শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৪ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : জেলা পরিষদ নির্বাচনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরে দাঁড়াতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। পিরোজপুরে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজ ঢাকায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের পরে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। জয়পুরহাটে চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল আজিজ মোল্লা (আগেই বহিস্কৃত) দলে ফিরিয়ে নেওয়ার শর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন।
বিভিন্ন জেলায় গতকাল রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে ৩২ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী, ৬৯ জন সংরক্ষিত সদস্য ও ৩২৮ জন সাধারণ সদস্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এসব স্থানে জোর করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানো এবং প্রার্থীর প্রস্তাবক-সমর্থকদের হুমকি-ধমকি দিয়ে মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর না দেওয়ার স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের তৎপরতা জেলা পরিষদ নির্বাচনী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
জেলা পরিষদ (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালার ৩০ ধারায় নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখার বিষয়ে বলা হয়েছে- ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কর্তৃক বা তাহার পক্ষে অর্থ, অস্ত্র ও পেশিশক্তি কিংবা স্থানীয় ক্ষমতা দ্বারা নির্বাচন প্রভাবিত করা যাইবে না।’ এই আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৬ মাসের জেল বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে আচরণবিধিতে।
জোর করে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানো এবং প্রার্থীর প্রস্তাবক-সমর্থকদের হুমকি-ধমকি, মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর না দেওয়ার স্বীকারোক্তি নেওয়ার মতো ঘটনায় ইসির পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ইসি বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখবে। প্রমাণিত হলে নির্বাচনের পরও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তখন প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২৬ জেলার চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থী থাকায় তাঁরা সবাই বিনা ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় সংরক্ষিত সদস্য পদে ১৯ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ৬৮ জন বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। চেয়ারম্যান পদে বাকি ৩৫ জেলায় ৯১ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে রয়েছেন। এদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। দলের এসব বিদ্রোহী প্রার্থীকে বশে আনতে নানা তৎপরতা চালানো হলেও তা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার শেষে ৬১টি জেলার সংরক্ষিত সদস্য পদে লড়াইয়ে টিকে আছেন ৬২০ জন। সাধারণ সদস্য পদে লড়াই করছেন এক হাজার ৫০৫ জন।
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সাধারণ ও সংরক্ষিত সদস্য পদে আগামী ১৭ অক্টোবর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ করা হবে। ওই দিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের ৬৩ হাজারের বেশি জনপ্রতিনিধিরা এই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। তাঁদের ভোটে প্রতিটি জেলা পরিষদে একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সাধারণ সদস্য এবং ৫ জন সংরক্ষিত সদস্য নির্বাচিত হবেন।
বিনা ভোটে বিজয়ী ২৬ চেয়ারম্যান প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত। দলীয় প্রতীকে এই নির্বাচন না হলেও আওয়ামী লীগ সবগুলো জেলার চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এই নির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি। বিনা ভোটে জয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থীদের জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে- কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর, ঝালকাঠি, টাঙ্গাইল, ঠাকুরগাঁও, ঢাকা, নওগাঁ, নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, পিরোজপুর, ফেনী, বরগুনা, বরিশাল, বাগেরহাট, ভোলা, মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ ও সিলেট।
আমাদের জয়পুরহাট প্রতিনিধি জানান, দলে ফেরার শর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন জয়পুরহাটের চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল আজিজ মোল্লা। যদিও এখানে চেয়ারম্যান পদে ৫ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও লড়াইয়ে রয়েছেন দু’জন। বাকিরা সবাই প্রত্যাহার করেছেন। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জয়পুরহাট-২ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আজিজ মোল্লা। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হন। যদিও নির্বাচনের তিন দিন আগে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে পরে তাঁকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। তিনি জানান, হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন তাঁকে ফোনকল দিয়েছিলেন। হুইপের অনুরোধে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
হুইপ স্বপনও বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী খাজা শামছুল আলমকে নির্বাচিত করার স্বার্থে আব্দুল আজিজ মোল্লাকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য তিনি অনুরোধ করেছেন।
খুলনা ব্যুরো জানায়, চেয়ারম্যান পদে লড়াইয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক ও বর্তমান তিন নেতা। জেলা শাখার সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ দলীয় সমর্থন পেয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলার সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ডা. শেখ বাহারুল আলম ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোর্ত্তজা রশিদী দারা।
ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. শাহাদাৎ হোসেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের অর্থ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করলেও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। তিনি শুরুতে দলের সমর্থনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমর্থন না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তিনিসহ এই জেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী তিনজন।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, এই জেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দুই নেতা সরাসরি লড়াইয়ে নেমেছেন। এখানে অন্য কোনো প্রতিনিধি নেই। এবার দলীয় সমর্থন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খায়রুল কবির রুমেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট।
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, এই জেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দু’জন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তাঁরা হলেন- জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ূন রুমান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ জাকারিয়া (বিষু)। আওয়ামী লীগ অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার পালকে সমর্থন দিয়েছে।
নাটোর প্রতিনিধি জানান, এই জেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের সাজেদুর রহমানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাতীয় পার্টির ড. নুরুন্নবী মৃধা। জাপা প্রার্থীর মনোনয়ন বাছাইয়ে বাতিল ঘোষণা হলেও আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন।
রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানান, আওয়ামী লীগ সমর্থিত শফিকুল মোর্শেদ আরজুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন দীপক কুণ্ডু। তাঁকে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য দলীয়ভাবে নানা চাপ দেওয়া হলেও তিনি দমে যাননি। পাংশা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতুর সরকার জানিয়েছেন, দীপক কণ্ডুর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
পিরোজপুর প্রতিনিধি জানান, এই জেলায় চেয়ারম্যান পদে ৬ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। একজনের মনোনয়ন বাতিল ও গতকাল চারজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সালমা রহমান হ্যাপি বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন। এই জেলায় চেয়ারম্যান পদের সব কয়েকজন প্রার্থী ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী। এর মধ্যে মহিউদ্দিন মহারাজ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।
জেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পর ২০১৬ সালে প্রথম নির্বাচন হয় স্থানীয় সরকারের এ প্রতিষ্ঠানে। গত বছর মেয়াদ শেষ হলেও বিদ্যমান আইন সংশোধনে বিলম্ব ঘটায় কে এম নূরুল হুদা নির্বাচন কমিশন জেলা পরিষদ নির্বাচন করতে পারেনি। ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলায় একবারই সরাসরি নির্বাচন হয়েছিল। এরপর আর কোনো জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়নি। ১৯৮৮ সালে এইচ এম এরশাদ সরকার প্রণীত স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে সরকার কর্তৃক নিয়োগ দেওয়ার বিধান ছিল। পরে আইনটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। ২০০০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠনের জন্য নতুন আইন করে। এরপর ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকার ৬১ জেলায় আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতাদের প্রশাসক নিয়োগ দেয়। অনির্বাচিত এই প্রশাসকদের মেয়াদ শেষে ২০১৬ সালে ভোট হয়। জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে গত ৬ এপ্রিল ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল-২০২২’ সংসদে পাস হয়। ১৩ এপ্রিল সংশোধিত জেলা পরিষদ আইনের গেজেট প্রকাশ করা হয়।