1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

“স্বাধীনতার মাস, অগ্নি ঝরা মার্চঃ স্মৃতিকথাঃ কিছু কথাঃ কত ব্যথা ” – মুজিবুর রহমান মুজিব

  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২
  • ২২৫ বার পঠিত

বাঙ্গাঁলি জাতির হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসে একাত্তোরের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম- স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি গৌরবময় অধ্যায়। এ বছর বাইশ সালে জাতি সাড়ম্বরে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি উৎসব উদ্যাপন করছেন। চলতি সালেই স্বাধীনতার মহান স্থপতি, বাঙ্গাঁলি জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের জনক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশত বার্ষিকী। দেশ ও জাতি মহা সমারোহে ভাব গম্ভীর পরিবেশে মুজিব বর্ষ হিসাবে জন্মশত বার্ষিকী পালন করছেন। ফলতঃ স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তি উৎসব ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে।
একাত্তোরের অগ্নি ঝরা মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ কারি প্রকৃত মাঠের মুক্তিযোদ্ধা একাত্তোরের বীররা এখন জীবন সায়াহ্নে একাত্তোর উর্ধ্ব। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারি, জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই পরলোকে-যারা বেঁচে আছেন তাঁরা নবোতিপর বৃদ্ধ হয়ে শয্যাশায়ী-সোফা শায়ী।
দূর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত ও পূর্নাঙ্গঁ ইতিহাস এখনও রচিত হয়নি, এখন পর্য্যন্ত ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত ও পূর্নাঙ্গঁ তালিকা তৈরী হয়নি। দেশব্যাপী, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারি কতেক কলম সৈনিক সংঘটক এখনও জীবিত লেখালেখি-সমাজ কর্মে সম্পৃক্ত আছেন। তাঁদের আমাদের সকলের পবিত্র-নৈতিক দায়িত্ব-প্রত্যক্ষদর্শি হিসাবে অভিজ্ঞতার আলোকে একাত্তোরের বীরদের বীরত্ব ও কৃতিত্ব বর্ত্তমান প্রজন্ম এবং ভাবি গবেষকদের গবেষনার জন্য উপস্থাপন করা লিপিবদ্ধ করা।
আমাদের প্রজন্মের চরম সৌভাগ্য ও পরম পাওয়া একাত্তোরের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভাবে অংশ গ্রহণ এবং নেতৃত্ব প্রদানের সুযোগ লাভ। আমি উনিশ’শ একাত্তোর সালে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ফাইন্যাল ইয়ার এর ছাত্র ছিলাম। আটষট্টি সালে মৌলভীবাজার কলেজ থেকে হায়ার সেকেন্ড ক্লাশ নিয়ে বি.এ.পাশ করি। সে কালে ‘গ্রেজুয়েট’ দের সম্মানজনক পদ মর্য্যাদায় চাকরি পাওয়া কোন কঠিন ব্যাপার ছিল না। উকিল হতে চাইলে ‘ল’ কলেজ ভর্ত্তি হয়ে পাকিস্তানী আমলেই আইনজীবী হতে পারতাম। প্রবাসি পিতা-মাতা বৃটেনে ব্যবসা বানিজ্য বাসা বাড়ি নিয়ে সপরিবারে বসবাস করছেন। আমার পক্ষে বৃটেন গমন ও কঠিন কাজ ছিল না। পিতা-মাতার প্রথম সন্তান হিসাবে আমার শিক্ষানুরাগি পিতা-মাতা চাইলেন চাকরি কিংবা ব্যবসা বানিজ্য কোনটাই নয় দেশে সর্ব্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী শেষে ব্যারিষ্টারি পড়বার জন্য আমাকে বিলেত নেবেন। পিতা-মাতার কথাও ইচ্ছানুযায়ি সুবোধ বালকের মত উচ্চ শিক্ষা লাভের উচ্ছাকাংখায় ঐহিত্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হলাম। আনন্দ সংবাদ আমার প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শত বর্ষ পূর্ণ হয়েছে।
তৎপূর্ব কাল থেকেই আমি একজন বঙ্গঁ সন্তান হিসাবে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের সমর্থক ছিলাম। সেই সময়কার ছাত্র প্রিয় সংঘটন-ছাত্রলীগ-এর কর্মি হিসাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হই। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্ম্মকান্ডে ও সম্পৃক্ত হই। বাষট্টি সালে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্র লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক তাত্বিক সিরাজুল আলম খান গোপন সংঘটন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। দাদা হিসাবে সুপরিচিত সিরাজুল আলম খাঁন একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী রাজনীতিবিদ। আমি তাঁর ও নিউক্লিয়াসের সমর্থক ছিলাম। আমি ষাটের দশকে প্রথমে মৌলভীবাজার কলেজ শাখা অতঃপর মহকুমা শাখা ছাত্র লীগের সভাপতি নির্বাচিত হই। আমার কমিটির সম্পাদক ছিলেন আ.খ. সুজাউল করিম। তখন প্রত্যেক বৎসর উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ছাত্র সংঘটন সমূহে বার্ষিক কাউন্সিল ও সম্মেলন হত। কেন্দ্র থেকে নেতৃবৃন্দ আসতেন। আমার সময় কেন্দ্র থেকে প্রধান অতিথি হিসাবে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম। আমার পরের কমিটির সভাপতি সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে সুদর্শন ও সুবক্তা দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী এবং নীরব সংঘটক নিরীহ ভদ্রলোক নূরুল ইসলাম মুকিত।

ষাটের দশক আমাদের জাতীয় জীবন ও জাতীয় রাজনীতির স্বর্ণযুগ-সোনালি অধ্যায়। বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক ও বলিষ্ট নেতৃত্বে বাঙ্গাঁলি জাতীয়তা বাদী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপলাভ করেছে। ছাত্র সমাজের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়ন খুবই শক্তিশালী এবং ছাত্র প্রিয় ছাত্র সংঘটন ছিল। ফলতঃ ছাত্র লীগের বিশাল কর্মি বাহিনীকেই বাংলাও বাঙ্গাঁলির মুক্তি সনদ বঙ্গঁবন্ধুর ছয়দফার প্রচার এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হত। তখন এখনকার মত রাজনৈতিক দল সমূহের এত অঙ্গঁ কিংবা সহযোগি সংঘটন ছিল না। তাছাড়া পাকিস্তানী শাসনামলে বিশেষতঃ পাকফৌজি প্রেসিডেন্ট স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আয়ূব খানের শাসনামলে ডি.পি.আর, এবডো, প্রডো, জাতীয় গণবিরোধী কালা কানুন জারী করে রাজনