শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন
সাদিকুর রহমান সামু : মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জে এমবিবিএস পাস না করেও সকল রোগের চিকিৎসা করছেন সুমন আচার্য্য নামে এক পল্লী চিকিৎসক। অভিযোগ রয়েছে তাহার কাছে চিকিৎসা নিয়ে অনেকেই হয়েছেন আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পল্লী চিকিৎসক সুমন আচার্য্যের বাড়ি কমলগঞ্জের মুন্সীবাজারের বিক্রমকলস। প্রথমে তিনি চাকরি করতেন স্থানীয় মুন্সীবাজারের আচার্য্য মেডিকেল হল নামে এক ফার্মেসীতে। পরে তিনি সুমি মেডিকেল হল নামে একটি ঔষধের দোকান খুলেন। পরবর্তীতে ওই ঔষদের দোকানে রোগী দেখার চেম্বার খুলে হয়ে যান ডাক্তার। প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১ টা পর্যন্ত এবং বিকাল ৪ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত নির্ধারিত ভিজিট নিয়ে শিশু রোগ সহ সকল রোগের রোগী দেখেন বলে জানান স্থানীয়রা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের এপ্রিলে পেট ব্যাথা নিয়ে এক তরুণী তার চেম্বারে গেলে তাকে প্রেগন্যান্সি টেস্টের জন্য পাঠান নিজের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখান থেকে প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট আসে। পরে অবিবাহিত ওই তরুণী জেলা সদরে গিয়ে রিপোর্ট করলে প্রেগন্যান্সি রিপোর্ট ভূল ধরা পড়ে। পরে ক্ষতিপূরণ দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পান এই চিকিৎসক। সরেজমিনে ফার্মেসী ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে চিকিৎসা চালানো এ পল্লী চিকিৎসকের চেম্বারে সম্প্রতি রোগী সেজে গেলে শারিরীক ভাবে কোনো পরীক্ষা নিরিক্ষা না করেই তিনি কোলেস্টেরল, লিভার ও কিডনি সহ ৮ টি টেস্ট দেন। এই টেস্টের ফি এর টাকা হিসাব করে হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার দেখিয়ে বলেন ওইখানে টেস্ট করবেন। সেখানে গেলেই নাকি এক টিপেই সব রেকর্ড চলে আসবে বলেন ওই চিকিৎসক।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন পল্লী চিকিৎসক সুমন আচার্য্য এ এসব টেস্ট লিখার কোন এখতিয়ার নেই। তবুও দিচ্ছে তিনি এমন অসংখ্য টেস্ট। আরএমপি (রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার) কোর্স করেই এমবিবিএস চিকিৎসকের মতোই তিনি করছেন জটিল সব রোগের চিকিৎসা। আইন অমান্য করে ডিজিটাল সীল বানিয়ে নামের আগে পদবি লিখছেন ‘ডাক্তার’। আর ডিজিটাল প্যাড ছাপিয়ে তাতে লিখেছেন ভি.ডি.আর.এম.পি। পল্লী চিকিৎসায় ভি.ডি নামে কোনো কোর্স না থাকলেও সুমন আচার্য্য এর প্যাডে ভি.ডি.আর.এম.পি লিখা রয়েছে। তিনি ভি.ডি শব্দের কোনো ব্যাখ্যা দিতে না পারলেও তার এক কলিক এটা ভিলেজ ডক্টর বলে মন্তব্য করেন।
জানা যায়, আরএমপি কোর্স করে নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখে চেম্বার খুলে এই পল্লী চিকিৎসকের রোগী দেখার আইনগত অনুমোদন বা যোগ্যতা কোনোটাই নেই। আইন বলছে, তিনি সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদান করবেন এবং জটিল-স্পর্শকাতর রোগীদের বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে প্রেরণের নিয়ম রয়েছে। অথচ তিনি করছেন ঠিক এর উল্টো। চিকিৎসার নামে সাধারণ এবং জটিল সকল রোগের অপচিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। অসহায় রোগীদের তিনি ব্যবহার করছেন ‘গিনিপিগের’ মতো। তার ভুল চিকিৎসা, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রিপশনের কারণে হরহামেশাই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। ডাক্তার রূপধারী এই পল্লী চিকিৎসকের ওপর প্রশাসনের নজর বা নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই নেই। একারণে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন সেবা নিতে আসা গ্রামের অসংখ্য মানুষ।
স্থানীয়রা বলছেন, কমলগঞ্জের উত্তরাঞ্চলে চিকিৎসক সংকট থাকায় এবং গ্রামের মানুষের সচেতনতার অভাবকে পুঁজি করে বছরের পর বছর রোগী দেখে যাচ্ছেন সুমন আচার্য্য। রোগমুক্তি তো দূরের কথা, এসব ভুয়া চিকিৎসকের ওষুধ খেয়ে নানান জটিলতায় ভুগছেন হাজারো রোগী।
এছাড়া মাঝেমধ্যেই তাদের ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগকে আরো জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে নিয়ে নিরাময়-অসম্ভব করে ফেলছেন। নিজের চেম্বার খোলার পাশাপাশি এ পল্লী চিকিৎসকের ওষুধের ফার্মেসী রয়েছে। হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের স্থানীয় এক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের শেয়ার হোল্ডারও তিনি।
নিজেই ডাক্তার, নিজেই আবার ওষুধ বিক্রেতা আর নিজে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পার্টনার। একারণে রোগীদের মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রাইবও করছেন দেদারসে। লিখছেন নানা টেস্ট। নিজেকে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গ্রামের অশিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত তথা গরিব মানুষদের আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, এ পল্লী চিকিৎসক রোগের প্রাথমিক অবস্থায় উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে যাচ্ছেন। তার ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন।
আলাপকালে পল্লী চিকিৎসক সুমন আচার্য্য সাংবাদিকদের বলেন, আমি ডাক্তার। ডাক্তার হিসাবে রোগীর অবস্থা বুঝে যে কোনো ঔষধ বা টেস্ট দিতে পারি। নিজের কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তার শেয়ার হোল্ডার নেই বলেও জানান তিনি। এর বাহিরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিসিভসনের দায়িত্ব থাকা কর্মচারী বলেন, ডাক্তার সাহেব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক নায়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ওই ডাক্তারের শেয়ার আছে। আলাপকালে কমলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার মাহবুবুর আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) অ্যাক্ট অনুযায়ী কেবল এমবিবএস পাসকৃত চিকিৎসক ও ডেন্টাল সার্জনরা তাদের নামের আগে ডা. (ডাক্তার) লিখেতে পারবেন। এর বাহিরে ডাক্তার লেখার সুযোগ নাই। এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্যবিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।