1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
  • E-paper
  • English Version
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:০৭ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

হাছন রাজার প্রেম দর্শন

  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ৩৫৫ বার পঠিত

আফতাব চৌধুরীঃ
হাছন রাজাকে বলা হয় গানের রাজা। আমরা তাঁকে সবাই জানি। বাড়ি ছিল তাঁর সুনামগঞ্জ। তিনি ছিলেন প্রেমে বিশ্বাসী। দেওয়ানা বানাইল মরে, পাগল করিল।
সত্যিই তিনি প্রেমিক ছিলেন ¯্রষ্টার। তবে সৃষ্টির মধ্যেই ¯্রষ্টাকে দেখেছেন প্রচ্ছন্নভাবে। ¯্রষ্টার প্রতি তাঁর যেমন ছিল প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ঠিক তেমনি ছিল মানুষের প্রতিও। তার পরিচয় মেলে তাঁরই বৈমাত্রেয় বোন হাজী বিবি’র একটি গানের মধ্যে দিয়ে-
সুনামগঞ্জের হাছন রাজা
আলী রাজার নন্দ। টাকা কড়ি অন্ন, বস্ত্র
সবাই করে বিতরণ।
এতে যা বোঝা যাচ্ছে তাঁর ধন-স¤পদ ছিল যথেষ্ট। তবে ধনকুবেরদের মতো কৃচ্ছতা সাদন করতেন না তিনি। কিংবা শুধু ব্যক্তিস্বার্থের কথাও ভাবতেন না। মানবতাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি ধন বিলাতেন। দান-দক্ষিণা করতেন। তাতে তাঁর পরিতৃপ্তিও ছিল। কেননা তিনি মনে করতেন মানব প্রেমের মধ্যে দিয়েই ¯্রষ্টাকে ভালোবাসা যায়। তিনি মনে করতেন আত্মার ভিতরই পরমাত্মার বাস। আত্মা ও পরমাত্মা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জন্যেই তিনি গেয়েছেন-
মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীর করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম,
নাকে পয়দা করিয়াছে খুশর্বষ বদবয়।
‘হাছন রাজার কাছে তাঁর স্বর্গীয় দেহ একটা সার্বজনীন মাধ্যম এবং এ মাধ্যমেই সে পরম পুরুষ এ বিশ্বে চরাচরের সব কিছুকেই সৃষ্টি করেছেন।’ যার প্রেমে মজনু হয়ে তিনি আউলা-বাউলার মতো সর্বদা ঘুরে ফিরেন সে প্রাণপুরুষ তাঁরই ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে দেখা দেন তারই সাথে যেমন বলেছেন বৈদিক ঋষিও-
‘রূপ দেখিলা মরে নয়নে আপনার-
আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা
দিল আমারে।’
এসব ভেবেই হয়তো স্বামী বিবেকান্দ বলেছেন ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ ‘বৈষ্ণবতাত্তি¡কদের মতে, চৈতন্যদের নরে নারায়ন ও জীবে ব্রহ্ম দর্শণ করেছিলেন।’ রামকৃষ্ণ পরমাহংস দেবের উক্তি, ‘যত জীব তত শিব।’ আর ঠিক তেমনি আরও একজন বৈষ্ণব কবি বড়– চন্ডি দাস হয়তোবা সব কিছু ভেবেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ জন জীবনে দার্শনিক তত্ত¡ কিভাবে পরিস্ফুট হয় হাছন রাজার লোকগীতি থেকেও তা উপলদ্ধি করা সম্ভব।
