সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০২:২১ অপরাহ্ন
আজিজুর রহমান। জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩, গুজার্্াই, মৌলভীবাজার। ¯্রােতস্বিনী মনু তীরেই শৈশব ও কৈশোরের বেড়ে ওঠা। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে আবাল্যের ভালোবাসা। নাট্যকর্মী হিসেবে নাটকে অভিনয় ও পরিচালনার সঙ্গে জড়িত থেকেছেন দীর্ঘসময়। পাশাপাশি ত্যাগী রাজনীতিবিদের সুনাম নিয়ে এখনও সম্পৃক্ত আছেন পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চায়। ২৭ বছর বয়সে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭০ সালে। এরপর তিনি আরো পাঁচ বারের মত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মৌলভীবাজার-রাজনগর নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। কখনো জিতেছেন কখনো বা হেরেছেন। কিন্তু তাঁর সৌহার্দ্যপূর্ণ পথচলা থেমে থাকেনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সংসদে বিরোধী দলের হুইপ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তখন এবং এখনও কাজ করে যাচ্ছেন। ১৪ ভাই বোনের বৃহৎ সংসারে পারিবারিক দৃঢ় বন্ধন ও সম্প্রীতি সত্যিই অনুকরণীয় এবং প্রশংসার দাবী রাখে। নিজে ঘর-সংসার না করলেও পারিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তিনি একজন দায়িত্ববান সংসারিও বটে। নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং একই সঙ্গে পরিবারের অধিক সংখ্যক ব্যক্তির মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নজির হয়তো খুব কমই রয়েছে। মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ‘ফসল’ এর জন্য প্রবীন সংস্কৃতিকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমানের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মাহফুজুর রহমান।
মাহফুজুর রহমান : শীতের এই সকালে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই। যৌবনে আপনি একজন নাট্যকর্মী তথা সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে রাজনীতিতে আসেন। সেই রোমান্টিক তছুণ থেকে এখন আকর্ষণীয় প্রবীণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। এ পর্যায়ে এসে শৈশব, কৈশোর ও যৌবনকে কীভাবে দেখেন?
আজিজুর রহমান : আপনাদেরে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা । আর রক্তিম শুভেচ্ছ রইল তাদের, যারা আগামী দিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা পালন করবে। একটি গানের কলি মনে হচ্ছে-
ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
বলো কোথায় তোমার দেশ তোমার নেই কী চলার শেষ।
জীবনটা হচ্ছে ¯্রােতস্বিনী নদীর মতো। যখন কোনো প্রবাহ থাকে না তখনই নদী মরে যায়। অজস্র আবর্জনা এসে ঘিরে ফেলে। কর্মই হচ্ছে জীবন, অতএব কর্মের মধ্যে জীবন নদীতে বেঁচে থাকতে চাই।
লেখা পড়ার পাশাপাশি মূলত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিলাম। মনে আছে স্কুল জীবনে পাড়া প্রতিবেশী যুবকরা মিলে শীতের মৌসুমে, ধান কাটা শেষ হয়ে গেলে, পরীক্ষার পর আমরা ছোট ছোট নাটক করতাম। কেদার রায়, ইশা-খা, টিপু সুলতান, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, বাওয়াল সন্নাসী ইত্যাদি। তখন কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না। আমরা পেট্রমাস জ্বালিয়ে নাটক করেছি। মঞ্চ তৈরি হতো মা বোনের শাড়ি-কাপড় দিয়ে, লুকিয়ে নিয়ে যেতাম, অনেক কাপড় নষ্ট হয়েছে, কত বকুনি পিটুনি খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কলেজ জীবনে বিভিন্ন উৎসব, নববর্ষ উদযাপন, বসন্ত উৎসব, বর্ষা বরণ, রবীন্দ্র, নজরুল জয়ন্তী এবং বিভিন্ন নাটকের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের পক্ষে মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। প্রতি মাসেই একটা না একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকতো। এর মধ্যে নাটকের সংখ্যাই বেশি ছিলো। একজন নাট্য কর্মী হিসেবে বহু নাটক পরিচালনা করেছি। বিশেষ করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, বঙ্গে বর্গী, শাহাজাহান, কণা-অর্জুন, পাহাড়ী ফুল, বেকার নিকেতন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, সোনার হরিণ এবং প্রদীপ শিখা ইত্যাদি। ষাট এর দশকে প্রদীপ শিখাতে প্রথম মৌলভীবাজারে নারী চরিত্রে নারীরা অভিনয় করেন। আমি যখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হই তখনও নাটকে অভিনয় করেছি। আজকে বোধহয় সাহস করা যেতো না। আমার মনে আছে কবিগুর” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর বিশেষ করে তাঁর গানের ওপর এক প্রকার বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। ঠাকুরের সাহিত্যের উপরও বিধি নিষেধ ছিল। তখনই আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরো বেগবান হয়। আমরা যে শ্লোগানটি তুলে ধরেছিলাম সে হচ্ছে।
তোদের বাধন যতো শক্ত হবে
মোদের বাধন টুটবে।
রাজনীতির প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, আজ পর্যন্ত কোনো দিনই রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ট আত্মীয়তা গড়ে তুলতে পারিনি। তারপরও বলি রাষ্ট্র এবং রাজনীতি অতপ্রোতভাবে জড়িত। রাষ্ট্র থাকলে রাজনীতি থাকবে এবং সত্যিকার রাজনীতি হচ্ছে মানবসেবার সর্বোত্তম পন্থা। সুশাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম রাজনীতির মূল কথা হওয়া উচিত। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা একজন রাজনৈতিক কর্মীর মূল ল’ হওয়া উচিত। বর্তমান যুগে এই ভোগবাদী সমাজব্যবস্থায় রাজনীতিতে টিকে থাকা খুবই কঠিন। এর মধ্যেও একটি আত্মতৃপ্তি আছে। চেষ্টা করছি।
আমার কৈশোর আর যৌবন ছিল সংস্কৃতি ও সমাজসেবার সঙ্গে জড়িত। সৈয়দ মহসিন আলীর ছোট মেয়েরা এবং বেশ কিছু মামনীরা ও ছেলেরা আমাকে ফুল চাচা ডাকতো। যৌবনে সুমি (রবীন্দ্র মাস্টারের মেয়ে) সহ ছেলে মেয়ে, মুরব্বি, বন্ধু-সহকর্মীদের কাছে নৌকা ভাই, নৌকা চাচা, নৌকা মামা নামেই পরিচিত ছিলাম। অর্থাৎ আমি আর রাজনীতি (নৌকা) একসময় একাত্ব হয়ে গিয়েছিলাম। একা জীবনতো, তাই চাওয়ার এবং হারাবার কিছুই ছিলো না।
মাহফুজুর রহমান : জন্ম, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এবং শিক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলুন।
