শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন
মাহবুবুল আলম:
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির ইতিহাসে তিনিই বাঙালির শ্রেষ্ঠতম জাতীয়তাবাদী নেতা। বাঙালির সম্মিলিত চেতনায় জাতীয়তাবোধ সঞ্চারে তিনি পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। গণতান্ত্রিক মূল্যচেতনা, শোষণ-মুক্তির আকঙ্খা ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা-এই ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্যই বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের মূল কথা। জাতীয়তাবাদের এই মূলমন্ত্রকে তিনি সঞ্চারিত করে দিয়েছেন বাঙালির চেতনায়। এভাবেই ইতিহাসের অনিবার্য দাবিতে তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
তাই, বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা,হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের রাখাল রাজা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এ পর্যন্ত যত সাহিত্য রচিত হয়েছে এমন অন্য কোনো বিশ্ববরেণ্য নেতা বা জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে এত বিপুল পরিমান সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। শুধু বাংলাদেশ ও বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসেই নয়,বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এমন ক্ষণজন্ম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ আর কখনো জন্মগ্রহণ করবে কি না বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, তিনি একাই একটি ইতিহাস। জাতির ইতিহাস নির্মাতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্ট্রা। তিনি ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত বাঙালি জাতিকে,স্বাধীনতারমন্ত্রে উদ্বেলিত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের উপহার দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন দেশ,যে দেশটির নাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালির নিজস্ব একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখÐ-প্রতিষ্ঠার জন্য যে মহাপুরুষ নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে বাঙালি জাতিকে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতারমন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলেছিলেন সেই মহান পুরুষের মাহাত্ম্য বর্ণনা বা প্রশস্তিবন্দনা শিল্প-সাহিত্যের অন্যতম কাজ যেখানে মহামানবই প্রধান, সাধারণের প্রবেশ সামান্য। বাংলা ভাষার শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত এর ব্যতিক্রম নয়। যুগে যুগে বিখ্যাত, বিশিষ্ট, স্মরণীয়, যুগ বা যুগোত্তর প্রতিনিধিদের নিয়ে শিল্প-সাহিত্য রচনার যে ঐতিহ্য বা ধারাবাহিকতা তা সমকালেও বহমান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার অবিসংবাদিত নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় যেমন,তেমনি ১৯৭৫সালে এ মহামহিমের বিয়োগান্তক হত্যাকান্ডের পর বাঙালি হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল,সে রক্তক্ষরণ আজও বন্ধ হয়নি। সেই রক্তক্ষকরণই যেন কবিদের কবিতায়, শিল্পীদের রঙ-তুলির আঁচড়ে, সঙ্গীতের সুর মুর্ছনায়, গল্প এবং কথায় প্রতিনিয়ত বাঙালি জাতিকে আরো শাণিত করে যাচ্ছে। তিনি বন্দিত হচ্ছেন কবিতা,গান ও ছড়ার পাশাপাশি সৃজনশীল অন্যান্য মাধ্যমের কারুকারদের রচিত নানা মাত্রার কাজের মাধ্যমে। এখনো সে ধারা অব্যাহত,অটুট, সজীব আরো প্রজ্জ্বোল।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর বিয়োগান্তক হত্যাকান্ডের পর থেকে আজ পর্যন্ত হাজার হাজার গান,গল্প,কবিতা,প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও তাঁর ঐতিহাসিক জীবনচরিত রচিত হয়েছে; ভবিষ্যতে এমন আরো যে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেইসব হন্তারক ও তাদের দোসরেরা তাঁকে এদেশের মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলার অনেক অপচেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো অপচেষ্টাই তাদের সফল হয়নি। বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই যেনো তিনি এদেশের গণমানুষের হৃদয়ে আরো শ্রদ্ধা, আরো ভালোবাসায় জাগরুক হয়ে ওঠছেন।
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই অভিন্ন ও একাত্ম। বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে অনিবার্যভাবে এসে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। জনগণের স্বার্থের সঙ্গে, দেশের স্বার্থের সঙ্গে নিজের স্বার্থকে তিনি একাত্মা করতে পেরেছিলেন। কেননা, দেশের স্বার্থের কাছে, জনগণের স্বার্থের কাছে তিনি নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। শোষক ও শোষিতের সংগ্রামে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। বিশ্ব ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর মতো জাতীয়তাবাদী নেতার দৃষ্টান্ত বিরল। তিনিই একমাত্র নেতা,যিনি জাতীয় পুঁজির আত্মবিকাশের আকাঙ্খা ও বাঙালির সম্মিলিত মুক্তির