মনের মানুষটি বিচিত্র রূপে এসে দেখা দেয় হাছন রাজার সাথে। কখনো প্রেমিকা আবার কখনো মাতা রূপে। প্রেমিকাকে না দেখলে যেমন মনের শান্তি উঠে যায়। কোন কিছুকেই লাগেনা ভালো। ঠিক তেমনি।
আমি তোর কাঙ্গালিনী
এগো মন মোহিনী
তুমি বিনে যত দেখি
সকলই ফানী
আবার সুর বদলে যায়-
আইস পরদা খুলিয়াগ মা
আইস পরদা খুলিয়াগ
হাছন রাজার প্রাণ যায়
তুমার লাগি জলিয়াগ।
ছোট শিশু যদি তার মাকে না দেখে তাহলে যে দুঃখ পায়, হাছনেরও ঠিক তেমনি অবস্থা। ছোট্ট শিশুটির মতো তিনিও মাকে ডাকতে থাকেন হন্যে হয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার নিজের ভিতর ¯্রষ্টার প্রতিরূপ দেখে গাইতে থাকেন-
বিচার করি চাইয়া দেখি সকলেই আমি,
আমি হইতে আল্লাহ রসূল
আমি হইতে কুল
আমি হইতে আছমান জমিন
আমি হইতেই সব।
আমি হইতে ত্রিজগৎ আমি হইতে রব।।
আপন চিনিলে খোদা চিনা যায়। তিনি নিজের মধ্যে ¯্রষ্টার প্রতিরূপ দেখতে পেয়েছেন। তাঁর অন্তরের মধ্যেই সমস্ত বিশ্বরূপের প্রতিচ্ছবি তিনি দর্শন করেছেন। হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি, নিজেকে চিনেছে সে ব্যক্তি আল্লাহকেও চিনেছে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্য কোন প্রভেদ করেননি তিনি, যেমন করেননা সুফী সাধকরাও। এরূপ এক সুফী সাধক মনসুর আলহাল্লাজ নিজেকে সবসময় বলতেন আনা আল হক। অর্থাৎ আমিই খোদা। পরে কিছু লোক ক্ষুদ্ধ হয়ে তাঁকে জবেহ করে। তখন নাকি তাঁর রক্ত থেকেও উচ্চারিত হতে লাগল, আনা আল হক। এজন্যেই হাসন বলেছেন, নিজেকে জান। নিজেকে চেন। যেমন বলেছিলেন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস। তাঁর সে বিখ্যাত উক্তি ‘নো দাই সেলফ’। হাছন রাজা অপ্রেমিকদেরকে নিষেধ করেছেন তাঁর গানের বই না ধরতে, না পড়তে। যাদের ভিতর প্রেম নেই তিনি তাদেরকে কানা’র সাথে তুলনা করেছেন। কানার হাতে সোনা দিলে লালা আর ধলা কিছুই বুঝবেনা। কারণ তার সে দর্শনেন্দ্রিয় নেই। তাই তিনি প্রেমহীন মানুষকে তাঁর গান শুনতেও নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের সে অন্তঃচক্ষু নেই। পবিত্র হাদীসে রয়েছে, ‘যে ব্যক্তির মধ্যে প্রেম নেই, সে বিশ্বাসী নয়’। যদিও তিনি আল্লাহ এবং নিজেকে এ সূত্রে গেঁথেছেন। তবুও আবার পরমাত্মাকে আত্মার থেকে পৃথক করেও দেখেছেন। যার জন্যে তিনি সে পরমাত্মীয়ের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্য উৎকন্ঠিত হয়ে উঠেছেন।-
আমি যাইমুরে,
আমি যাইমুরে,
আল্লাহর সঙ্গে,
হাছন রাজা আল্লাহ বিনে
কিছু নাতি মাঙ্গে।
জান্নাতুল ফেরদাউস নয়, তাঁর একমাত্র কাম্য হলো মানুষ আল্লাহ, পরমাত্মার সাথে জীবাত্মা মিলনোম্মুখ হাসন রাজার আরাধ্য ¯্রষ্টা হিন্দুদের ঈশ্বর কিংবা শুধুমাত্র মুসলমানদের আল্লাহ (শব্দগতভাবে) নয়। তাঁর কাঙ্খিত শাশ্বতঃ পুরুষ বিশ্ব¯্রষ্টা। কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের একার নন তিনি। তাইতো হাছন রাজা সে বিশ্ব¯্রষ্টাকে বিভিন্ন নামেই ডেকেছেন। তাঁর মন যখন যা কল্পনা করেছিল-