আজিজুর রহমান : জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩। পিতা – মরহুম আব্দুস সত্তার (আকলু মিয়া)। মাতা – মাহমুদা খাতুন (কাঞ্চন) ও রহিমা খাতুন,আমার দুই মা। ভাই বোন ১৪ জন। ছোট বেলায় একজন মারা যান। সব বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম [মানিক মিয়া], মাহমুদুর রহমান (সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যন), খুরশেদ আহমদ (বীর মুক্তিযোদ্ধা) নজমুল ইসলাম (এরা আর এ জগতে নেই, আলাহ তাদের,বেহেস্ত নসিব করুন।) জহির আহমদ (লন্ডন প্রবাসী), জমসেদ (কানাডা প্রবাসী), শামসুল (লন্ডন প্রবাসী), জামাল (জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার) দেশে। আমার ৪ বোন, সবার বড় সালেমা খাতুন। এরপর রানী বেগম, সুলতানা বশির, খালেদা বেগম। মেট্রিক ১৯৫৯ সাল, মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ইন্টারমিডিয়েট ১৯৬২ মৌলভীবাজার কলেজ, ডিগ্রি ১৯৬৫ সাল, পড়াশুনা করেছি ঢাকা কলেজে ।
মাহফুজুর রহমান : মনু নদীর তীর ঘেষে বেড়ে ওঠা। নিজের বয়:বৃদ্ধির সাথে নদীর ও বয়স বেড়েছে, পরিবর্তিত হয়েছে। নদীর পরিবর্তনের রূপ এবং বাল্য-কৈশোরের তিতে এর কোনো প্রভাব থাকলে বর্ণনা করুন।
আজিজুর রহমান : মনু পাহাড়ি একটি খরস্রোতা নদী, বর্ষাকালে এর রূপ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। মনু নিয়ে অনেক গল্প আছে। এতদ অঞ্চলের নদীগুলোর নাম ধলাই, ফানাই, কন্টিনালা, জুড়ী, খোয়াই। এই নাম গুলোর মাঝে পাহাড়ি পাহাড়ি একটা গন্ধ আছে (সবগুলাই পাহাড় হতে প্রবাহিত হয়েছে)। মনু সম্বন্ধে যে গল্পটি চালু আছে তা হলো- মনু নাকি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে অন্ধমনুর কাছে গিয়েছিলেন। অন্ধমনু প্রত্যাখান করলে মনুরসেই রাগ প্রকাশ পায় ভয়ঙ্কররূপে এবং এ কারনেই না কি প্রতি বৎসরই মনুতে দুই একজন মানব সন্তানকে আত্মাহুতি দিতে হয়। এসব কুসংস্কারে আমার আস্থা না থাকলেও অনেকেই এ অন্ধবিশ্বাসকে লালন করেন। আমার জন্মের সময়টাতেই মনু ব্রীজ তৈরি হয়। আমার ছোট বেলা বিকেলে মনু নদীর ব্রীজে বন্ধু বান্ধব মিলে আড্ডা মারতাম। কলেজে পড়ার সময় গরমের দিনে পাটি বালিশ নিয়ে মনু নদীর ব্রীজের উপর আমরা আড্ডার আসর বসাতাম। আব্দুর রাজ্জাক চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে রশিদের একটি টু-ইন-ওয়ান ছিলো। আমরা ২৭ বন্ধু ও অন্যান্য বন্ধু মিলে অনুরোধের আসর শুনতাম। দুই এক জন গায়ক ছিলো যাদের মধ্যে সুনির্মল কুমার দেব মিন এর গলা ছিলো সবচেয়ে ভালো যা চিন্তা করা যাবে না। সে সময় কচিৎ দুই একটি রিস্কা পুলের ওপর দিয়ে চলাচল করতো। মাসেও একটি গাড়ির দেখা পেতাম না।
মনুর খর¯্রােতা ভয়ঙ্কর রূপের প্রতিফলন ঘটেছে আমার জীবনে। স্বায়ত্ত¡শাসন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রচন্ড বেগে কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি, মাথানত করিনি। আবার ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটু জল থাকে’। মনু নদীর শীত মৌসুমের এই শান্ত রূপ ঠিক আমার মতো- ‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে’।
মাহফুজুর রহমান : রাজনীতিতে কীভাবে এলেন?
আজিজুর রহমান : আমি মূলত সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। আমার ধারনায় নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-কৃষ্টির ভিত্তি যদি মজবুত না হয় তাহলে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ শক্তিশালী হওয়া সম্ভব নয়। ১৯৬৮ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু যখন এক মামলা থেকে আরেক মামলায়, এক জেল থেকে আরেক জেলে, ’৬৬ এর ছয় দফা ঘোষণার পর থেকেই তাঁর উপর নির্যাতন নিষ্পেষণ চলছিলো তখন তিনি মৌলভীবাজার হয়ে সিলেট যাচ্ছিলেন। মৌলভীবাজার তাঁর কর্মসূচি ছিলো এবং আমি খবর পেয়েছিলাম তিনি আমাকে সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে সরাসরি রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ে যাবেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী সাহেব এবং অন্যান্যরা আগে থেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করছিলেন। অন্যদিকে পীর হাবিবুর রহমান সাহেবও যোগাযোগ রাখছিলেন। আমি রাজনীতির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু যেদিন মৌলভীবাজারে আসেন কিছুটা ইচ্ছা করে এবং বিশেষ করে আমার বন্ধু বারীর বিয়ের কন্যা দেখতে সিলেটে চলে যাই। বঙ্গবন্ধু মৌলভীবাজারে এসে আমার খোঁজ নিয়েছেন। আমি আমার বন্ধু বারী আর হুমায়ূন সহ সিলেট থেকে আসার পথে কীনব্রীজ পার হয়ে ত্তিার কাছাকাছি এলে আমাদের ড্রাইভার গাড়ী আটকে দেয়। সামনের রাস্তায় লোকজন ও গাড়ী ঘোড়ার কারনে বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি বুঝার জন্য গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়িয়েছি। এমন সময় দেওয়ান ফরিদ গাজী কপ করে আমার হাত ধরে বলেনÑ ‘তুই কোথায় গিয়েছিলি, চল, মুজিব ভাই তোকে খোঁজছেন’। আমাকে টেনে রাস্তার কাছেই একটি বড় বাড়ি ছিলো ‘সর্দার বাড়ি’ সেখানে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে দাড় করিয়ে দেন। গাজী ভাই বলেন আজিজকে এনেছি, রাজনীতিতে আসতে চায় না। আমি বললাম, না না স্যার, আমি তো বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করছি, রাজনীতি বড় ই…য়ে, আমি ঠিক ভালো বুঝি না। তাঁর কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, তিনি ডান হাত দিয়ে আমার পিঠে একটি কিল মেরে বললেন পঁচিশ বছরে না বুঝলে, আর কবে বুঝবে। হুকুম করলেন মুনিম ভাই কে (বৃহত্তর সিলেট জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক) মুনিম, আজিজ আওয়ামী লীগে যোগ দেবে তুমি তার স্টেটমেন্টটা সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়ে দাও। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী বঙ্গবন্ধুর এক থাপ্পড়ে হয়ে গেল একজন রাজনৈতিক কর্মী। শুরু হলো নবযাত্রা। শেষে বুঝেছি যে, মৌলভীবাজারে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে দেওয়ান আব্দুল বাছিত (মন্ত্রী), হাজী এনামুলাহ (এম.পি.এ.), আব্দুল মজিদ খান ( এম.পি.এ.) আহমদুর রহমান খান (’৫৬ এর এম.এল.এ) এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ বহু বড় মাপের নেতা কনভেনশন মুসলীমলীগে ছিলেন। ’৫৬ তে মৌলভীবাজারে যুক্তফ্রন্ট জিততে পারেনি। এইসব কারণেই বোধহয় বঙ্গবন্ধু আমাকে রাজনীতিতে নিয়ে এসেছিলেন।
মাহফুজুর রহমান : ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় যারা কম বয়সে প্রাদেশিক পরিষদ (গণ পরিষদ) নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন তার মধ্যে আপনিও একজন। রাজনীতিতে যোগদানের পর পরই জনপ্রতিনিধি হওয়ার আনন্দ-স্ম”তি আজও আপনাকে আলোড়িত, উদ্বেলিত করে কী?