বাসনাকে একটি বিন্দুতে মেলাতে পেরেছেন। এ কারণেই তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, এ কারণেই তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আর সে কারণেই প্রতিনিয়তই এদেশের কবি-সাহিত্যিক-লেখক সমাজ তাঁকে নিয়ে রচনা করে চলেছেন কত প্রশন্তি। আমাদের নুতন প্রজন্ম যারা কোনো দিনই তাঁকে দেখেনি, তাঁর কন্ঠ শোনেনি, যারা মিথ্যা বিভ্রান্তির একটা ইতিহাস বিকৃতির মধ্যে বড় হয়েছে; সেই ইতিহাস বিকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠেও নুতন প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর উচ্চতা বিশালতা মহান ত্যাগ তিতিক্ষা নিয়ে মনমুগ্ধকর রচনা শৈলীতে ভরে তোলছে তাদের সাহিত্যকর্মের পাতা। এই মহান মানুষটি কখন যে তাদের মন জয় করে হৃদয়ের উচ্চাসনে বসে আছেন তা যেন আমরা টেরই পাইনি। ফিনিক্স পাখিকে যেমন মেরেও নিশ্চিন্ন করা যায়না,তার প্রতিকণা রক্ত থেকে জন্ম নেয় এমন লক্ষ লক্ষ ফিনিক্স পাখি; তেমনি মহান মুজিবের প্রতিকণা রক্ত থেকে জন্ম নিয়েছে এমন আরো লক্ষ মুজিব, এই মুজিবেরাই এখন সেই মহান দেশ প্রেমিক মুজিবের উত্তরসূরী। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ যতদিন বেঁচে থাকবে ঠিক ততদিনই বাঙালি হৃদয়ের উচ্চাসনের সর্বোচ্চ স্থান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম কেউ মুছে ফেলতে পারবেনা এটা আজ চিরন্তন সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নিয়ে অনাগত ভবিষ্যতেও রচিত হবে আরো অগণিত সাহিত্যকর্ম, রচিত হবে লক্ষ লক্ষ শ্রদ্ধা ভালোবাসার পুষ্পাঞ্জলিত আবেগমথিত প্রশন্তি।
বাঙালা সাহিত্যির অন্যতম লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে“’যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী যমুনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’লেখা কবিতাটাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা কোন সাহিত্যিকের প্রথম কবিতা বলে অনেকেই মনে করে থাকে। এই কবিতাটি যেন আজ বঙ্গবন্ধুর নামে সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই আমি এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কয়েক বিখ্যাত কবির কবিতা থেকে এখানে কিছু পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করছি:
বঙ্গবন্ধুর নাম কবিতায় প্রথম প্রজ্জ্বোল করে তোলেছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘৬৮সালের মধ্যভাগে তাঁর ‘হুলিয়া’ শীর্ষক সেই দীর্ঘ রাজনৈতিক কবিতার ভেতর দিয়ে। এর ৮০ ও ৮১তম পঙিক্ততে যেখানে তিনি বলেন: ‘আইউব খান এখন কোথায়? শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম গান রচনা করেন আধুনিক বাংলা গানের এক প্রবাদপ্রতিম গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। অঙ্কুষমান রায়ের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’। তাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে বা পরবর্তী সময়ে আরো অসংখ্য কবিতা ও গান রচিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম দেখেছেন, যুদ্ধ করেছেন কিংবা কোনো না কোনোভাবে এ সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন কিংবা সমর্থন জানিয়েছেন, দুই বাংলার এমন প্রায় সব কবিই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। স্বাধীনতার সপক্ষের বাংলাদেশের সব কবিই তাদের কোনো না কোনো কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন।
আইয়ুবের ফৌজি শাসনামলেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক ও তেজোদীপ্ত ছড়া লেখা হয়েছিল। ‘আইউব ব্যাটা মুরগি চোর, / ব্যাড়া ভাইঙ্গা দিলো দৌড়। / ধরলো ক্যাডা, ধরলো ক্যাডা? / শেখ মজিবর, শেখ মজিবর।-প্রবল জনরোষের মুখে ‘৬৯ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইউব খান পদত্যাগ করলে দেশব্যাপী বয়ে যায় স্বতস্ফূর্ত আনন্দের বন্যা। জনতার মুখে মুখে তখন এই ছড়া, কোথাও কোথাও পোস্টার ও লিফলেটেও। এরকম সাত চলিশ পরবর্তীতে বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনের ¯েøাগান, প্লাকার্ড ও পোস্টারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য স্তুতি ও প্রশংসা দেখা যায়।
‘মুজিব বাইয়া যাওরে / নির্যাতিত দেশের মাঝে /জনগণের নাওরে মুজিব/ বাইয়া যাওরে / ও মুজিবরে, ছলেবলে চব্বিশ বছর রক্ত খাইল চুষি/ জাতিরে বাঁচাইতে যাইয়া / মুজিব হইল দূষীরে…৭০ এর নির্বাচনের সময় গ্রামোফোন রেকর্ডে ধারণ করা হয় এই ঐতিহাসিক গান, যার ফলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরে সুরে ও ছন্দে পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। গানটির রচয়িতা, সুরকার ও গায়কের নাম নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য হলেও এর গানের আবেদন মানুষের কাছে এখনো অবিশ্বরণীয়।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কবিতারই অন্য অঙ্গীভূত শাখা গানের পর গান হয়ে ওঠে আমাদের ন্যায়যুদ্ধ জয়ের, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ ও প্রেরণাদৃপ্ত করার অপরিমেয় উৎস। