শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৪:৫০ পূর্বাহ্ন
বাংলাদেশে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বছরের এ ছ’মাসের যে কোনও সময়ই বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর বন্যা হলে কৃষিক্ষেত্রেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাতে বিশেষ করে ধান ও শাকসব্জির উৎপাদন ব্যহত হয়। তা ছাড়া, মাছ চাষ ও পশু পালনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গৃহপালিত গবাদি পশুর খাদ্যসঙ্কট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি বন্যা পরবর্তী সময়ে গবাদি পশুর বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে। এবারের বন্যায় বাংলাদেশে এসব ক্ষেত্রে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাই বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কম রাখতে কৃষকদের এ সময় কি করা উচিৎ এ বিষয় নিয়েই আজকের এ প্রতিবেদন।
আউশ ও শালি ধান এবং গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন শাকসবজি চাষে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয় এবং বন্যার পানি যাতে জমিতে না ওঠে সেদিকে কৃষকদের লক্ষ্য রাখা উচিৎ। উচ্চপদস্থ জনৈক কৃষি কর্মকর্তার মতে, যেহেতু এদেশ বন্যাপ্রবণ অঞ্চল তাই এখানকার কৃষকদের বন্যার কবল থেকে ফসল বাঁচাতে এ ব্যবস্থাটি নেওয়াই সবচেয়ে উত্তম। তিনি জানান, এ বছর চলতি আউশ ধান চাষের মৌসুমে ব্যাপক বন্যা হয়েছে। অনেক কৃষকের আউশ ধানের হালিচারা বীজতলা মূল জমিতে রোপণের আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার পানি ওঠার সম্ভাবনা থাকা একেবারে নিচু জমি বাদ দিয়ে রোপণ করা হলে, পরে বন্যা যদি এসেও যায় তবুও কৃষকদের ক্ষতির সম্ভাবনা কিছুটা হলেও কম থাকবে। শালি ধানের বীজতলা তৈরীতেও উঁচু জমি নির্বাচনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি জানান, বীজতলাতে হালিচারা থাকা অবস্থায় মূলজমিতে রোপণের আগেই অনেক সময় বন্যা হয়ে যায়। তেমন পরিস্থিতি দেখা দিলে উঁচু জমিতে বীজতলা প্রস্তুত করায় হালিচারার কোনও ক্ষতি হবে না। পরে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কৃষকরা ওই হালিচারা মূল জমিতে লাগাতে পারবেন। তবে বন্যা হলে মৌসুমের অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যায় তাই বন্যা পরবর্তীতে শালি ধানের চাষের ক্ষেত্রে উঁচু স্থানে তৈরী করা জলদি জাতের হালিচারা যেমন সোনামুখী, দুমাইয়া প্রভৃতি কৃষকদের লাগাতে হবে। তাছাড়া মনোহর শাইল জাতের ধানের হালিচারাও দেরিতে রোপণ করা যায়। এভাবে সতর্কতার সঙ্গে চাষ করলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস করা সম্ভব।
তিনি আরও জানান, বন্যা পরবর্তী সময়ে ধানক্ষেতে রোগ ও পোকার আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে। সে অনুযায়ী বন্যাপীড়িত কৃষকদের ধানক্ষেতে বন্যা পরবর্তী রোগ পোকার আক্রমণ প্রতিরোধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বন্যা পরবর্তীতে যারা নতুন করে হালিচারা তেরী করবেন তাদের বীজতলাতে বীজ বপণের আগে বীজ শোধন করা প্রয়োজন। বীজ শোধনে প্রতি কেজি বীজের জন্য ২.৫ গ্রাম ইন্দোফিল এম ৪৫ বা ক্যাপটাফ বা ১ গ্রাম পরিমাণে বেভিস্টিন এক লিটার পানিতে মিশিয়ে তাতে ২৪ ঘন্টা বীজগুলো ভিজিয়ে রেখে পরে জাঁকে রাখতে হবে।
বীজতলাতে বীজ বপণের এক সপ্তাহ পর অথবা হালিচারা উঠানোর সপ্তাহ দিন আগে প্রতি কাঠা বীজতলাতে ২০০ গ্রাম হারে ফুরাডন দানাদার ঔষধ ছিটিয়ে দিতে হবে। ওই সময় বীজতলাতে ছিপছিপে পানি রাখা প্রয়োজন।
অথবা, বীজতলা থেকে হালিচারা উঠানোর পর চারার গোড়া ধুঁয়ে নিয়ে শোধন করতে হবে। প্রতি ৫ লিটার পানিতে ১ চামচ হারে ক্লোরোপাইরিফস (ডার্সবান বা করোবান) ও ৫০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে চারার গোড়া তিন ঘন্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে।
হালিচারা উঠানোর পর চারার অগ্রভাগ ছিঁড়ে দিয়ে তা কাদায় পুঁতে ফেলা দরকার।
