাকেন অনেক মানুষ। সূর্যের আলো মানুষের শরীরের বহু উপকার করে। বিশেষ করে দিনের শুরুর দিকে, যখন আলো ততটা তেতে ওঠেনি। সূর্যের আলো মানুষের শরীরের কিছু ক্ষতিও করে।
ভিটামিন ডি তৈরিতে সাহায্য করে
সূর্যের আলো নিয়ে কথা বলতে গেলে শুরুতেই চলে আসে ভিটামিন ডির কথা, বলছিলেন ইউনাইটেড হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন বিষয়ে সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. কানিজ মাওলা। তার ভাষায় ভিটামিন ডি হচ্ছে ‘ম্যাজিক মেডিসিন’।
‘বেশিরভাগ ভিটামিন শরীরে পেতে হলে আপনাকে পয়সা খরচ করতে হবে। অর্থাৎ নানা রকম খাবার কিনে খেতে হবে, তারপর শরীরে ভিটামিনের যোগান পাবেন। কিন্তু ভিটামিন ডি পাবেন একদম বিনামূল্যে যদি আপনি নিয়মিত সূর্যের আলোতে যান। খাবার দিয়ে শরীরের ভিটামিন ডি’র চাহিদা পূরণ হয় খুব কমই। এই জাদুর বটিকা মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং সূর্যের আলো ছাড়া মানুষের শরীর ভিটামিন ডি প্রস্তুত করতে পারে না’, বলছিলেন ডা. কানিজ মাওলা।
তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন এটি একটি চক্রের মতো। মানুষের ত্বকের নিচে এক ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। সূর্যের আলোতে গেলে তা ভিটামিন ডি তৈরি করে। ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম তৈরি করে তা ব্যবহারে শরীরকে সহায়তা করে। হাড়, দাঁত, নখের সুরক্ষায় দরকার ক্যালসিয়াম। এই প্রক্রিয়ার শুরু সূর্যের আলোর সাথে ত্বকের সংস্পর্শের মাধ্যমে।
ভিটামিন ডি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরকে সহায়তা করে। এটি পর্যাপ্ত না পেলে শিশুদের পায়ের হাড় বেঁকে যাওয়া রোগ রিকেট হতে পারে। বয়স্কদের হাড় দুর্বল করে দেয় এমন রোগ অস্টিওম্যালাসিয়া প্রতিরোধে সহায়তা করে। একই ভিটামিন শরীরের ফসফেট নিয়ন্ত্রণ করে। সুস্থ পেশির জন্যেও এটি দরকার।
তিনি বলেন, ‘আজকাল শহরের মানুষজন চাকরি করে সারাদিন অফিসে থাকে, বাচ্চারা স্কুল কোচিং-এ থাকে। তাদের মাঠে খেলার সুযোগ আগের মতো নেই। তাই গায়ে সূর্যের আলো কম লাগে। আমি জোর গলায় বলতে পারি মানুষের শরীরে এখন ভিটামিন ডি কম। যে ভিটামিন ডি এত কাজে আসে সেটি পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই নিয়মিত সূর্যের আলোতে যেতেই হবে।’
মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দীন আহমদ বলছিলেন, মানুষের মন মেজাজ ভালো থাকার জন্য এবং ভালো ঘুমের জন্য সূর্যের আলো খুব প্রয়োজন।
তিনি বলছেন, সূর্যের আলোর সাথে হিসেব করে ঘড়ির কাটা চলে। আর আমাদের শরীরের যে ঘড়ি আছে সেটির কাটা নিয়ন্ত্রণ করে সূর্যের আলো। এই আলো আমাদের ঘুম পাড়ায় এবং জাগিয়ে তোলে।
সূর্যের আলো এবং অন্ধকার মানুষের শরীরে কিছু হরমোন তৈরি করতে ও তা নিঃসরণে সহায়তা করে। মানুষের ত্বকে সূর্যের আলো পড়লে মেলানিন নামে একটি রাসায়নিক তৈরি হয়। মানুষের ঘুমের জন্য প্রয়োজন যে হরমোন সেটি হচ্ছে মেলাটোনিন। সেটি তৈরিতে এই মেলানিন প্রয়োজন।