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল আমাদের সেই উন্মাতাল সময়ের সেইসব গানের স¤প্রচারগত শক্তিশালী হাতিয়ার। এর বেতার তরঙ্গে যেমন মুক্তিযুদ্ধ, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত গানও আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শ্যামল গুপ্তের কথায় এবং বাপ্পী লাহিড়ীর সুরে মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম/ মুজিবর, মুজিবর, মুজিবর/ সাড়ে সাত কোটি প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম…’, এই গান দুটি এখনো এখনো রক্তে অন্যরকমের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। মনে হয়, বঙ্গবন্ধু এখনো জীবিত, তাঁরই নির্দেশে চলছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এই সময় হাফিজুর রহমানের কথা ও সুরে এবং ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, রথীন্দ্রনাথ রায়, লিলি হক ও শাহীন আকতারসহ লেখক ও সুরকারের নিজের গাওয়া ‘আমার নেতা শেখ মুজিব/ তোমার নেতা শেখ মুজিব’ গানটিও উদ্দীপ্ত করে মুক্তিপাগল দেশবাসীকে। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ১৯৭১ সালের অগ্নিগর্ভ সময়ে তারঁ বঙ্গবন্ধু শিরোনামের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছেন এই প্রত্যয়দীপ্ত শব্দগুচ্ছে : মুজিবুর রহমান / ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি উগারী বান। / বঙ্গদেশের এ প্রান্ত হতে সকল প্রান্ত ছেয়ে / জ্বালায় জ্বলিছে মহা-কালানল ঝঞ্ঝা অশনি যেয়ে। … / বাঙলা দেশের মুকুটবিহীন তুমি প্রসূর্ত রাজ, / প্রতি বাঙালির হৃদয়ে হৃদয়ে তোমার তক্ত তাজ। জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ প্রমুখ কবিরা নানা দৃষ্টিকোণে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তবে, ১৯৭৭ সালে ফৌজিশাসক জেনারেল জিয়ার শাসনামলে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেয়াই ছিল নিষিদ্ধ তখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও ছিল যখন ভয়ংকর এক অপরাধ, সে সময়ে বাংলা একাডেমির কবিতা পাঠের আসরে সবাইকে চমকে দিয়ে নির্মলেন্দু গুণ আবৃত্তি করেন ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ শীর্ষক এক ঐতিহাসিক কবিতা। ওই কবিতায় তিনি বলেন : ‘সমবেত সকলের মতো আজিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি/রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই দিন গোলাপের একটি গোলাপ গতকাল / আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। / আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। / শহীদ মিনার থেকে খসেপড়া একটি রক্তাক্ত ইট/ গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। /আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি। ‘ ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে ৩২ নম্বর বাড়ির যে সিঁড়িতে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ, সেই সিঁড়ি নিয়ে এক অসামান্য কবিতা লিখেছেন কবি রফিক আজাদ। সেই সিঁড়ির রক্তধারাতেই যেন পবিত্র হয়েছে সমগ্র স্বদেশ, পবিত্র হয়েছে স্বদেশের মানচিত্র। রফিক আজাদের ভাষায় : এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে। …/স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে পড়ে আছে বিশাল শরীর।
কবি-সাহিত্যিক গবেষকরা যেমন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা করেছেন গান,কবিতা গল্পের মতো হাজারো প্রশস্তি তেমন চিত্রশিল্পীরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাদের রঙ-তুলির আঁচড়ে এঁকেছেন শত শত প্রতিবাদী ও জাগরণী ছবি। যেসব চিত্রশিল্পী তাদের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি এঁকে শীর্ষ তালিকায় তাছেন তাদের মধ্যে অন্যতম কাইয়ুম চৌধুর, হাসেম খান, শিল্পী শাহাব উদ্দিন প্রমুখ। কবিতার মতো উপন্যাস ও ছোটগল্পও লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশাল কর্মকাÐ নিয়ে। আনিসুল হকের ‘যাঁরা ভোর এনেছিল’, সেলিনা হোসেনের ‘আগস্টের এক রাত’-এসব উপন্যাসে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাÐের পর আবুল ফজল লিখেছেন ‘মৃতের আত্মহত্যা’ শীর্ষক অসামান্য এক ছোটগল্প। উত্তরকালে সৈয়দ শামসুল হক, রশীদ হায়দার, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আনোয়ারা সৈয়দ হক, ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, জাকির তালুকদারসহ অনেক ছোটগাল্পিক বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের বিশেষ বিশেষ অনুষঙ্গ নিয়ে ছোটগল্প রচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক নাটক। এর মধ্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘পলাশি থেকে ধানমন্ডি’ মঞ্চনাটকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সাহিত্য রচনা অব্যাহত এক ধারা। এখন যেমন হচ্ছে, ভবিষ্যতেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হবে। তাঁকে নিয়ে রচিত সাহিত্যকর্ম পাঠ করলে এই মহান মুক্তিসংগ্রামীকে যেমন জানা যাবে, তেমনি জানা যাবে বাঙালি জাতিসত্তার প্রকৃত ঠিকানা।