মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন
আফতাব চৌধুরী:
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন মানবতার কবি। দুরন্ত স^ভাবের এ শিশুটি তাঁর লেখনি ক্ষমতার গুণে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যে সফলতার সাথে। তিনি ভালবাসতেন শিশুদের অসম্ভব রকমের। পরিণত বয়সেও তাঁর লেখার মাঝে শিশু সুলভ সাফল্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাঁর একটা আশ্চর্যজনক ক্ষমতা ছিলো তিনি অতি সহজেই শিশুর সাথে মিশে যেতে পারতেন এবং অনুধাবন করতে পারতেন শিশুর ভিতরকার অন্তরটা। তিনি বিশ্বাস করতেন মনে প্রাণে প্রতিটি শিশুর জীবন পরিপূর্ণ বহু সম্ভাবনাময়।
বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৯৯ সালের ২৪ মে জš§ গ্রহণ করেন আমাদের জাতীয় কবি। বাবা ছিলেন চুরুলিয়া গ্রামের একটি মসজিদের ইমাম। নাম কাজী ফকির আহমদ। ১৩১৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর কাজী পরিবারে নেমে আসে চরম দরিদ্রতা। তাঁর মাতার নাম জাহেদা খাতুন। নজরুলের জšে§র আগে পর পর চার ভাই মারা যায়। পরবর্তীতে নজরুল জš§ নিলে সবাই তাঁকে “দুখু মিয়া” বলে ডাকতেন। এ নামেও তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ঘটে পরবর্তীতে।
তাঁর গোটা কর্মজীবন ছিলো প্রধানত মহানগর কেন্দ্রিক। বারো বছর বয়সে অর্থোপার্জনের জন্য তিনি যোগ দিয়েছিলেন লেটোর দলে। শিয়ারশোল রাজ স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে কিছুদিন পর তিনি সে স্কুল ছাড়লেন এবং মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে চাকরি নিলেন রুটির দোকানে। সেখানে দারোগা রফিজ উদ্দীন নামক এক ব্যক্তি তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে দরিরামপুর স্কুলে ভর্তি করে দেন ১৯১৪ সালে। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এন্টত্থার্স পরীক্ষা দেয়ার আগেই যোদ্ধা হিসাবে নাম লেখালেন ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে। ট্রেনিং শেষে করাচি সেনানিবাসে যোগ দেন হাবিলদার পদে।
‘সওগাত’ পত্রিকায় ১৯১৯ সালে ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক একটি গল্প প্রকাশিত হয়। এ গল্পেই নজরুলের আত্ম প্রকাশ লেখক হিসাবে। ১৯২০ সালে করাচী পল্টন ব্যারাক থেকে কলকাতায় ফেরার পর তাঁর কবিতা বের হল ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’ পত্রিকা। ‘ধূমকেতু’ বই বের হল এর পর একে একে ‘অগ্নিবীণা’ ‘বিষের বাশী’ ‘ভাঙ্গার গান’, ‘সর্বহারা’, ‘রুদ্র মঙ্গল’ ইত্যাদি।
পরবর্তীতে কেমন সব আগুন ঝরানো, প্রেরণায় উজ্জীবিত করা গান কবিতা ‘আমি বিদ্রোহী ভ‚গু’ ‘কান্ডারী হুঁিশয়ার’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, জাগো অনশন-বন্দী যত’, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ সবের মাঝে তিনি শিশুদের ভ‚লে যাননি। ১৯২৪ সালে শিশু কাব্যগ্রন্থ ‘ঝিঙেফুল’ প্রকাশিত হলো। তারপরেও শিশুদের জন্য তিনি লিখে গেছেন অনেক কবিতা ও ছড়া। যেমন- ‘লিচু চোর’, খুকী ও কাঠবেড়ালী, খাঁদু-দাদু, কোথায় ছিলাম আমি, শিশু যাদুকর, খোকার গল্প বলা, রবিবার, পুতুলের বিয়েতে, তালগাছ, ফ্যাসাদ, সাত ভাই চ¤পা, সাধ, সংকল্প ইত্যাদি ইত্যাদি।
নজরুলের এক আশ্চর্যজনক ক্ষমতা ছিলো। তৎক্ষণাৎ কোনো বিষয়ে চমৎকার সব কবিতা গান রচনা করতে পারতেন তিনি। তাঁর এ ক্ষমতার একটি দারুণ প্রমাণ মিলে ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতায়। একটি অতি সাধারণ ফুল। ফুল বলে যার পরিচয়ই নেই। সেই ঝিঙে ফুলকে নিয়ে কবি লিখে ফেললেন একটি সুন্দর কবিতা। ছন্দের আঘাত যেন নাচতে নাচতে চলেছে এ কবিতা। সাধারণ জিনিষও তাঁর রচনার অসাধারণ হয়ে উঠতো।
