বিকুল চক্রবর্ত্তী:: মৌলভীবাজারের নরিয়া গ্রামের রানা দেব। ১৯৭১ এর ২৫ শে বৈশাখ। তখনও তিনি মাতৃগর্ভে। দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ। পৃথিবীতে তার পদাচারণা নিয়ে দুশ্চিন্তাগস্থ তার পিতামাতা। চোখে মুখে শুধুই আতংকের ছাপ। যে কোন সময় গ্রামে হানা দিতে পারে পাক হানাদাররা। সকালে চা খেয়ে সবে মাত্র হাওরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এমন সময় গ্রামে পাকসেনা হানা দিয়েছে। খবরটা শোনামাত্র যেন হৃদপিন্ডের গতি বন্ধ হয়ে যায়। ছোটাছুটি করে তিনিসহ অনেকেই আত্মগোপনে ছুঠে যান হাওরের দিকে। কিন্তু গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার আতর মহাজন। যিনি জন্ম নিয়েছিলেন মানব খোঁকো হিসেবে। গ্রামের লোকদের বলতে লাগলেন পাঞ্জাবী গ্রামবাসীদের নিয়ে বৈঠক করে চলে যাবে। সবাই চলে আসো। নানা ছলনা করে গ্রামর পুরুষ মহিলা সবাইকে জড়ো করে কামিনী কুমার দেব এর বাড়িতে। সকলের সাথে রানা দেব এর বাবা গঙ্গা চরণ দেবও যান সেখানে। সেখানে তার বাবার সাথে দেখা হয় মায়েরও। আরও গ্রামের অনেক পুরুষ মহিলা। এ সময় আতর মহাজন ও আরেক কুখ্যাত রাজাকার শেরপুরের মদরিছ মেম্বার সব পুরুষদের বাড়ির ডানপাশের রাস্তায় গিয়ে লাইন ধরে দাড়াতে বলে আর মহিলাদের বাড়ির উঠানে লাইন ধরায়। তখন বেলা ১টা সোয়া ১টা হবে। আনুমানিক দেড়টার দিকে ১০/১২ পাকসেনা আসে ঘটনাস্থলে। তখন সবাই এদের ভয়ে স্তব্দ। বৈঠক বা সভায় যে অনেক মানুষের কথার সরগুল থাকার কথা ছিলো। সেখানে নিমিশেই সোনসান নিরবতা। পাকিরা একটি মেশিনগান রাস্তায় লাইন ধরা মুক্তিকামী মানুষের দিকে তাক করে আর বাড়িতে আরেকটি মহিলাদের দিকে। রাজাকাররা পাকিস্তানী সেনাদের সাথে আস্তে আস্তে কথা বলে লাইনের কাছে এসে বলে আর বাকীরা কই? সবাই কেন আসেনী? কিছুক্ষন পর তারা লাইনের কাছে গিয়ে বলে যারা মুসলিম তারা লাইন থেকে বেরিয়ে আসতে। লাইন থেকে তারা বেড়িয়ে আসেন। কয়েক মিনিট পর হঠাৎ করে মেশিনগানের শব্দ। নিমিষেই মাটিতে লুঠিয়ে পড়লো গঙ্গাচরণসহ ২৬টি মৃতদেহ। রক্তে রঞ্জিত হলো নরিয়ার মাটি। প্রায় ৫০ গজ দুরে কামিনী দেব এর উঠানে মাতৃগর্ভে থেকে সেদিন হয়তো সে শব্দ রানা শুনতে পেয়েছেন। হয়তো বা পুত্রের মুখ না দেখতে পারার আক্ষেপ ছিলো রানার পিতা গঙ্গা চরণের শেষ চিৎকারে।
নিচে মেশিনগানের শব্দে বাড়ির উঠানে মহিলারা আতংকে চিৎকার দিয়ে উঠেন। কিন্তু তাদের দিকেও গুলি বের হওয়ার অপেক্ষায় প্রস্তুত আরো একটি মেশিনগান। এরই মধ্যে রাজাকাররা উঠানে জড়ো হওয়া মহিলাদের মধ্য থেকে গৃহবধু সন্ধা রাণী দেব, প্রণতী বৈদ্য, সুজলা বৈদ্য, জয়ন্তী বৈদ্য ও কিশোরী মঙ্গলা বৈদ্যকে ডেকে কামিনী দেব এর পশ্চিমের ঘরে নিয়ে যায়। সাথে সাথে ভিতরে প্রবেশ করে পাকিস্তানী অফিসার ও রাজাকাররা। এ সময় কেউ একজন রাজাকার আতর মহাজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠে তুমরা মিটিং এর কথা বলে সবাইকে মেরে ফেলোছো এরকমতো কথা ছিলো না। এ সময় উঠানে থাকা মহিলারা যে যার মতো করে পালাতে শুরু করেন। তবে উঠানে মহিলাদের দিকে তাক করানো মেশিনগানটির গুলি বের হয়নি। তখন নির্দেশদাতা অফিসাররা ঘরে ভিতরে আমাদের বীর মাতাদের উপর নারকীয় তান্ডবে ব্যাস্ত ছিলো তাই।
