শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন
শরৎতের এই নীল আকাশে আজ মেঘের আনাগোনা একটু কম বললেই চলে। উপরের দিকে তাকালে নীল আবরণ যুক্ত সীমাহীন আকাশ আর তীব্র আলো যুক্ত সূর্য।এই প্রখর রোদের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গরমে মাথা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।তার উপর মাঝ দুপুরে বের হলাম,ধরতে গেলে দুপুর দুটো বাজে।ছাতা নিতে চেয়েও ইচ্ছে হলো না,মনের মধ্যে একধরনের অহংকার বোধ চলে এসেছিল।সে সময় মনে হলো ছাতা পুরুষদের জন্য নয়,নারীদের জন্য। পুরুষদের অগ্নিগিরির উত্তাপ সহ্য করার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন,তা না হলে বাস্তবতার কাছে বার বার পরাজিত হতে হবে। কঠিন উত্তাপে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার নামই পুরুষ।যদি প্রচন্ড রোদ সহ্য করার ক্ষমতা না-ই থাকে তাহলে পুরুষই-বা হলাম কেমন করে! ওদিকে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে চেক শার্টটি ঘামে ভিজেছে। কিছুটা ঘাম ভেজা গন্ধ নাকে আসছে
করার কিছুই নেই;আমি যে পুরুষ!
বাসা থেকে বের হওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য গ্ৰামে যাওয়া।প্রায় দুই বছর হলো গ্ৰামে যাওয়া হয় নি। সেখানে তিন বিঘে জমি আর চার খোপ দোতলা মাটির একটা বাড়ি আছে। আমার না যাওয়াতে এই দু’বছর পুরো দায়িত্ব নিয়েছিল আমার ছোট ভাই শিমুল।এখনও সে এই দায়িত্বে বহাল আছে।
বাবা চার বছর আগে গ্ৰামেই মারা গিয়েছেন।বাবা মারা যাওয়ার পূর্বে শহরে একটা দুই ফ্লাটের বাড়ি করে দিয়েছেন। তারপর আমাকে ও আমার দুই বছরের ছোট ভাই শিমুলকে এখানে পাঠিয়ে দেন। শিমুল এখানে এসে বিয়ে করলো,তারপর তার সংসার!বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের দেখাশোনার জন্য একমাত্র ব্যক্তি আমি ছিলাম,কারণ শিমুল বিবাহ করার পর থেকে মায়ের কোন প্রকার যত্নে আগ্রহী নয়।তাই মায়ের দেখাশোনার লোকের অভাবে মাকে শহরে নিয়ে এসে আমার কাছে রাখতে হলো।শহরে আসার প্রথম অবস্থায় তিনি এক প্রকার পাগলামি শুরু করলেন। এখানে আসার পর থেকে সব সময় শুধু এটাই বলতেন,”বাবা শামীম,আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলি?শহরের বাতাসে শ্বাস আটকে যাচ্ছে। জনমানবের হৈচৈ ও যান্ত্রিক শব্দে আমি থাকতে পারছি না,মাথা ব্যথা করে। আমি এরকম অলস ভাবে সারাদিন বসে থাকতে আমার শ্বাস আটকে যাচ্ছে। আমার এখানকার পরিবেশ একদম সহ্য হচ্ছে না।এখানে না আছে ধান ক্ষেত,না আছে হাঁস-মুরগি,গরু-ছাগল।না পাই ভোর সকালের পাখিদের মিষ্টি ডাক।কোন মানুষ নেই যে তার সাথে গল্প করবো।
শিমুলের বউ তো সারাদিন ঘর বন্ধ করে থাকে।দিন অন্তর একবার খবর নিতে আসে না।এমন নিঃসঙ্গতা ভালো লাগছে না, প্রতিদিন যেন একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়ছি।আমাকে গ্ৰামে রেখে আয় বাবা!”