অন্যদিকে যখন সূর্যের আলো চলে যায় তখন মানুষের শরীর মেলাটোনিন হরমোনটি নিঃসৃত হয়। তখন আমাদের ঘুম পায়। এভাবেই মানুষের ঘুমের চক্র সূর্যের আলোর উপর নির্ভরশীল, ব্যাখ্যা করছিলেন অধ্যাপক আহমদ।
‘যারা রাতে জেগে থাকে এবং দিনে ঘুমায় তারা তাদের শরীরের এই ঘড়ির কাটার প্রাকৃতিক নিয়ম ভাঙে। শরীর বলছে ঘুমাও কিন্তু আমি জেগে আছি। এতে তাদের আচরণে পরিবর্তন আসো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, বেশি রাগ করে। এদের অনেকে সহজে মাদক গ্রহণে আসক্ত হয়। নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা থাকে। এটাকে বলে সার্কাডিয়ান রিদম স্লিপ ডিজঅর্ডার। ভাল মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সূর্যের আলোর নিয়ম মেনে শরীরের ঘড়িকে চলতে দিতে হবে।’
সূর্যের আলো মন মেজাজ কীভাবে ভালো রাখে সেটি ব্যাখ্যা করে তিনি বলছেন, সূর্যের আলোতে গেলে মানুষের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামে একটি হরমোন নিঃসরণ হয়। এটি মানুষের মন, মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করে।
যারা নিয়মিত দিনের আলোতে বের হন না, রাতে কাজ করেন তাদের বিষণ্ণতায় বেশি ভুগতে দেখা যায়। যেসব শীতের দেশে সূর্যের আলো কম সময় ধরে থাকে সেসব দেশে মানুষজন বিষাদে ভোগেন বেশি।
বিষাদ কমাতে ‘লাইট থেরাপি’ ব্যাবহার করা হয়। সূর্যের আলোকে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অথবা সরাসরি সূর্যের আলোতে যেতে বলা হয়। এতে বিষণ্ণতা অনেকাংশে কমে যায়।
হেলাল উদ্দিন আহমদ বলছেন, ‘বৈজ্ঞানিক কথার বাইরেও কথা হচ্ছে দেখবেন আমাদের রৌদ্রোজ্জল দিনে সূর্যের আলো দেখলে ভালো। আবার মেঘাচ্ছন্ন, বৃষ্টির দিনে আমাদের মন খারাপ থাকে। এগুলোও কিন্তু সাধারণ বিশ্বাস।’
কখন এবং কতক্ষণ
অধ্যাপক ডা. কানিজ মাওলা বলছেন, সূর্যের আলো সবচেয়ে ভালো কাজ করে দিনের শুরুতে। যখন আপনার ছায়া আপনার চেয়ে ছোট। গরমকালে প্রতিদিন ১০-১৫ মিনিট যথেষ্ট।
তবে কি কাপড় পরে আছেন তার ওপরও নির্ভর করবে কতক্ষণ। বেশি ঢেকে থাকা কাপড় পড়লে বেশিক্ষণ থাকতে হবে। তাই শীতকালে তিরিশ মিনিট পর্যন্ত।
যে ক্ষতি করে
সূর্যের আলোর ক্ষতি খুব বেশি নেই। সূর্যের আলোতে অনেক বেশি সময় ধরে থাকলে ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়, ত্বক পুড়ে যায়। এর একটিই বড় ধরনের ক্ষতি আর সেটি হবে যদি বেশিক্ষণ কেউ সূর্যের আলোতে থাকেন তাহলে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা এনএইচএস বলছে, সূর্যের আলোতে থাকে ‘আল্ট্রাভায়োলেট লাইট’ বা অতিবেগুনি রশ্মি। সূর্যের আলোতে হঠাৎ করে খুব বেশিক্ষণ থাকলে এই রশ্মি ত্বকের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
যেমন বেড়াতে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকে দীর্ঘ সময় সৈকতে কাটান। এর অর্থ হচ্ছে হঠাৎ করে অনেক বেশি সূর্যের আলো। ত্বকের ক্যান্সার কিছুটা ত্বকের রঙের উপরেও নির্ভর করে। ত্বকের রঙ গাঢ় হলে সূর্যের আলোতে ক্যান্সারের প্রবণতা কম হতে দেখা গেছে।