শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:১৩ অপরাহ্ন
১৯২৭ সালের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোরখা ছাড়া শুধু শাড়ি পরে এক কিশোরী পড়তে যেত। রাস্তায় তাকে এ পোশাকের জন্য যুবকরা ইট, পাটকেল ও ঢিল ছুঁড়ত। কারণ ওই সময় মুসলিম মহিলাদের স্কুল কলেজে গিয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে আপত্তি ছিল অনেকেরই। বাড়িতে ক্বোরআন, হাদিস ইত্যাদি শিক্ষার ব্যাপারে কিছুটা ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু বাইরে বের হয়ে স্কুল- কলেজে পড়াশোনার কোনও সামাজিক স^ীকৃতি ছিল না। ব্যতিক্রমী এ মহিলার নাম ফজিলতুন্নেছা।
কুমিল্লা জেলার নামদার গ্রামে ১৯০৪ সালে ফজিলতুন্নেছার জš§। ছাত্রী হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঢাকা ইডেন স্কুল থেকে ১৯২১ সালে ১ম বিভাগে মেট্রিক পাশ করে মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তি লাভ করে সেখান থেকে আই এ পাশ করার পর কলকাতা বেথুন কলেজ থেকে ডিসটিংশন নিয়ে বিএ পাশ করেন।
ফজিলতুন্নেছা অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে হয়েও নিজের ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে উচ্চশিক্ষা অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন। পিতা শিক্ষিত বা অর্থশালী লোক ছিলেন না, কিন্তু মেয়ের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন অতি উৎসাহী এবং সামাজিক সমস্ত প্রতিবন্ধকতা তিনি নিজেও অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এরই ফলে ১৯২৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করে এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ফজিলতুন্নেছা। সে সময় গণিতশাস্ত্রে এ রকম কৃতিত্ব ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে আর কেউ দেখাতে পারেননি। আর মুসলিম সমাজে এ একটি দুর্লভ স¤মান ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাশে তিনি ছিলেন প্রথম ও একমাত্র ছাত্রী। পিতার অবস্থা ভাল ছিল না, তাই ফজিলতুন্নেছাকে শিক্ষা লাভ করতে হয়েছিল স¤পূর্ণ নিজের চেষ্টাতেই। নারী মুক্তি ও নারী স^াধীনতার সেÐাগান না দিয়ে তিনি নীরবে কাজ করে গেছেন অধিকার আদায়ের জন্য।
সব বাধা- বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে এম এ পাশ করার পর ফজিলতুন্নেছা উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এ মর্মে আবেদনও করলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফজিলতুন্নেছার এ আবেদন খারিজ করে দিল কারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে এ ধারনায়। ফজিলতুন্নেছা এতে ভেঙ্গে পড়লেন না।
তিনি নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগলেন এবং অবশেষে কলকাতা এসে সওগাত পত্রিকার স¤পাদক মোহা¤মদ নাসির উদ্দিনকে ধরলেন। মাত্র কয়েক বছর পূর্বে সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করে রীতিমত মুসলমান সমাজে আলোড়ন নাসির উদ্দিন। চিন্তাশীল সাহিত্যিক ও তরুণদের কাছে সওগাতঅভিনন্দন পেলেও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানরা বললেন সওগাত ইসলাম বিরোধী পত্রিকা, কারণ এ পত্রিকায় মেয়েদের ছবি ছাপা হয় ইত্যাদি। সাওগাত স¤পাদক এ সমস্ত সমালোচনাকে আমল না দিয়ে স¤পূর্ণ সচিত্ররূপে পত্রিকাকে একদল তরুণ লেখক লেখিকাকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সাদামাটা সাহিত্যপত্রিকা না করে সওগাত বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের সংকল্পে মুসলিম মহিলা লেখিকাদের উৎসাহ দিতে লাগলেন, তাদের নানাভাবে গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশ করে। সওগাতের সেÐাগান ছিল-নারী না জাগলে জাতি জাগবে না।
সওগাত স¤পাদক নাসির উদ্দিনের সঙ্গে ফজিলতুন্নেছার চিঠিপত্রে পরিচয় ছিল। সওগাতে তিনি অনেক লেখা পাঠিয়েছিলেন এবং তা প্রকাশিতও হয়েছে তাঁর ছবি সহ। এবারও পত্রযোগে যোগাযোগ করে ফজিলতুন্নেছা ছোটবোনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতা এসে পৌঁছলেন। কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার যুগে একজন তরুণীকে এ ভাবে ঢাকা থেকে কলকাতা আসতে দেখে।