শহরে আসার মাস দুই কেটে যাবার পর মা আস্তে আস্তে এই আবহাওয়ার সাথে মিশে যেতে লাগলো। নামাজ আদায়,কোরআন, হাদিস, গল্প, উপন্যাসের বই পড়ে দিন পাড় করতে শুরু করলেন। মা একদম মূর্খ ছিলেন না,আশির দশকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।সে সময়ের পঞ্চম আর এযুগের এস এসসি প্রায় সম মান ছিল বললেই চলে।মাঝে মধ্যে সময় বের করে মাকে নিয়ে শহরের এপাশ ওপাশ ঘুরে নিয়ে আসতাম যাতে তার নিঃসঙ্গতা কাটে।পাশের বাড়ির এক চাচির সাথে মোটামুটি রকমের মিল হয়েছে তার। মাঝেমধ্যে বিকেল বেলা ছাদে বসে দুজনেকে গল্প করতে দেখি।
বাসস্টপে এসে বাসের অপেক্ষায় বসে আছি। সময়-টময় ভুলে গেছি সেই কবে,কখন গাড়ি আসে যায় তার খবর মনে নাই।চেইন মাস্টারের থেকে জানতে পারলাম পনের মিনিট পরে পাকুরতলী রোডের বাস আসবে।সিগারেট ধরিয়ে বসে পড়লাম যাত্রী ছাউনীতে,আমার অত্যাচারে পাশে বসা মধ্যে বয়সী পুরুষটি নাকে হাত দিয়ে ওপাশের বেঞ্চে গিয়ে বসলো।আমি ছাড়াও ছাউনীতে ছয় জন লোক বসা ছিল। তাদের কাউকে আমি চিনি না।
বসে থাকার কয়েক মিনিটের মাথায় হঠাৎ করে আকাশ ডাকতে শুরু করলো,আকাশের দিকে তাকালাম।মেঘলা আকাশ,এই অল্প সময়ের মধ্যে কোথা থেকে এতো মেঘের উদয় হয়ে সম্পূর্ণ আকাশ ঢেকে গেল;সে অনুমান করার ক্ষমতা আমার নেই।মেঘের দলগুলো খুব বেশি সময়ও নিলো না,ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি পড়তে লাগতো। গরমে অতিষ্ঠ নগরীতে শীতল বাতাসের উপস্থিতিতে শহর জুড়ে সমস্ত প্রাণী দলের এক শীতল শান্তির শ্বাস পড়লো। বৃষ্টি ভেজা এই শীতল বাতাস যখন গায়ে এসে পড়ছিল সে সময় মনে হচ্ছিল,সেই বাতাস শরীর ভেদ করে আমার হৃদয়ে গিয়ে পৌঁচাচ্ছে।বেশ শান্তি ও আনন্দ লাগছিল তখন।এই আনন্দে পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করলাম।বৃষ্টির সময় সিগারেট টানার এক ধরনের আনন্দ আছে,এসময়ের ভাবনা স্থির।সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করলাম,কোটি কোটি সূক্ষ্ম কোণা আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে নিচে পড়ছে,সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কল্পনায় ডুবে গেলাম।আমার পুরোনো অতীতের কথা মনে পড়ছে,এরকম বৃষ্টি শুরু হলে শফিক আমার ঘরের জানালায় এসে ডাকতো।বলতো,”এই শামীম বাহিরে আয় ফুটবল খেলবো।”
আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বাহিরে বের হতাম,মাঠ কাঁদা করে দৌড়ে,পিসলে ফুটবল খেলতাম। তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র ছিলাম!হায় সময়!কী ভাবে কেটে যায়?