আজিজুর রহমান : ’৭০ এর নির্বাচন বাংলাদেশের তথা পাকিস্থানের ইতিহাসে একটি মাইল ফলক। একদিকে বাম রাজনৈতিক দলগুলো ৬ দফা নিয়ে সংশয়ের মধ্যে ছিলেন, কেউ কেউ এটাকে সিআইএ এর দলিলও বলেছেন। অন্যদিকে আমেরিকান যে বলয় ছিলো সেখানে পাকিস্থান মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে নেতৃত্ব দানকারী একটি দেশ ছিলো। আরেক দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিসিঞ্জার চীনের সঙ্গে একটি ডিপ্লোমেটিক সমঝোতা (পিং পং ডিপ্লোমেসি) ভায়া পাকিস্থান খুব জোরেসুরে চলছিলো। কোনো কারণেই আমেরিকা, কিসিঞ্জার এবং তাদের মিত্র দেশগুলো এটাকে ভালো চোখে দেখছিলো না। আবার সামরিক জানতা ইয়াহিয়া খানের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া, পাকিস্থানের লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে শরিক হওয়া, ’৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু সেই মহা মানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিটারমাইন্ড ছিলেন যে জনগণের মেনডেট নিতে হবে এবং নির্বাচনে যেতে হবে। আমি ২৭ বছর বয়সেই পাকিস্থান ভিত্তিক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। একটি কথা এখানে উলেখ থাকা প্রয়োজন, এই নির্বাচন হবে প্রায় একটি রেফারেন্ডাম। নির্বাচন কেবল এমপিএ’র দায়িত্ব পালন করার জন্য নয়। এ নির্বাচন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পাথেয়, হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্যও নির্বাচন ছিল জরুরী এবং বাস্তবে তাই ঘটেছে। তবে প্রতিবেশি দেশগুলা বিশেষ করে ভারত নি:শর্ত সহযোগিতা করেছে। এই নির্বাচনের বিজয়ী সদস্যদের নিয়েই মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়েছিলো। জাতির মুক্তির সংগ্রামে বিশ্বের যতগুলো প্রবাসী সরকার গঠিত হয়েছে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য, অতুলনীয়। নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাবলী আজো আমাকে আলোড়িত, আন্দোলিত করে।
মাহফুজুর রহমান : অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের আহŸায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্র¯’তি পর্বের দিনগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।
আজিজুর রহমান : ’৭০ এর নির্বাচন, ৭১ এর গণঅভ্যূত্থান বাঙালি জাতিস্বত্তার এক অনন্য অধ্যায়। প্রায় প্রতিদিনই ছিলো ঘটনাবহুল, পাল্টে যা”িছলো আন্দোলনের গতিধারা। ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে আহুত জনসভায় নৌকার আদলে গড়া মঞ্চে ’৭০ এ নির্বাচিত সদস্য প্রতিনিধিদের শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়। সেই নৌকায় পালটি বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে টানানো হয়। সে এক অপূর্ব দ”শ্য। পালটি উঠানো ছিলো নৌকার মাঝখানে একটি মা¯’লের মাথায় (এখানে কারো নাম নিতে যা”িছ না)। রশি বঙ্গবন্ধুর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু যখন রশিতে টান দেন তখন পালটি নেমে আসে আর পালের মধ্যে গুজিয়ে রাখা অসংখ্য ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ে মঞ্চে। দেখা যায় এই পালটি বাংলাদেশের প্রথম পর্যায়ের জাতীয় পাতাকার একটি নমুনা। পালের বুকে বাংলার একটি মানচিত্র আকা। সেই ঐতিহাসিক শপথ বাক্যটি ছিলো ৬ দফার প।ে ঘোষণা করা হয়েছিলো ‘হয় ৬ দফা নয় ১ দফা’। পাল্টে যায় সম¯- রাজনৈতিক চিত্র। শুর” হয় কূটনৈতিক যুদ্ধ। পাকি¯’ান থেকে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা যোগাযোগ করেন। অপরদিকে আমরা যারা বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম, জানতাম স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিকল্প কিছু নেই। নিজেদের সেই ভাবেই প্র¯’ত করে নি”িছলাম। সে কী প্রচন্ড কাজের গতি, রাত দিনের তফাৎ ছিলো না। জেলা শহরে, মহকুমা শহরে, থানায়, ইউনিয়নে, গ্রামের হাট বাজার গুলোতে একের পর এক মিটিং চলছিলো। একদিনের ঘটনা বলি, তখন আমাদের যোগাযোগ ব্যব¯’া কিছুই ছিলো না। ১ ইঞ্চি রা¯’াও পাকা ছিলো না, পাথরের রা¯’া ছিলো দু’একটা। গ্রামে কোনো রা¯’ার অবকাঠামো ছিলো না। বর্ষা মৌসুমে গোপাট (খাল) দিয়ে নৌকায় লোকজন চলাচল করতো। শুকনো দিনে শ্রীচরণ ভরসা। আমাদের একগু”ছ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, নদীর তীর দিয়ে যাতায়াত। আখাইলকুরা বাজার হতে রওয়ানা হয়েছি। কোনো যানবাহন ছিলো না তাই আমাদের সঙ্গে একজন লোক নিয়েছি। তার কাঁধে একদিকে একটি মাইকের চোঙ্গা, অন্যদিকে ব্যাটারি আর হাতে এমপ্লিফায়ার। পালপুর, ইসলামপুর, জাহিদপুর, শাহপুর, বেড়কুড়ী হয়ে বালাগঞ্জ। বাজারে বাজারে মিটিং করে যা”িছ। বালাগঞ্জ বাজারে মিটিং শেষ। রাতে রওয়ানা হয়ে মোকামবাজারে এসে মিটিং করেছি, সেখান থেকে হাওড়ের মধ্য দিয়ে হেটে, ফতেপুর গ্রামে রাতে বারটা সাড়ে বারটায় মিটিং করি। রাত আড়াইটার কাছাকাছি অšে-হরি আসি। দেখি ন্যাড়াদিয়ে আগুন জ্বালিয়ে কয়েকশত লোক আমাদের অপো করছে। অšে-হরির মিটিং শেষ করে ভাবলাম আমাদের কর্মসূচি বোধহয় শেষ হলো। কিš’ আখাইলকুরা বাজারে এসে দেখি রাতের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ভোর রাত্রিতে শ পাঁচেক লোক বসে আছে। সেই সময়টাতে মানুষের মধ্যে এরকম উন্মাদনা কাজ করেছে। মাইকের তখন আর দম নেই, অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। গলার উপর ভরসা, গলার