দয়াল কানাই দয়াল কানাইরে,
পার করিয়া দাও কাঙ্গালিরে।
ভবসিন্ধু পার হবার জন্য যে পুন্যার্জনের প্রয়োজন, তাঁর ধারণা হয়তোবা তাঁর তাই নেই, তা তিনি পরমেশ্বরের নিকট আকুল প্রার্থনা করেছেন, তাঁকে যেন ক্ষণস্থায়ী এ ধরাধাম থেকে অনন্ত লোকে পৌঁছে দেয়।
তাই তিনি গেয়েছেন-
কেন আইলাইনারে কালাচান্দা,
বাঁশিটি বাজাইয়া
আমারে লইয়া যাও পরান।
রাধার দুঃখে তাঁরও ভীষণ দুঃখ, লাভ এপিসোড অব রাধা কৃষ্ণ তাঁর জানা, যার ফলে রাধার দুঃখে ব্যথিত হয়ে হাছন রাজারও কান্না পায়। তাঁর বুক ফেটে যেতে চায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাধা হচ্ছে মানবতার প্রতীক। আর কৃষ্ণ হচ্ছে ¯্রষ্টার প্রতিবিম্ব। রাধা কৃষ্ণের প্রেমে মশগুল। কৃষ্ণের কথা ভাবতে ভাবতে প্রেমিকা রাধার দেহ ক্ষীণকায় হয়ে যায় এবং সে মুর্ছিতা হয়ে পড়ে। তবে কেউর কেউর মতে রাধা ও কৃষ্ণ একই সত্ত¡ার দুই রূপ।
‘রাধা কৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহধরি,
অন্যান্যে বিলসয় রসাম্বাদন করি।’
প্রাণপাখী খাঁচায় ধরা দিয়েও পালিয়ে যায়, মুক্তাকাশে, অনন্তে। সীমা ছাড়িয়ে মিশে যায় অসীমে। আর তাঁকে খুঁজে ফিরেন হাছন রাজা।
কোথায় পাব তারে-
আমার মনের মানুষ যেরে
হারায় সেই মানুষ তার উদ্দেশ্যে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
অনেক খোঁজা খুঁজির পরও তাকে
ধরা যায়না।
তারে কেউ ধরিতে না পারে-
একটি থাকে মর ঘরে
ঘরে থাকে, বাইরে থাকে
থাকে সে অন্তর।
সৃষ্টিকর্তা সর্বময়। সর্বত্র বিরাজমান। প্যানথিজমেন মতো, সব কিছুতেই সৃষ্টিকর্তা। প্রখ্যাত দার্শনিক, বেনেডিক্ট পিনোজাও এ কথাই বলেছিলেন, (কুরআন শরীফে আছে পূর্ব পশ্চিম আল্লাহরই, সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাবে, সে দিকেই আল্লাহ’র সম্মুখ আল্লাহ সর্বব্যাপি, সর্বজ্ঞ, (২.১১৫)। মনের মানুষ যে মানুষের অন্তরেও বাসা বেঁধে রয়েছে। তা হাছন রাজারও অজানা নয়।
আমার পাগল মনে কি বুঝিল
আমার মাঝে কুনজন
তাঁরে খুঁজলনা
ঠাকুর যে ঘরের মাঝে
তারে চেয়ে দেখলনা।
সাধন-ভোজন, ধর্মকর্ম ও ঈশ্বরানুসন্ধানের পথে চলতে গিয়ে বেশীরভাগ সময়ই আমরা বাহ্য উপকরণ, আচার নিষ্ঠা ও আনুষ্ঠানিকতা পুনরাবর্তনের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে ভাবতে থাকি, এ বুঝি- আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন সফল হলো, সার্থক হলো। কিন্তু হাছন রাজার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।
‘পাবেনা পাবো খোদা
নামাজ রোজা কইলে।