নাসির উদ্দিন গভীর আগ্রহের সঙ্গে ফজিলতুন্নেছার বিলাতে উচ্চশিক্ষার জন্য বাধাবিপত্তির কথা শুনলেন। তিনি ফজিলতুন্নেছাকে বললেন, যদি আপনার বিলেত যাত্রা সফল হয়, তবে আমাদের নারী প্রগতি আন্দোলন একধাপ এগিয়ে যাবে। তিনি ফজিলতুন্নেছাকে প্রতিশ্রæতি দিলেন তাঁর উদ্দেশ্য সফলের জন্য তিনি সব রকম চেষ্টা করলেন। নাসির উদ্দিন সওগাতের প্রগতিশীল মতবাদের সমর্থক মহামেডান এডুকেশন বোর্ডের পি আই খানবাহাদুর আব্দুল লতিফের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফজিলতুন্নেছার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সবকথা বললেন। অবিলম্বে তিনি এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য পরার্মশ দিলেন। সে সময় বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন নবাব মুশারফ হোসেন। পরের দিনই নাসির উদ্দিন ফজিলতুন্নেছাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে মন্ত্রীকে বললেন-ইনি বাংলার গৌরব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে প্রথম বিভাগে প্রথম হওয়ার কথাও বললেন। মন্ত্রী ফজিলতুন্নেছাকে আশীর্বাদ দিয়ে তাঁর উজ্জ¦ল ভবিষ্যৎ জীবন কামনা করেন। কিন্তু নাসির উদ্দিন ফজিলতুন্নেছাকে নিয়ে হাজির হওয়ার আসল উদ্দেশ্য যখন ব্যক্ত করলেন, তখন মন্ত্রীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।
তিনি পরিস্কার করেই বললেন, একজন মুসলমান মেয়ে বেপর্দা হয়ে বিলেতে যাবে আর মুসলমান মন্ত্রী হয়ে আমি তাঁর সহায়তা করব, এতে আমার নিন্দার শেষ থাকবে না। আমি কি করি বলুন?
তখন নাসির উদ্দিন এক চরম অস্ত্র ছাড়লেন। তিনি মন্ত্রীকে জানালেন, তিনি ফজিলতুন্নেছাকে খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছে নিয়ে যাবেন এবং প্রয়োজন হলে তাঁকে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেও বিলেত পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। নাসির উদ্দিন আরও জানালেন, যে ফজিলতুন্নেছা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও বিফল হয়ে এ কাজ করেছেন এ সংবাদ তিনি সওগাতে প্রকাশ করবেন। নাসির উদ্দিনের কাছে এসব কথা শোনে মন্ত্রী বিব্রত হয়ে কথা দিলেন। কথা দিলেন সেদিন বিকালেই ফজিলতুন্নেছার বিলাতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল।
ফজিলতুন্নেছার বিলাত যাওয়ার চেষ্টায় সাফল্য লাভ করে সওগাত স¤পাদক নাসির উদ্দিন নারী প্রগতির এক বিশেষ স্টেজ অতিক্রম করলেন বলা যায়। সওগাতের পক্ষ থেকে ফজিলতুন্নেছাকে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছিল। কাজী নজরুল ইসলাম তখন সওগাতের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন এবং এ উপলক্ষে একটি গান রচনা করে তিনি সভায় গেয়ে শোনান। সভায় সে সময়কার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারিণী ফজিলতুন্নেছার সঙ্গে কবি নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটেছিল ঢাকাতে। প্রথম পরিচয়ের পর থেকেই কবি নজরুল ইসলাম ফজিলতুন্নেছার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি (কবি) কলকাতা আসার পর ঢাকায় ফজিলতুন্নেছার কাছে আবেগপূর্ণ চিঠি লিখতেন।
তাছাড়া ফজিলতুন্নেছা বিলাত যাওয়ার পর বিলাতে কবির অনেক পত্র গিয়েছে কিন্তু কোনও সদুত্তর আসেনি। এতে কবি অনেকটা মর্মাহত হয়েছিলেন। এ মর্মবেদনা প্রকাশ পেয়েছে কবির বিভিন্ন কবিতা ও গানে। বাংলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আহসানউল্লার পুত্র সামসুজ্জোহা তখন বিলাতে অধ্যয়নরত ছিলেন। ফজিলতুন্নেছার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে বিলাতে এবং সেখানে একে অন্যকে ভালবেসে ফেলেন। ১৯৩০ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে ফজিলতুন্নেছা দেশে ফিরলন। অপরদিকে সামসুজ্জোহাও সলিসিটর ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন। তিনি বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম সলিসিটর। ১৯৩০ সালেই ফজিলতুন্নেছার সঙ্গে সামসুজ্জোহর বিয়ে হয়।
দেশে ফিরে আসার পর ফজিলতুন্নেছা কলকাতার বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপিকারূপে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ওই পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর ফজিলতুন্নেছা কী এক অজ্ঞাত কারণে নির্জন জীবন যাপন ভ্রভ করেন। ১৯৭৬ সালে ঢাকাতেই তিনি ইন্তেকাল করেন।
ফজিলতুন্নেছার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অধ্যবসায় ও অদম্য মানসিক সংকল্প থাকলে সব রকম বাধা বিঘœ দূর করে মহৎ উদ্দেশ্য সাধন একজন সাধারণ ঘরের বাঙ্গালী নারীর পক্ষেও অসম্ভবের কিছুই নয়।
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।