সে সময় কতো স্বপ্ন দেখতাম,হায়..!আজ ২৮ বছর বয়সে এসে সব স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে হয়ে গেলাম মুদির দোকানি!শফিক এখন ক্যান্সারে আক্রান্ত,মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছেন প্রতিনিয়ত।শুনলাম ডাক্তার নাকি অনুমান করে বলেছে এমাসে তার বিদায় হবে।এ-ও শুনলাম গ্ৰামেই নাকি আছে। কয়েক বছর ধরে দেখা হয় নি।আজ গ্ৰামে গিয়ে তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে নেওয়া দরকার।
যাত্রী ছাউনীর পাশে মটর সাইকেল থামার শব্দে আমার ভাবনা ভেঙে গেল।সেদিকে তাকাতেই মনে হলো,বুকে গুলি লাগা আহত যুদ্ধার মৃত্যুর যন্ত্রণার মতো বেদনা আমার বুকে এসে ভর করেছে।বিস্মিত দুটো চোখ,বেদনায় চোখের পাতা ভেদ করে পানি পড়তে চাইলো।অনেক চেষ্টায় নিজেকে সামলিয়ে নিলাম।
‘সন্ধ্যা’ মোটরসাইকেল থেকে নামলো,আর তার স্বামী গাড়ির সামনে থেকে ৬ বছরের বাচ্চাকে নামিয়ে সন্ধ্যার কোলে তুলে দিলো।যাত্রী ছাউনীতে ঢোকার সময় এক বার আমার দিকে তার চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেললো।তারপর অপর পাশের বেঞ্চের এক কোণে বাচ্চা সহ বসে পড়লো।চশমা চোখে,কোট পড়া,মোটর সাইকেলে বসা তার ভদ্র,শ্রদ্ধেয় স্বামী বিদায় জানিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চলে গেল।সন্ধ্যা বসে রইলো নিশ্চুপ ভাবে,কোন কথাও বললো না,কোন দিকেও আর তাকালো না।
শামীম সাহেবের পুরোনো বিষাদময় স্মৃতি গুলো মনে পড়ে গেল,একা একা নিজের সাথে নিজে কথা বলতে লাগলেন,
“কে বলবে এই সন্ধ্যা এক সময় আমার জন্য পাগল ছিল!কে বলবে এই সন্ধ্যা আর আমি ঘনিষ্ঠ ছিলাম,কতোটা কাছাকাছি এসেছিলাম!
এই সে সন্ধ্যা যে একসময় বলেছিলো,”সেদিন দুপুর বেলা কলেজ শেষে দুজনে রিকশা থেকে স্ট্যান্ডে নামার পর এই সেই যাত্রী ছাউনী,সেখানে একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে ছিল তার জননী।সে সময় সে বলেছিল,”দেখো শামীম, একদিন আমাদের ও ঐই রকম একটা বাচ্চা হবে।”
আজ ফুট ফুটে বাচ্চা হয়েছে।যা তুমি চেয়েছিলে,সেই ফুটফুটে বাচ্চায় তুমি পেয়েছে।অথচো দ্যাখো সে বাচ্চা আমাদের নয় শুধু তোমার আর অপর পুরুষের কামনার ফসল।
তোমার পরিবার যখন আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলো,জোর করে তোমার বিয়ে ঠিক করলো।তুমি এক ভোর বেলায় আমার কাছে এসে বললে,”শামীম তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। তুমি আমাকে নিয়ে চলো।”
আমি তোমার চোখের সেই অশ্রু সইতে পারি নি,রাত এগারোটার দিকে বাসা থেকে ৪০ হাজার টাকা চুরি করে তোমার দেওয়া ঠিকানায় পৌছেছিলাম।সারা রাত কেটে গেল,মশার কামড়ে হাত ফুলে ঢোল করলাম।কি অদ্ভুত তুমি আসলে না!আজ তুমি দিব্যি বেঁচে আছো,সুখেই আছো দেখছি। শরীরে আগের থেকে মাংসের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। অথচ দেখো তোমাকে ভেবে কতো স্বপ্নের বিসর্জন দিতে হলো,না হলো না হলো পড়াশোনা,না হলো কানাডা যাওয়া।শেষে আমি এক মুদির দোকানদার!জীবনকে অগোছালো করার জন্য সষ্ট্রা একটা করে মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষকে নিয়োজিত রাখেন,বোধহয় শয়তানের থেকে ও বেশি ক্ষিপ্র সেই মানুষটি।ঝরের মতো আসে আর আহত করে সড়ে যায়।”
শামীম সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করে উঠে পড়লেন। এখানে যতো বেশি থাকা হবে, ততো বেশি স্মৃতি ততো বেশি যন্ত্রণা। তিনি আর পারছেন না এই বেদনা সহ্য করতে।যাত্রী ছাউনী থেকে নেমে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে ভিজতে থাকলো তার শরীর। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন রাস্তার মোড়ে।এক সময় শহরের রাস্তার বাঁক আড়াল করলো তাকে,আর দেখা যাচ্ছে না। বাসস্টপে বাস এসে পড়েছে,সন্ধ্যা মুখ উঁচু করে তুলতে চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু পড়ে গেল,বোধহয় সে ও তার অতীতের স্মৃতির মধ্যে ডুবে ছিল এতোক্ষণ।