খোদা যদি ধরতে চাও
তার সঙ্গে পিরিত বাড়াও।
তাঁর মতে যতই আমরা তসবিহ জপি কিংবা মালা জপি না কেন, একাগ্রচিত্তে আল্লাহর প্রেমে ডুবে না থাকতে পারলে তাকে পাওয়া দুঃসাধ্য। মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে একান্তচিত্তে তাঁকে পাবার জন্য কামনা করতে হবে।
বন্ধের সনে প্রেম করিবার
বড় ছিল আশা,
ভবের জবালে ফেলে করিলে দুর্দশা,
স্ত্রী পুত্রের পরিজন, ঘর-সংসার, জমিদারী এসব উপাসনায় বিঘœ ঘটায়। তবে তিনি বাধার প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে দৃঢ়চিত্ত। অন্তরঙ্গ বন্ধু আল্লাহর সঙ্গে মিলনের জন্যে পাগল প্রায়। হাছন রাজা পরমেশ্বরকে ভজনা করেন বিভিন্ন নামে। তাঁকে ডাকেন পিয়ারী প্রাণ, জান, প্রিয়া, আবার কখনো বা মন মোহিনী বলে। কখনো তাঁকে মনে করেন বন্ধু; কখনো কখনো মাতৃরূপেও কল্পনা করেন। যেমন- ‘হাছনরাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলরে, ইন্দিয় নয়, ভাব দিয়ে দেখতে হবে ¯্রষ্টাকে। তাই প্রকাশ পায়……….’ আর দিলের চক্ষে চাহিয়া দেখ বন্ধুয়ার স্বরূপরে। এ ‘বন্ধুয়াকে’ দেখার জন্যে তাঁকে অনেক জ্বালা যন্ত্রণা সইতে হয়েছিল। তবুও নিরস্থ হননি। তোমার সাথে প্রেম করিয়ে হইলাম পেরেশান। ¯্রষ্টার রূপে বিমুগ্ধ ভক্ত হাছন গায়।
হেরিয়েগ তার রূপের চটক,
মাইলগ মদনে
তিনি ¯্রষ্টাকে দেখেছেন আঁখি মেলে নয়, স্বপ্নের ঘনঘোরে। তাঁকে পাবার জন্যে, দেখবার জন্যে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ডেকেছেন তিনি।
ও বন্ধু অন্তরিয়ারে,
না দেখিলে চান্দমুখ
আমার প্রাণ যায়রে।
হাছন আকুল আবেদন নিবেদনের পর ¯্রষ্টাকে যেভাবে দেখতে পান ‘স্বপনে দেখিলাম তারে, না দেখি জাগিয়া।’ শুধু দেখেই ক্ষান্ত হননি তিনি। কথাও শুনেছেন আল্লাজি থেকে। প্রাণনাথ স্বপ্নের মাঝেই কথা বলেছিলেন- ‘তোমার আমি আমার তুমি’ হাছন রাজা প্রাণপ্রিয়াকে হাতছাড়া করতে চাননা। তাঁকে আটকে রাখতে চান- ‘প্রেমের বান্ধন বান্ধবে, দিলের জিঞ্জিরে দিয়া।’ এভাবে তিনি এক সময় ¯্রষ্টাতে বিলীন হয়ে যান। সৃষ্টি ও ¯্রষ্টা একাকার হয়ে যায়। প্রভেদ থাকেনা একরত্তিও। জীবন ও শিব এক সত্ত¡ায় রূপান্তরিত হয়ে যায়-
‘আমি রাধা আমি কানু
আমি শিব শঙ্করী
অধর চাঁন্দ হইত আমি
আমি গৌর হরি।’
এভাবেই তিনি এক সময় আমিত্বকে ভুলে যান। হাছন রাজা যেমন ছিলেন খোদা প্রেমিক, তেমনই ছিলেন মানবপ্রেমিক। খোদাকে তিনি পৃথক সত্ত¡া হিসাবে না দেখে প্লেটোর মতোই বহুর মধ্যে ‘এক’কে দর্শন করেছেন। সৃষ্টির ভিতরই ¯্রষ্টাকে উপলব্ধি করেছেন। আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে নয় প্রেম দিয়েই তিনি ¯্রষ্টাকে লাভ করতে চেয়েছেন। প্রেমেই জয়। সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..