রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ১১:১৯ পূর্বাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক: হাওর ও পাহাড়বেষ্টিত প্রত্যন্ত গ্রামে ছোট একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। বিনা পয়সায় এখানে শিশুর জন্ম দিচ্ছেন প্রসূতি মায়েরা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে ক্লিনিকে কাজ করছেন জুলেখা বেগম। ২৫২টি প্রসব কাজে সহায়তা করেন তিনি। জুলেখা কাজ ছাড়ার পর দায়িত্ব নেন লিপা খানম। ক্লিনিকে এ পর্যন্ত এক হাজার তিন শিশুর স্বাভাবিক প্রসব করিয়েছেন। এর মধ্যে ছেলে ৪৬৯ ও মেয়ে ৫৪১ জন। এদের মধ্যে সিজারিয়ান অপারেশনে যমজ সাত শিশুর জন্ম হয়।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের ভোগতেরা গ্রামে এই কমিউনিটি ক্লিনিকের অবস্থান। ২০০০ সালে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। খোঁজ নিয়ে দৈনিক মৌমাছি কন্ঠ‘র এর সরজমিনে জানা যায়, এখানে বিনামূল্যে প্রসূতিদের স্বাভাবিক সন্তান প্রসব করানো হয়। কোনও প্রসূতির অবস্থা জটিল মৌলভীবাজার সদরে হাসপাতালে পাঠানো হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের জরিপে, স্বাভাবিক প্রসবে সিলেট বিভাগে ক্লিনিকটি প্রথম। স্থানীয় বাসিন্দা মইনুল ইসলাম ক্লিনিকের জন্য ছয় শতাংশ জমি দান করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এটি বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ আট বছর পর ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের মাধ্যমে পুনরায় এর কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১২ সালের ১২ জানুয়ারি ফের স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে প্রথম শিশুর জন্ম হয়। নিরাপদ, স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৯ জুন নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের অনুষ্ঠানে ক্লিনিকটিকে পুরস্কৃত করেন। একই বছরের ১৬ জুলাই জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ’ কমিউনিটি ক্লিনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি পুরস্কৃত হয়। এছাড়া প্রসূতিসেবায় অবদানের জন্য ২০১৮ সালে মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন এবং ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ক্লিনিকটি পুরস্কার পায়।
ক্লিনিকটিতে সন্তান জন্ম দেন বড়লেখা উপজেলার খাদিজা আক্তার। খাদিজার বিয়ে হয় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় কয়েক মাস আগে বাবার বাড়িতে চলে আসেন তিনি। তার স্বামী থাকেন প্রবাসে। তিনি জানতে পারেন ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনা খরচে সন্তান প্রসব করানো হয়। পরে সেখানে চিকিৎসা সেবা নিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব হওয়ায় খুশি খাদিজা।
একইভাবে কুমিল্লার প্রাইভেটকার চালক আল আমিনের স্ত্রী রিনা বেগম এই ক্লিনিকে স্বাভাবিকভাবে ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। রিনা বেগম দৈনিক মৌমাছি কন্ঠকে বলেন, কয়েক মাস আগে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি জুড়ীর জাঙ্গিরাই গ্রামে চলে আসি। প্রসব ব্যথা উঠলে ক্লিনিকে যাই। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমার ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। ওষুধ থেকে শুরু করে সব খরচ বহন করেছে ক্লিনিক। আমার এক টাকাও খরচ হয়নি। এই ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবে কাজ করেন লিপা খানম। তার বাড়ি ক্লিনিকের পাশেই ভোগতেরা গ্রামে। তিনি বলেন,প্রসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০১৫সালের জানুয়ারি মাসে এই ক্লিনিকে যোগ দিই। আমার হাত ধরে এ পর্যন্ত ৭৪৯শিশুর জন্ম হয়েছে। এ কাজের বিনিময়ে আমি পারিশ্রমিক নিই না।তিনি বলেন, বিনা পারিশ্রমিকে আমি সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমার পরিবার থেকেও সহযোগিতা পাচ্ছি। অনেক সময় সংসারের কাজের কারণে ঝামেলায় পড়ে যাই। কারণ যেকোনও সময় রোগী এলে আমাকে ক্লিনিকে আসতে হয়।
স্বাভাবিক প্রসবের কারণে ক্লিনিকের লোকজনের ওপর খুশি রোগী ও স্বজনরা। তারা জানান, ক্লিনিকের লোকজন অনেক ভালো। সিজারিয়ান অপারেশন লাগে না। স্বাভাবিক প্রসবের কারণে মা ও শিশু সুস্থ থাকে। অপারেশন থেকে রক্ষা পান মায়েরা। গরিব লোকেরা টাকা দিয়ে হাসপাতালে গিয়ে যে কাজ করতে পারে না, তা এখানে এলে স্বাভাবিকভাবে হয়ে যায়।
ক্লিনিকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ফখরুল ইসলাম শামীম বলেন, শুধু জুড়ীর নয়; কুলাউড়া, বড়লেখা থেকে শুরু করে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা থেকেও ক্লিনিকে রোগী আসে। এ পর্যন্ত কোনও শিশু কিংবা মায়ের মৃত্যু হয়নি।
তিনি আরও বলেন,স্বাভাবিক প্রসবের জন্য যেসব ওষুধ প্রয়োজন তা এখানে নেই। তাই সরকারিভাবে দেওয়ার আবেদন করছি। সরকার যে লক্ষ্য নিয়ে ক্লিনিকটি চালু করেছে, যদি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে শতভাগ লক্ষ্যপূরণ সম্ভব বলে জানান তিনি।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার হানিফুল ইসলাম বলেন, ক্লিনিকে এক হাজার শিশুর স্বাভাবিক জন্ম নেওয়ার ঘটনা বড় অর্জন। যেসব প্রসূতি চেকআপে আসার পর বিষণ্নতায় থাকেন, নরমাল হবে নাকি সিজার, এমন প্রসূতিদের নিয়ে কাজ করে ৯০ ভাগ সফল হয়েছি আমরা।
জুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সমরজিৎ সিংহ বলেন, স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে ভোগতেরা কমিউনিটি ক্লিনিকের সুনাম দীর্ঘদিন ধরে বয়ে চলছে। সিলেট বিভাগের সব কমিউিনিটি ক্লিনিকের মধ্যে এটির স্থান প্রথম। স্বাভাবিক প্রসব কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এই ক্লিনিকে।
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মোঈদ ফারুক বলেন, রেকর্ড সৃষ্টিকারী এ কমিউনিটি ক্লিনিকটি আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। সাধ্যানুযায়ী ব্যক্তিগত ও সরকারিভাবে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।