অব¯’াও তখন ফাটা বাঁশির আওয়াজের মতো। কোনোমতে আখাইলকুরার ঘাটদিয়ে নদী পার হয়ে কামালপুর বাজারে আসি। একপর্যায়ে রা¯’ার উপরে শুয়ে পড়ি। বিশ্বাস কর”ন, তখন রা¯’া দিয়ে কখন গাড়ি আসবে যাবে তা কল্পনা করা মুশকিল ছিলো। এমন সময় একটি ট্রাক আলাহর রহমত স্বরূপ আসে। সে আমাদের দেখতে পেয়ে গাড়ি থামায়, চিৎকার দিয়ে উঠে, একী অব¯’া আপনাদের! তার পর একে অন্যকে সাহায্য করে ট্রাকের উপরে শুয়ে পড়ি। যে যার গš-ব্যে পৌঁছি ঠিকই কিš’ হাতে তো সময় নেই। দশটা থেকে আবার প্রোগ্রাম শুর” করতে হবে। সেই দিন নেতৃব”ন্দ, কর্মীরা যদি কঠোর পরিশ্রম না করতেন তাহলে কী স্বাধীনতা পাওয়া যেতো? ১৯ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার ইন্সটিটিউট এ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কাস কমিটি ও ’৭০ এর নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদেরকে মিটিং এ অহŸান করা হয়েছে। মিটিং শুর” হওয়ার পর সকলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরিচয় দি”েছন। নোয়াখালীর বিসমিলাহ মিয়া দাঁড়িয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলেলেন, ‘হে বিসমিলাহ, তোর নাম নিয়েইতো শুর” করেছি, বস’। একেকজন দাঁড়া”েছন আর বঙ্গবন্ধু তার নাম বলে তার সমস্যার কথা বলে দি”েছন। মনে হলো একটা বিশাল দর্পন যেন সারা বাংলাদেশ ধারণ করে রেখেছেন। আমাদের উপরে হুকুম হলো তোরা এলাকায় চলে যা, সামগ্রিক প্র¯’তি নিয়ে রাখ। এরই মধ্যেই শুর” হয় খন্ড খন্ড সংঘর্ষ। ১ মার্চ জাতীয় সংসদ অধিবেশন ¯’গিত করে দেওয়া হয়। গণআন্দোলন তখন আকাশচুম্বী। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসমুদ্রে ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তব্যটি রাখেন। ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শুর হয় চতুর্দিকে বিদ্রোহ, অসহযোগ আন্দোলন। দেশ চলে তখন সেই মহামানুষের নির্দেশে, তারই অঙ্গুলি হেলনে। আসে ২৫ মার্চ, সেই কালো রাতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে ঝাপিয়ে পড়ে হায়েনার দল। বাঙালি জাতীর উপর আক্রমণ চালায় বাজারবাগ পুলিশ লাইনে, পিলখানার ইপিআর বাহিনীর উপর। হত্যা করে নিরীহ নিরস্ত্র ঘুমš- মানুষদের। সেই সময় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআর এর ওয়ারল্যাস এর মাধ্যমে ২৬ তারিখের প্রথম পর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তারপর তাকে বন্দি করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় পাকি¯-ানের কারাগারে। সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানিনা ২৬ মার্চ ভোর রাত্রে আমাকেও পাকি¯’ানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
মাহফুজুর রহমান : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকি¯’ানী হানাদার বাহিনী সারা দেশের নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নির্দয় নিষ্ঠুরতায়। আপনি ও গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে আপনার কথা জানতে চাই।
আজিজুর রহমান : ১৯ মার্চ জায়দেবপুরের (মুন্সিগঞ্জ) ইপিআর সেনা ছাউনীতে বিদ্রোহ শুর” হয়। হতাহত হয় বহু পাকি¯’ানী, শহীদ হন ইপিআর এর অনেক জুয়ান ও বাঙালি কমান্ডিং অফিসার, শুর” হয় বাঙালি সেনা বাহিনীর লোকজনের নিরস্ত্রীকরন। কোথাও কোথাও তাদের নজরবন্দী করে রাখা হয়, আসে ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুরতমো ণ। আমরা সেই দিন চরম উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম, কিš’ আমাদের কাজ থেমে ছিলো না। বিভিন্ন জায়গায় চলছিলো পথ সভা। মৌলভীবাজার,শমশেনগরে, কমলগঞ্জে বিরাট সমাবেশ হয়েছে, সবার হাতেই লাঠি ছিলো। বিকালের দিকে ভৈরব বাজার স্কুল প্রাঙ্গনে তীর-ধনুক, লাঠি শোটা নিয়ে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। রাতে শমশেরনগর ভ্যালিতে (বেশ কিছু চা বাগান নিয়ে গঠিত) ইপিআর এর কয়েকজন নেতৃব”ন্দ নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাতে বিভিন্ন জায়গায় গণসংযোগ করে শহরে আসতে ১২.৩০ হয়ে যায়। শহর তখন লোকালয় শূন্য। একজনের সঙ্গে দেখা হলে বললেন ইলিয়াস ভাই (এমপি) আমাকে খোঁজ করছেন। যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম, কাউকেই পাওয়া গেলো না। বাড়িতে ফিরে আমি দেখি বন্ধু হুমায়ূন আছে। খেতে যাই রান্না ঘরে, দেখি বিড়াল খাবার খেয়ে নিয়েছে, ফিরে আসি। আধ ঘন্টা পর দেখি মা ডাকছেণ। রাগ থাকলেও এত রাতে রান্না করে দিয়েছেন। পরবর্তী পর্যায়ে খুব ভালো ঘুম হয় না, হুমায়ূন ও আমার সঙ্গে ঘুমা”িছলো। হটাৎ করে অনেকগুলা গাড়ির আওয়াজ পাই। আমার ঘরের দরজায় নক করে। দরজা খুলার সাথে সাথে মহকুমা প্রশাসক, এসডিপিও আমাকে তাড়াহুড়া করে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে দেন এবং নিজেরাও চলে আসেন। এই ফাঁকে চেয়ে দেখি শুধু আর্মি আর আর্মি। এসডিও আমাকে বলেন, ‘দেশে সংকট স”ষ্ঠি হয়েছে’। আমার নিরাপত্তার জন্য আমাকে নিয়ে যেতে এসেছেন। আমি টঙ্গি ঘরে থাকতাম। হাত মুখ ধুয়ে টয়লেটে যাব, দেখি সঙ্গে দুই জন গার্ড দিয়ে দিয়েছে। কী করব, কাজ সেড়ে এসে কাপড় চুপড় পরি। ফজরের নামাযের আগেই বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যায়। এসডিও এর ই”ছা ছিলো আমাকে ব্রেকফ”াস্টের সুযোগ দেবে কিš’ ক্যাপ্টেন রাজী হয় নি। আমাকে নিয়ে যাওয়ার পথে ব্যোমকেশ ঘোষ’ কে জানতে চায়। আমি বললাম