হালিচারা মূল জমিতে লাগানোর ২০-২৫ দিন পর থেকে এক সপ্তাহ অন্তর অন্তর একটি কেরোসিন ভেজানো রশির দুই প্রান্তে দু’জনে ধরে ধানক্ষেতের উপর চালনা করতে হবে।
চুঙ্গি পোকার আক্রমণ হলে এভাবে কেরোসিন ভেজানো রশি চালনা করে ক্ষেতের পানি বের করে দিতে হবে।
লেদা পোকার আক্রমণ ঘটলে শুরুতেই এদের ধ্বংস করা প্রয়োজন। ধান ক্ষেতে লেদা পোকা প্রতিরোধে প্রতি ৮ লিটার পানিতে ৪ চামচ একালাক্স বা কুইনফলস অথবা ৬ লিটার পানিতে ৪ চামচ নুভাক্রন বা মনোফিল মিশিয়ে প্রতি বিঘায় ৫০ লিটার মিশ্রণ ¯েপ্র করতে হবে।
ধানক্ষেতে কৃষকদের সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে রোগ-পোকার আক্রমণ হয়েছে কিনা। রোগ-পোকার আক্রমণ চোখে পড়লে অতিসত্তর স্থানীয় কৃষি কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।
গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালীন শাকসবজি সাধারণত উঁচু জমিতে চাষ হওয়ার জন্য এসবের বন্যা হলেও তেমন ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না বলেই জানিয়েছেন কৃষি তথ্য কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ বন্যাপ্রবণ অঞ্চল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে গবাদী পশু রাখার গোয়ালঘর অথবা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পালন করা অন্যান্য পশু-পাখিদের খামারবাড়ি বন্যাক্রান্ত হয় না এমন উঁচু জমিতে তৈরী করতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছেন পশু পালন বিভাগের গবেষণা আধিকারিক। তিনি জানান, খামারবাড়ি কিংবা গোয়ালঘর নিচু জায়গায় থাকলে গবাদি পশুর রোগ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যু হওয়ারও আশঙ্কা থাকে বন্যার কারণে। তাই এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। উঁচু স্থানে তৈরী খামারবাড়ি কিংবা গোয়াল ঘরের চারদিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য নালার ব্যবস্থা রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আর বন্যা হয়ে গেলে যাতে গবাদি পশুদের খাদ্যের কোনও ঘাটতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে পর্যাপ্ত শুকনো খড়ের বন্দোবস্ত রাখা প্রয়োজন। এদিকে, উঁচু জায়গার অভাবে গোয়ালঘর নিচু স্থানে থাকলে বন্যার লক্ষণ পরিলক্ষিত হলেই গবাদি পশুকে চটজলদি স্থানান্তরের ব্যবস্থা নিতে হবে। বন্যা পরিস্থিতিতে গবাদি পশুর খাদ্যের ঘাটতি মেটাতে প্রচুর পরিমাণে আমপাতা, কাঁঠালপাতা, শেওড়াগাছের পাতা ও কলা গাছের যোগান দিতে হবে। তাছাড়া সাইলেজ পদ্ধতি সংরক্ষণ করা ঘাসও ওই সময় গবাদি পশুকে খেতে দেওয়া যেতে পারে।
পশুপালন কর্মকর্তা জানান, বর্ষা মৌসুমের আগে গৃহপালিত গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতিকে কৃমিজনিত রোগের ঔষধ খাওয়াতে হবে। তাছাড়া, গবাদি পশুকে হিমরজিসেপ্টিসেমিয়া, ব্লেককোয়ার্টার, এনথ্রাকস, এফএমডি বা বাত রোগের টিকা বর্ষার আগেই দিতে হবে। কারণ গবাদি পশুর এসব রোগ হয় বর্ষায়। বিশেষ করে বন্যা পরবর্তীতে ব্যাপক ভাবে দেখা দেয়। তাই এর প্রতিষেধক টিকা আগে থেকে প্রদান করা হলে ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বণ্যাপ্রবণ এদেশের উপত্যকার মাছচাষীরা বন্যাজনিত কারণে তাদের ক্ষতির পরিমাণ কম রাখতে বন্যার পানি উঠলে ও পুকুরে মাছগুলো যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সেজন্য বন্যা দেখা দেওয়ার আগে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পুকুরের চারপাড়ে লাইলেন মশারি নেট দিয়ে বেড়ার ব্যবস্থা করতে পারেন।
যদি দেখা যায় এতেও মাছগুলো আটকে রাখা সম্ভব নয় তা হলে তাড়াতাড়ি জাল দিয়ে উঠিয়ে বাজারজাত করে বিক্রি করে দেওয়া যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে গেলে ফের পুকুরে নতুন করে মাছের পোনা ছাড়তে পারেন। এভাবে কিছুটা হলেও মাছ চাষে বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কম হবে বলে জানিয়েছেন মৎস্য বিভাগের উচ্চস্তরের মৎস্য কর্মকর্তাগণ। সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।