বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ০৪:৩৮ পূর্বাহ্ন
আফতাব চৌধুরী:
আবারও এসছে স্বাধীনতা দিবস। বছরের তেরোটি পার্বণের মতো একটি নয় বরং দেশেপ্রেমের অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হয়ে ঐক্য, সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষাকল্পে শপথের দিন। বিভেদের মথ্যে ঐক্যের জায়গা বাংলাদেশের চিরনন্দিত গৌরব। দেশের লাল-সবুজের পতাকার ছায়াতলে আমির-ফকির, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাম্যের জিগিরে উজ্জীবিত হতে মন্ত্রণা জাগানোর দিন স্বাধীনতা দিবস।
শক-হুন-পাঠান-মোগল অতঃপর ইংরেজদের বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জন্ম নেওয়া আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা, বাক-স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক চরম বৈষম্যই স্বাধীনচেতা নাগরিকের স্বাধীন ভূখন্ড অর্জনে পাগলপারা করে তুলেছিল। সা¤্রাজ্যলোভী পাকিস্তানীদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অসংখ্য দেশপ্রেমিকের, শহিদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় এ স্বদেশভূমি।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, তৎকালীন সময়ে লাখো মুক্তিকামী দেশের দামাল বীরেরা কেন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিল? কেন তারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য? কেনই বা এত আত্মত্যাগ, কাতারে কাতারে মানুষের প্রাণদান ? উত্তরে অনায়াসে বলা যায়, নিশ্চয়ই সেদিনে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল নিপীড়ন, শোষণের অবসান ঘটিয়ে আত্মমর্যাদা রক্ষার লড়াই। দেশের বীর সেনানীদের বুকে নিশ্চয়ই ছিল আরও সুনির্দিষ্ট কিছু স্বপ্ন। দেশের অর্থনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা, আইন-সব ক্ষেত্রে দেশ এগিয়ে যাবে, দেশের মানুষের অভাব কমবে, শিক্ষার হার বাড়বে, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা চর্চা হবে। অন্যায়, অবিচার কমবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে-এসব সাধারণ স্বপ্ন।
লক্ষ লক্ষ বীর শহিদদের রক্তের বিনিময়ে লাভ করা স্বাধীনতা দেশের একাংশ লোকের স্বার্থের ফন্দিতে স্বাদহীনতায় পরিপূর্ণ, এ কথা বর্তমান দেশের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে চোখ রাখলে সহজেই প্রতীয়মান হয়। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার স্বার্থে তৎকালীন দেশ প্রেমিকদের আত্মত্যাগ ও অকল্পনীয় দুঃখ-কষ্ট এবং অগণিত শহিদের তাজা রক্তে রঞ্জিত জয়গাথার ইতিহাসে কলঙ্কের বিষাক্ত ছাপ আঁকতে ব্যস্ত একাংশ মসনদলোভী সুবিধাবাদী। আজ স্বাধীনতা লাভের ৫২ বৎসর পূর্ণ হলেও অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা লাভের পর কোনো সরকারই অদ্যাবধি সফলতার দিশা দিতে পারেনি। স্বাধীনতা দিবসে নেতাদের গরমাগরম ভাষণে সারা দেশে উৎসবের দামামা বাজলেও পক্ষান্তরে বিজয় বা স্বাধীনতা দিবসের মত পবিত্র দিনে লব্ধ প্রতিশ্রæতির বাস্তবায়নে তথাকথিত সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা কতটুকু সফল হয়েছেন, তা অবশ্যই কোটি টাকার প্রশ্ন।
স্বাধীনতা দিবসে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার বুলি আউড়ে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জিগির তুলে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে হলে জনগণের নৈতিক অধিকার ফিরিয়ে না-দিলে স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চকাঁপানো ভাষণ ফাঁকা আওয়াজ বৈ অন্য কিছু নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সামাজিক ন্যায়, ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ইত্যাদি একে অপরের পরিপূরক। আমাদের চারদিকে ¯্রােতস্বিনী প্রবাহমানতায় জীবনধারণের বাস্তবতার দিকে তাকালে মনে হয়, স্বাধীনতার আপন স্বকীয়তা হারানোর চরম আর্তনাদ ! আজ পুনর্বার স্বাধীনতা ফিরে পেতে চায় আপন স্বকীয়তা।
অবশ্য আমাদের দেশে স্বাধীনতা লাভের পর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সৌজন্যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল উন্নত হয়েছে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে কিন্তু উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলাদেশে বেকারত্ব, কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, দুর্নীতি, রাজনীতিতে পারিবারিক ট্রাডিশন অত্যধিক ভাবাবেগজনিত বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ বেড়েই চলেছে। দারিদ্র বিমোচন, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার শপথ দেওয়া হোক স্বাধীনতার পুণ্যলগ্নে, তবেই ফিরবে স্বাধীনতা, ঘুচবে স্বাদহীন নাগরিক জীবনের ক্ষুধা যন্ত্রণার ভয়ানক অনুভূতি।
পরিশেষে বলব, আসুন আজকের এই শুভদিনে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত আমরা শপথ গ্রহণ করি-রক্তে রঞ্জিত মর্যাদা আমরা কখনও ক্ষুন্ন হতে দেব না। দুর্নীতি, অন্যায়, শোষন কিংবা উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তির কাছে। আমরা বিশ্বাস করি একতার শক্তিতে। আমরা বিশ্বাস করি সততার শক্তিতে। আমরা কোনো বাধাকেই বাধা মনে করি না এবং ভবিষ্যতেও করব না। সংগ্রাম চালিয়ে যাব সত্যের পথে, দেশের বুক থেকে কালগ্রাসী অন্যায়, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি সমস্যার কালো ছায়া দূর না-হওয়া পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য হোক অবিচল, আদিগন্ত বিভেদের মাঝে ঐক্য। ধন-ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই পূণ্যভূমিকে আপন স্বকীয় ঐতিহ্য, সম্প্রীতি, সাম্য নিয়ে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার শীর্ষাসন পাইয়ে দিতে আসুন স্বাধীনতা দিবসে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই। সাংবাদিক-কলামিস্ট। ২২.০৩.২০২৩