চিনি না। গাড়ি নিয়ে সোজা তারা মৌলভীবাজার সদর থানায় নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসা করে, ‘অওর আদমিকা নাম কিয়া হ্যায়’? ওরা জানায় ব্যোমকেশ ঘোষ। আমি বুঝলাম প্রেমাদার কথা বলছে। তারা ফিরে চৌমুহনায় আসে এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করে ঘোষের বাসা কোথায়। আমি বলতে অস্বীকার করায় শমশেরনগর রোড ধরে তারা এগুতে থাকে। তখন মুসলিরা ফজরের নামায পড়ে বের হয়েছেন। তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এটাতো চৌমুহনায় মুনসিফ কোর্টের কাছে। আমাকে দেখে- ‘আরে এমপি সাব আপনি’ বলে পেছনের দিকে চেয়ে আর্মির গাড়ীর বহর দেখে ‘ফি আমানিল্লাহ’, ‘ফি আমানিল্লাহ’ বলে তাড়াতাড়ি ¯’ান ত্যাগ করেন। প্রেমাদার বাসা থেকে প্রেমাদাকে উঠিয়ে নিয়ে আসে এবং ট্যুরিস্ট রেস্ট হাউসে দুইটি র”মে বন্দি করে রাখে। সেই সময়ের আমার বাড়ি ও প্রেমাদার বাসার কান্নার শব্দ, সেই বুক ফাটা আর্তনাদ আজও কানে ভাসে। আমাকে মহকুমা প্রশাসক আশরাফ (পাঞ্জাবী) ২৭ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যার পরে একবার বাড়িতে এনে দিয়ে গিয়েছিলো। আমি সাথে সাথে বের হয়ে সংগঠনের নেতৃব”ন্দ কোথায় কে আছেন সুলেমান খানের কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করি। বাড়িতে ফিরে এসে সংগে সংগে আবার বেরিয়ে পড়ার প্র¯’তি নি”িছ, মা খাওয়ার কথা বলছেন ঠিক সেই সময়ে দুইটি গাড়ির হেড লাইটের আলো এসে পড়ে। চেয়ে দেখি বাড়ির দিকেই আসছে। তাড়াতাড়ি বের হয়ে পিছন দিক দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিš’ বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয়নি। এক বাড়ি মাঝে রেখে আরেক বাড়ির রা¯’ায় গিয়েছি এমন সময় আমার ছোট ভাই জামাল উদ্দিন (বর্তমান জেলা মুক্তিযুদ্ধা কমান্ডার) মেঝ ভাই, মেঝ ভাই বলে ডাকছে এবং বলছে, ক্যাপ্টেন সাহেব আপনাকে খুঁজছেন। আমি থেমে যাই এবং সাথে সাথে বাড়ি ফেরার সিদ্ধাš- নেই। কারণ আমার অবর্তমানে পরিবারের সবাইকে হত্যা করতে পারে, গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে। গ্রামের নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করতে পারে। এইসব ভাবনা আমাকে পালিয়ে যেতে দেয়নি। কাল বিলম্ব না করে বাড়িতে ফিরে এসে দেখি, পরিবারের লোকজনকে বন্দুকের নলের মুখে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আলাহর কাছে ফানাহ চাই এবং ক্যাপ্টেন হামিদকে জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে, হুয়াট হ্যাপেন্ড? সে আমাকে আবার নিয়ে যাওয়ার জন্য উপর থেকে নির্দেশ এসেছে বলে জানায় এবং আমাকে নিয়ে আবার সার্কিট হাউজে চলে যায়। ২৮ মার্চ ১১টার পর থেকেই মৌলভীবাজারের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২টি মিছিল না কী বের হয়ে ছিলো। সবচেয়ে বড় একটি সিলেট রোড ধরে অন্যটি কুলাউড়া রোড ধরে শহরের দিকে আসতে থাকে। মিলিটারিরা প্রথমে ফাঁকা পরে মানুষের উপর গুলি ছুড়ে। লুন্দর শহীদ হন চাঁদনীঘাটে। জমির, তারামিয়া শহীদ হন শাহ বন্দরে। এর আগে সৈয়ারপুরে ইট ভাটার কাছে কর্মরত পাঁচ জন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্যাপ্টেন রাগান্বিতভাবে আমার র”মে ঢুকে বলে ‘আই হ্যাভ কিলড ফাইভ অব ইয়র ম্যান’ আমার তখন আর হিতাহিত জ্ঞান ছিল না, তার কলারে চেপে ধরি, ‘গেট আউট, গেট আউট, প্লিজ লিভ মি এলোন’। সে বুট দিয়ে আমাকে লাথি মারে এবং আমি পড়ে যাই। পি¯-ল বের করেছিলো কিš’ গুলি করেনি। পরবর্তী পর্যায়ে আমি তাদের কথা শুনেছি, আর্মি চা”িছলো আমাকে মেরে ফেলতে কিš’ এসডিও সেটা মানেন নি। কারণ আমার বন্দি হওয়ার কথাটা বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম প্রচার করে দিয়েছিলো। এসডিও বলছিলো যেহেতু সে ইলেকটেড রিপ্রেসেন্টেটিভ, কোনো দিন যদি এই হত্যার বিচার হয় ইউ কেন নট সারভাইভ। পরে শুনেছি এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন এবং এসডিও দুই জনই তাদের রিভলভার বের করে টেবিলে রেখেছিলো। ২৮ তারিখ শমশেরনগরে এক গেরিলা অপারেশনে মুক্তিযুদ্ধারা ক্যাপ্টেন রসূল সহ ১১ জন এবং পরবর্তী পর্যায়ে আরো ৩ জনকে হত্যা করে। অপর দিকে আর্মিদের কাছে খবর আসে, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী, মেজর সিআর দত্ত, কর্ণেল রব এর নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযুদ্ধা মৌলভীবাজারের দিকে এগিয়ে আসছে।া আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় সিলেট সার্কিট হাউজে। সেখানে পাকি¯’ানী কর্ণেল সরফরাজ ছিলো এবং পাকি¯’ানের আর্মিরাও মৌলভীবাজার ছেড়ে কুশিয়ারার অপর পারে শাদিপুরে চলে যায়। কর্ণেল সরফরাজ আমার কাছ থেকে একটি স্টেটম্যান্ট নেওয়ার চেষ্টা করে ৬ দফা ও স্বাধীনতার বির”দ্ধে এবং পাকি¯’ানের অখন্ডতার প।ে আমার দিক থেকে পজিটিভ সাড়া না পেয়ে শুর” হয় অমানবিক নির্যাতন। ২৯,৩০,৩১ এই তিন দিন যখনই জ্ঞান ফিরে আসতো তখন চেষ্টা করতো বিব”তিটা নেওয়ার। ১ তারিখ আমাকে সদর থানায় এবং ২ তারিখ সিলেট জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ৭ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট জেল ভেঙ্গে আমাকে, বাবু ব্যোমকেশ ঘোষকে এবং অন্যান্য বন্দিদের মুক্ত করে নিয়ে আসে।
মাহফুজুর রহমান : মুক্তিযুদ্ধ শুর”র তথা প্রথম পর্বের প্রতিরোধ আন্দোলন সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কী?