‘প্রজাপতি ডেকে যায়
‘বোঁটা ছিঁড়ে চলে আয়’
আসমানে তারা চায়
‘চলে আয় এ অক‚ল
ঝিঙে ফুল’।
এ কবিতাটিতে সাধারণের প্রতি তাঁর মমতা থাকার ব্যাপারটি পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এআ যে ঝিঙে ফুল নিয়ে এমন একটি চমৎকার কবিতা তিনি লিখলেন, তাও সম্ভব হয় অতি সাধারণের প্রতি তাঁর গভীর মমতা থাকার জন্যই। তাইতো নজরুল সাধারণ মানুষের কবি, সর্বহারাদের কবি, শোষিত মানুষের কবি, নিপীড়িতের কবি।
তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য ছড়া ‘প্রভাতী’
ভোর হল দোর খোল
খুকুমনি ওঠরে
ঐ ডাকে যুঁই শাঁখে
ফুল খুকী ছোটরে।
এ ছড়ার পরিচিতি খুব ব্যাপক। নিম্ন শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে প্রায়ই উচ্চারিত হতে দেখা যায় এ ছড়াটি। তেমনি আরো অনেক লেখা তিনি শিশুদের জন্য লিখেছেন যা এ অল্প পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
তিনি একাধারে রচনা করেছেন গান, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর স^তঃফ‚র্ত পদচারণা সত্যিই প্রশংসনীয়। ১৯১৩ সালের মাঝামাঝি নজরুল সিনেমা ও মঞ্চের সাথে জড়িত হয়ে অভিনয় করলেন ‘ধ্রæব’ নামের একটি ছবিতে। কিছু ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করে ছিলেন নজরুল। শিশুদের জন্য তিনি রচনা করেছেন শিশুতোষ নাটক, গান। সংগ্রামী চেতনার কারণে খুব একটা মনোযোগী ছিলেন না নজরুল শিশু সাহিত্য রচনায়। তাই তাঁর রচিত শিশু সাহিত্যের সংখ্যা নিতান্তই সীমিত। কিন্তু শিশুর প্রতি অন্তরের টান তাঁর প্রবল ছিলো বলে নানা বিপÐবের মাঝে তিনি উপহার দিয়েছেন ঝরঝরে, প্রাণপর্শী গান, কবিতা, ছড়া, নাটক। এতে তাঁর কল্পনাতীত শিশু প্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
১৯৪২ এর ১০ অক্টোবর মস্তিকের ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তাঁর সাহিত্য সাধনার পরিসমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশ স^াধীন হওযার পর ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তারপর তাঁকে ভ‚ষিত করা হয় জাতীয় কবির স¤মানে। তাঁর রচিত সাহিত্য কর্মের স^ীকৃতি স^রূপ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘জগত্তারিণী স^র্ণ পদক’ (১৯৪৫), ভারত সরকার কর্তৃক পদ¥ভ‚ষণ (১৯৬০), রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডি-লিট (১৯৬৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘ডি-লিট (১৯৭৪) ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একুশে পদক (১৯৭৬) প্রদান করা হয়।
ক্রমে ক্রমে কবির শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগলো। নির্বাক কবি কেবলি চেয়ে থাকতেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগষ্ট ঢাকার পি জি হাসপাতালে বাংলার জাতীয় কবি বাঙালির প্রাণের কবি সংসারের মায়া ত্যাগ করলেন। চলে গেলেন সাম্যের কবি আমাদের ছেড়ে পরলোকে। আজ কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই গভীর চিত্তে। স্মরণ করি আজ তাঁকে একটি গানের একটি ছত্রে
তুমি যে মহান, তোমার গর্বে গর্বিত মোরা,
হƒদয়ে জ্বেলেছ জ্ঞানের মশাল তুমি যে তুলনা তোমার
অক্ষয় রবে কীর্তি তোমার যুগান্তরে।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।