নর পশুরা কামিনী দেবের ঘরে কামিনী দেব ও তার স্ত্রী কুন্তি বালা দেব এর সমনেই এ সকল নারীদের উপর নির্যাতন (ধর্ষন) চালায়। শুধু নির্যাতন চালিয়ে ক্ষান্থ হয়নি। কুন্তিবালাসহ ৬ জনকেই ঘরের ভিতরে রেখে বাহির থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। পরে ঘরে আগুন দেয়। ঘরের ভেতরে নির্যাতনের শিকার ৫জন নারীর মধ্যে ৩ জনই জ্ঞানহারা ছিলেন। বাকী দুইজন ভেড়া ভেঙ্গে এই তিনজনকে নিয়ে কোন রকমে বের হলেও ততক্ষনে ঘরের ভিতরে আগুনে পুড়ে মারা যান কামিনী দেব ও তার স্ত্রী কুন্তি বালা দেব। কাহিনী গুলো কান্না জড়িত কন্ঠে বর্ননা করেন স্বজন হারানো নিহত কামিনী দেব এর নাথি প্রফুল্ল চন্দ্র দেব, শহীদ যুগেন্দ্র কুমার দেব এর ছেলে যতিন্দ্র দেব, শহীদ হরিন্দ্র বৈদ্যের স্বজন ইরেশ বৈদ্য, শহীদ গঙ্গা চরণ দেব এর ছেলে রানা দেব, সভ্রম হারানো জয়ন্তী বৈদ্য ও মঙ্গলা বৈদ্য। এর আগে এই গ্রামের কাহিনী গুলো বর্ননা করেন মৌলভীবাজার জেলা জাসদের নেতা মো. আব্দুল হক। তিনি সরজমিনে যাওয়ার জন্যও উদ্বোদ্ধ করেন। তার অনু প্রেরনায় ঘটনাস্থলে গেলে নিহতের পরিবারের কাছ থেকে উঠে আসে এই লোমহর্ষক তথ্য। বেরিয়ে আসে এ জেলায় আরও ৫জন বীর মাতার সভ্রম হারানোর হৃদয় বিদায়ক কাহিনী।
স্ত্রীর গর্ভে অনাগত সন্তানের মুখ দেখবেন বলে কতইনা উচ্ছ¡াস ছিল গঙ্গা চরণ দেব এর। কিন্তু নর ঘাতকরা তা করতে দেয়নি, এর আগেই মেশিনগানের গুলিতে গঙ্গা চরণের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। আর পিতাকে না দেখতে পারার আক্ষেপ সারা জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন নিহত গঙ্গা চরণের পুত্র রানা দেব।
একই অবস্থা ১২ বছরের কিশোরী মঙ্গলা বৈদ্যের। পিতা মাতা নেই সংসারে ছিল দুই ভাই। তার দুই ভাইকেই প্রাণ হারাতে হয় নরঘাতকদের হাতে। আর তাকেও বিসর্জন দিতে হয় তার সভ্রম। দুই ভাইয়ের আদরের বোন ছিলেন মঙ্গলা। স্বপ্ন ছিলো লেখা পড়া শিখাসহ আরো কত কি। কিন্তু ঘাতকরা সে সুযোগ দেয়নি। দিয়েছেন নিজের সভ্রম আর পেয়েছেন টানা ৫২ বছর ধরে শুধুই বঞ্চনা। এরকম হৃদয় বিদায়ক ঘটনা নরিয়ার শহীদানদের পরিবারে পরিবারে।
সম্ভ্রম হারানো কুন্তি বৈদ্য জানান, পাকসেনা গ্রামে আসার কয়েকদিন আগে রাজাকাররা গ্রামের সকল হিন্দুদের মুসলমান হতে বলে। না হলে সবাইকে মেরে ফেলা হবে। কেউ রাজী না হওয়ায় শেরপুর থেকে একদল পাক সেনা নিয়ে এসে গ্রামে এই হত্যাযোজ্ঞ চালায়। হত্যার পর শুরু হয় লুটপাঠ এবং বহু বাড়িঘর আগুনে পুঁড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। ওই দিন দুইজনকে পুঁড়িয়ে এবং ২৬ জনকে গুলিকে হত্যাসহ মোট ২৮ জন শহীদ হন। তারা হলেন কামিনী কুমার দেব, কুন্তি বালা দেব, প্রশন্ত কুমার দেব,শ্রীধর দেব, যুগেন্দ্র কুমার দেব, অকিল চন্দ্র দেব, দয়ানন্দ দেব, সোনা চাঁন্দ দেব, গঙ্গা চরণ দেব, পেছন দেব, রাখেশ দেব, অধরা চন্দ্র দেব, নকুল চন্দ্র দেব, সহদেব দেব, গৌর চরণ দেব, উমেশ দেব, দশাই দেব, উমেশ বৈদ্য, যতিন্ত্র বৈদ্য, সোনা চাঁন্দ বৈদ্য, পচারাম বৈদ্য, হরেন্দ্র বৈদ্য, নিখিল বৈদ্য, রশিক রাম বৈদ্য ও পরেশ বৈদ্য। আরো দুইজনের নাম জানা যায়নি ।
এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম প্রধান ব্যক্তিকে মেরে ফেলায় বেঁচে থাকা সদস্যদের শুরু হয় নতুন জীবন সংগ্রাম। সে সংগ্রাম আজও চলছে। তারা জানেন না কোনদিন এর অবসান হবে কিনা।
আর এ বিষয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. জামাল উদ্দিন জানালেন গণহত্যায় শহীদানদের পরিবারগুলো আজ নি:স্ব আর হত্যায় অংশনেয়া রাজাকাররা আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। সরকার ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীর কাছে তিনি দাবী করেন অসহায় এই পরিবার গুলোকে সহায়তার জন্য এবং বীরমাতা (বীরাঙ্গনা) দের মুক্তিযোদ্ধা উপাধি প্রদানের।
11:21 pm, Thursday, 13 November 2025
News Title :
মৌলভীবাজার নরিয়ার রানা পৃথিবীতে আসার হানাদাররা তাঁর পিতাকে হত্যা করে
-
নিজস্ব প্রতিবেদক - Update Time : 09:57:59 am, Monday, 25 December 2023
- 226 Time View
Tag :
Popular Post


