আজিজুর রহমান : আমি বন্দি হওয়ার আগে প্রথমে ভারতের আশারাম বাড়িতে ইলিয়াছ ভাই (এমএনএ), আলতাফুর রহমান (এমপিএ) এবং আরো এক থেকে দুই জন, কারা ছিলেন মনে পড়ছে না ভারতীয় বিএসএফ পুলিশ এবং সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে আঞ্চলিকভাবে আলাপ আলোচনা হয় অস্ত্র গোলাবার”দ এবং যুদ্ধ বিষয়ে। তারা সব ধরনের সহযোগীতার আশ্বাস দেন। একইভাবে কৈলাশহরে আরেকটি বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে প্র¯’তি নিয়েছিলাম আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাই। শমশেরনগরের গেরিলা অপারেশনের কথা বলছি। ১ তারিখ থেকে ৩ তারিখ পর্যš- এক দিকে মুক্তি বাহিনী অপরদিকে পাক হানাদার বাহিনীর বির”দ্ধে প্রচন্ড সম্মুখযুদ্ধ সংগঠিত হয়। হানাদার বাহিনী পালিয়ে শাদিপুরে চলে যায়। সেখানে পরাজিত হয়ে তারা কীনব্রীজের ওই পারে অর্থাৎ সুরমার ওপারে শহরের দিকে অব¯’ান নেয়। ৭ তারিখ সিলেট শহর ছেড়ে কিছু সময়ের জন্য তারা শালুটিকর এয়ারপোর্ট এর দিকে চলে যায়। ঠিক ওই সময়েই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জেল ভেঙ্গে মুক্ত করে নিয়ে আসে। ওই দিনই আবার সিলেট শহর মিলিটারীরা দখলে নিয়ে যেতে সম হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল ছিলাম। তিন দিন ইলিয়াছ ভাই তারা সিন্দুরখাল বাগানের বাংলোতে রেখে আমার চিকিৎসা করান। একপর্যায়ে জোর করে চলে আসি। পাকি¯’ান আর্মিরা এরইমধ্যে অনেক ঘরবাড়ি জ্বলিয়ে দিয়েছে, দোকানপাট লুট করেছে ¯’ানীয় রাজাকার, কোলাবরেটররা। ঘুরে ঘুরে সে সম¯- পরিবারের খোঁজ নি”িছলাম। অপর দিকে পাকি¯’ানী আর্মিরা ফেরত আসলে আবার হত্যাযজ্ঞ চালাবে সেই ভয়ে অনেকেই প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে চলে যা”িছলেন। তাদেরকে সিল স্বারযুক্ত কাগজ দি”ছলাম যাতে ভারতীয় কতর্”পরে সহযোগীতালাভ করেন। ইতোমধ্যে শেরপুরে আবার সামনাসামনি যুদ্ধ আরম্ভ হয়।
মাহফুজুর রহমান : ভারতে কবে গেলেন?
আজিজুর রহমান : আমি প্রথমে কাজীর বাজারে তারপর কামালপুরে তারপর মৌলভীবাজার হয়ে মে মাসের ২ তারিখ ভারত গমণ করি ও সেখানের আশারামবাড়িতে রাত কাটাই। তারপর আমি শফকতুল ওয়াহেদ, দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব ধর্মনগরে চলে আসি। সেখান থেকে কৈলাশহর যেখানে ল ল শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের যারা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছিলো তাদের নিয়ে চাতলাপুর চেকপোস্টে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প গড়ে তুলি।
মাহফুজুর রহমান : আপনি ভারতের ত্রিপুরায় প্রথম দিকে ছিলেন। পরে সিএনসি স্পেশাল বাহিনীতে প্রশিণ দিয়েছেন। যতদূর জানি সিলেট অঞ্চলে আপনি একমাত্র সংসদ সদস্য এ বাহিনীতে যুক্ত থেকে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধে আপনি কী কী বা কোন কোন অপারেশনে যোগদান করেছিলেন।
আজিজুর রহমান : আমরা ৪ নং সেক্টরের অধীনে ছিলাম, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সিআর দত্ত। নিয়মিত বাহিনীর কোনো সংঘবদ্ধ গ্র”প আমাদের সঙ্গে ছিলো না। কিছু সংখ্যক বিডিআর এর লোকজন, কিছু সংখ্যক পুলিশ বাহিনীর, কিছু সংখ্যক আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর লোকজন নিয়ে এবং যারা অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন; বেঙ্গল রেজিমেন্ট বা সামরিক বাহিনীরÑ তাদের অতি অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে ৪ নম্বর সেক্টরের কার্যক্রম শুর” হয়। প্রথম পর্যায়ে খুবই কঠিন সময় গিয়েছে। যারা সর্বস্ব ত্যাগ করে, আপনজন হারিয়ে শরণার্থী হয়েছিলেন তারা সাংঘাতিক প্তি হয়ে উঠেছিলেন। এই যুদ্ধের পরিণাম সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণা ছিলো না। আমি যখন বন্দি অব¯’ায় তখন একটি গ্র”প মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ট্রেনিংয়ের জন্য চলে গিয়েছিলো। আমার ছোট ভাই খুরশেদ, জামাল, রাজনগরের আছকির খান এরা অনেকেই এই গ্র”পে ছিলেন। এদিকে এই অ¯ি’রতা থেকে লোকদেরকে সাš-না দেওয়ার কোনো ব্যব¯’া আমাদের কাছে ছিলো না। কিছু হালকা অস্ত্র ও গোলাবার”দ দেওয়া হয়, আমরা সিদ্ধাš- নেই আক্রমণ চালাবো। প্রচারও করি মানুষের মধ্যে সেই কথা। যুদ্ধের স্ট্রেটিজি অনুযায়ী আমরা এ কাজটা করেছি রাত ১১টার পরে একটি নির্দিষ্ট ¯’ান থেকে কোনো একটি পাকি¯’ানী ক্যাম্পের উপর নিরাপদ দূরত্ব থেকে গুলি বর্ষণ করতাম। অপর দিকে পাকিস্তানীরাও পাল্টা গুলি বর্ষণ করতো। অনেক সময় গুলাগুলির পরে যখন দেখতাম তারা ঝিমিয়ে গেছে আবার কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়তাম। এমনি করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ¯’ান পরিবর্তন করে প্রায় দিনই আমরা পাকি¯’ানী ক্যাম্প এর উপর গুলি বর্ষণ করতাম এবং তারা সারা রাত্রিই পাল্টা জবাব দিত। চাতলাপুর বিওপি, শমশেরনগর বিমানবন্দর, টিলাগাঁও, চা বাগানের পাকি¯’ানী ক্যাম্পগুলা আমাদের ল্য ছিলো। এই সময়ের যুদ্ধকে আমরা বলতাম হাওয়াই যুদ্ধ। যাই হোক, যেদিন গুলাগুলি হতো তার পরের দিন দেখতাম মানুষ ও শরণার্থীরা আমাদের দিকে জ্বল জ্বল চোখে চেয়ে আছে। তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে, যুদ্ধ চলছে, একদিন এযুদ্ধে জয়লাভ হবে। আমরা ফিরে যাব প্রিয় মাতৃভূমিতে। অন্যদিকে ৯ টার মধ্যে ভারতের প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা আমাদের কয়েকজন সাথীকে সংগে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম শরণার্থী ক্যাম্পগুলাতে। সেখানে তাদের বুঝাতাম দেশ মাতৃকার মুক্তির কথা। আমাদের দেশে ফিরে যেতে হবে। এই বলে তাদের বুঝিয়ে রিক্রুট করা হতো। এমনি করে প্রতিদিনই রোটেশনালী কাজগুলো চলছিলো। অনেকের শারীরিক অব¯’া প্রচন্ড খারাপ ছিলো। একদিকে পাকি¯’ানীদের টর্চারিং এর কারনে অপরদিকে কঠোর পরিশ্রম। চাপ বহন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অবশ্য এ অব¯’া বেশিদিন চলেনি, রিক্রুটিং ক্যাম্প থেকে এখানে তাদের মটিভেইট করা হতো। হালকা কিছু এক্সারসাইজ করানো হতো, তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হতো ট্রেনিং সেন্টারে। জুন, জুলাই, আগস্ট আমরা মোটামুটি গেরিলা যুদ্ধ চালাবার চেষ্টা করি। কারণ বেশকিছু ছেলে তখন ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসে, আমার উপর নির্দেশ আসে মুজিবনগর সরকার থেকে ট্রেনিং এ যাওয়ার জন্য। চল্লিশজন এমপিকে বিশেষ ট্রেনিং এর জন্য ব্যব¯’া করা হয় ভারতের চাকুরিয়াতে। এটা ছিলো ২য় মহাযুদ্ধের এতদ অঞ্চলের ব”হত্তম বিমানবন্দর। আমি ব”হত্তর সিলেট থেকে একমাত্র সংসদ সদস্য ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম। ট্রেনিং শেষে মুজিবনগর সরকারের অ¯’ায়ী কার্যালয় এইট থিয়েটার রোড, কেলকাটায় প্রধানমন্ত্রী, অ¯’ায়ী রাষ্ট্রপতিসহ আমাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। একপর্যায়ে ওসমানী সাহেব ডেকে পাঠান। প্রধান সেনাপতির সঙ্গে অনেক দিন পরে স্বাাৎ হয়। তিনি বলেন তোমার টিকেট করা হয়েছে, প্লেইন এ শিলচর চলে যাবে। সেখান থেকে তোমাকে নিয়ে যাবে। তোমাকে ৪ নম্বর সেক্টরের পলিটিক্যাল কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বললেন, সিলেটে নাকী রাজাকারের সংখ্যা খুব বেশি, এদেরে খতম করে দেবে। আমি বললাম, ইয়েস স্যার, তবে সিলেটে আল-বদর, আল-শামস এর সংখ্যা খুব কম। আমার সঙ্গে ট্রেনিংয়ের জন্য ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের ট্রেন এ আসার ব্যব¯’া করা হয়। আমি শিলচরে আসি, সেখান থেকে করিমগঞ্জ, ধর্মনগর হয়ে কৈলাশহর ক্যাম্প এ। তখন অনেক মুক্তি যোদ্ধাই ট্রেনিং শেষে ক্যাম্প এ ফিরে এসেছেন। তাদের মধ্যে শ”ড়খলা ফিরিয়ে আনার জন্য প্লাটুন ও কম্পানিতে ভাগ করা হয়। একেকটি প্লাটুনে একজন কমান্ডার, একজন টুআইসি, ১০ থেকে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা। একেকটি কম্পানিতে ১০০ থেকে ১২৫ এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের কোম্পেনি কমান্ডার, একাধিক ডেপুটি কমান্ডার। কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ছোট ছোট গ্র”পে বিভক্ত করে(৩ থেকে ৫ জন) দেশের ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের হাতে সামান্য (৫০ টাকার মতো) পাকি¯’ানী অর্থ তুলে দেওয়া হয়। অন্যদিকে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ শুর” হয় বিভিন্ন পাকি¯’ানী ক্যাম্প ও ¯’াপনার উপর। দুই একটি আক্রমণের ঘটনা উল্লেখ করছি।
মুরারীছড়া পাকিস্তানী ক্যাম্প এর উপর আক্রমণ
আসুক (মরহুম) [জুড়ী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান] কে ধর্মনগর থেকে আনানো হয়েছে। কৈলাশহর থেকে মুক্তিবাহিনী নিয়ে একটি দলগঠন করে এদের বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে ব্রিফিং করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনাদের বলি, আপনারা হয়তো বা জানেন তারপরও আরেকটু খোলাসা করছি। আমি যতটুকু দেখেছি, একটা অপারেশনের আগে এই টার্গেটটাকে বারবার, রেকী (তদন্ত) করানো হতো। সবকিছু নখদর্পনে নিয়ে আসা হলে, ‘এ্যাটাক পার্টি’, ‘কাটআপ পার্টি’, এবং ‘রিজার্ভ পার্টি’ ইত্যাদি বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হতো। আমরা অব¯’ান নিয়েছি, এ্যাটাক পার্টির উপর দায়িত্ব আক্রমণ করবে নির্ধারিত একটি সময়ে, কাটআপ পার্টির দায়িত্ব হ”েছ প্রয়োজনে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে যাওয়া। নির্ধারিত সময়ে আক্রমণ শুরু হয়েছে, কিš’ অন্যদিকে একটি ভিন্নপথে পাকিস্তানী সৈন্যরা কাটআপ পার্টি ও এ্যাটাক পার্টির মধ্যখানে ঢুকে গেছে। এই সিগনাল দেওয়ার পর এ্যাটাক পার্টি তাদের আক্রমণ অসমাপ্ত রেখে পাহাড়ের ভিতর প্রবেশ করে। এ খবর আমাদের জানার সুযোগ ছিলো না। আমরা ধারণা করেছি এরা ধরা পড়েছে, অথবা মারা গেছে, না হয় পালিয়ে গিয়েছে। শেষেরটির উপর ভরসা করে রিজার্ভ ক্যাম্পে অপো করতে থাকি। রাতের বাকী অংশ, সমস্ত দিন। পরের রাতে দেখি আসুক তার সঙ্গের সবাইকে নিয়ে অস্ত্রশস্ত্রসহ উপ¯ি’ত। সে এক অদ্ভুত দ”শ্য, আনন্দে উল্লাসে, কান্নায় ফেটে পড়েছিলো মুক্তিযোদ্ধারা। নভেম্বরের শেষে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী তাদের পুরাপুরী প্র¯’তি শুরু করে এবং ডিসেম্বরের ১ তারিখ শমশেরনগরে ৩ টি পাকিস্তানী অব¯’ানের উপর আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২ তারিখ এই আক্রমনের জন্য টার্গেট ঠিক করা হয়। চাতলাপুর বিওপি, শমশেনগর বিমানঘাটি, শমশেরনগর ডাক-বাংলো এবং উ”চ বিদ্যালয়। আমি ও সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপটেন মুজাফফর, মিত্র বাহিনীর কমান্ডিং অথোরিটির সঙ্গে ব্রিফিং এর সময় ছিলাম। আমারা ১২ টা ১ মিনিটে এক সঙ্গে ৩ জায়গায় আক্রমণ চালাই এবং নির্ধারিত সময়ে সবকিছু দখল করে নেওয়া হয়। এই যুদ্ধ ছিলো ভয়াবহ সম্মুখ সমর। মুক্তিবাহিনীকে এখানে রাখা হয়েছিলো নিরাপদে। সমস্ত ঝুঁকি মিত্র বাহিনী গ্রহণ করেছিলো। আমার ঘনিষ্ট জন ভারতীয় মেজর গ্রæমসহ অনেকেই শহীদ হয়। ৩ তারিখ আনুমানিক ৯ টার দিকে শমশেরনগর পুলিশ ফাঁড়িতে এবং চাতলাপুরে ও শমশেরনগর স্কুলে পতাকা উত্তোলন করে শমশেরনগরকে আমি নিজে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করি। ৫ তারিখ মুন্সিবাজারে আরেকটি প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। শমশেনগর থেকে জেড ফোর্সকে ২৩ জন গাইড দিয়ে ভানুগাছ-শ্রীমঙ্গল হয়ে মৌলভীবাজার আসার ব্যব¯’া গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে অনেকগুলা কম্পানি নিয়ে আমি রাজনগরের দিকে রওয়ানা হই। পাকিস্তানী সৈন্যরা না থাকায় ৬ তারিখ রাজনগর বিনাযুদ্ধে মুক্ত হয়। রাজনগর ডাক বাংলোয় ও থানায় পতাকা উত্তোলন করে রাজনগরকে আমরা হানাদারমুক্ত ঘোষণা করি। তার আগে তারাপাশা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। ৬ তারিখ ভোর রাত পর্যন্ত মৌলভীবাজারের শমশেরনগর রোডে বর্ষিজোড়া আর সালামীটিলাসহ মৌলভীবাজারের ভিতরে যে সমস্ত ¯’াপনা ও পাকিস্তানি আর্মিদের বাঙ্কার ছিলো তার উপর প্রচন্ড আক্রমণ শুরু হয়। হানাদার বাহিনী মৌলভীবাজার ছেড়ে সিলেটের দিকে চলে যায়।
মাহফুজুর রহমান : ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মুক্ত দিবসে এসডিও অফিস জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে। আজকের এ বয়সে এসে সে স্ম”তিগুলো নাড়া দেয় কী? অনুভূতি কেমন?
আজিজুর রহমান : মৌলভীবাজার হানাদার মুক্ত হলেও সাধারণ মানুষকে শহরের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় নি কারণ পাকিস্তানী আর্মিরা অজস্র মাইন পুতে রেখেছিলো, প্রচুর গোলাবারুদ, অস্ত্র ফেলে রেখে গিয়েছিলো। দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য এই ব্যব¯’া। ৮ তারিখ সাধারণ মানুষ শহরে ঢুকে (খুব স্বল্প সখ্যক)। সকাল দশটা সাড়ে দশটা হবে। মৌলভীবাজার এসডিও’র কার্যালয়ে ফ্যাগ ষ্টেন্ড এ আমি ,মুক্তিযোদ্ধা এবং কিছু জনগণকে নিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। তারপরেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মনে পড়ে অসংখ্য শহীদের কথা। তবে গর্ববোধ হয় এই ভেবে যে, ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দয়ার দান নয়’Ñ সেই গৌরবময় ণটির অনুভূতির কথা কারো পে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেদিকে গিয়েছি মানুষ বের হয়ে গিয়েছে, একই শ্লোগান ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘স্বাাধীন হলো, স্বাধীন হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো’ ইত্যাদি।
মাহফুজুর রহমান : তিনবার মৌলভীবাজার ও রাজনগর নির্বাচনী এলাকার জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদে ছিলেন। আপনার দল ও মতায় এসেছে কয়েকবার। অনেকেই মন্ত্রী হয়েছেন কিš’ আপনি এ সুযোগটি পাননি। বিষয়টিকে কীভাবে দেখবেন?
আজিজুর রহমান : আমি কৃতজ্ঞ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে, বঙ্গবন্ধু কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রি শেখ হাসিনার কাছে। আমি জেলা আওয়ামীলীগের সম্পাদক, সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। আমাকে কেন্দ্রিয় আওয়ামীলীগের কার্যকরী কমিটির প্রথমে সদস্য পরে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, ৬ বার জাতীয় নির্বাচনের টিকেট পেয়েছি, বিরোধী দলীয় হুইপ করা হয়েছে। কিš’ দুর্ভাগ্য দল যখন মতায় আমি তখন এম.পি. নির্বাচিত হইনি। তবে আমি আদর্শের রাজনীতি করি নিজের মতার জন্য নয়, দেশকে ভালবাসি দেশের মানুষকে ভালবাসি, অতএব ভালোই আছি।
মাহফুজুর রহমান : আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। এ গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রয়োজনে ঢাকায় অব¯’ান না করে মৌলভীবাজারে চলে আসায় অনেকের মধ্যেই হতাশা কাজ করেছে এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
আজিজুর রহমান : যুগের সঙ্গে রাজনৈতিক চিš-া-চেতনা, ধ্যান-ধারনা, আচার-আচরণ, ভূমিকা ও প্রয়োজনের বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, আমরা দেখেছি রাজনীতি করতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। একজন রাজনীতিবিদকে সমাজ ও সংগঠন তার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিত। এখন উল্টোটা, সংগঠনকে ও সমাজকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে হয়, লালন পালন করতে হয় রাজনৈতিক নেতাকে। এদিক থেকে আমি কিছুটা বোধ হয় বেক ডেটেড। কোনো গাড়ী ছিল না, কোনো প্লট ও ফ্যাট নেইনি, ঢাকায় থাকতে হলে বর্তমান রাজনৈতিক প্রোপটে প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকল টাকা নিদেনপে একটি বাড়ি, একটি গাড়ি, একজন ড্রাইভার, সার্বণিক পি.এ., বাবুর্চি, দারোয়ান ইত্যাদি প্রয়োজন, সেটা অর্জন করার যে পথ (আমি অন্যায় বলছি না) সে পথ আমি গ্রহণ করতে পারিনি। আমার রাজনীতির সবচেয়ে বড় অপরাধ আমি প্রচার বিমূখ, যেটা রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার, তাও করতে পারিনি। অতএব ব্যর্থতা কার, কী করে বলি।
মাহফুজুর রহমান : রাজনীতির বর্তমান অব¯’ার পরিপ্রেেিত তর”ণ রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন কী?
আজিজুর রহমান : রাজনীতি -রাজনীতিবিদ ও জ্ঞানীদের জন্য একটি অধ্যায় (শাস্ত্র)। অতএব অধ্যয়ন করতে হবে, জ্ঞান অর্জন করতে হবে, ত্যাগী হতে হবে। দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতে হবে, বর্তমান যুগের উপযোগী হতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই এই লেখার কোথাও দুই একজন ছাড়া কারো নাম উলেখ করিনি কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক বড় মাপের নেতাকর্মীদের সংস্পর্শে এসেছি, চেষ্টা করলেও সল্প সময়ে সবার নাম উলেখ করা সম্ভব হবে না। অতএব সেই নেতা, সহকর্মী, রণাঙ্গনের সাথীদের কাছে মা চেয়ে নি”িছ।
মাহফুজুর রহমান : ধন্যবাদ আপনাকে সময় দেওয়ার জন্য।
( সাাতকার নিয়েছেন লেখক ও গবেষক মাহফুজুর রহমান )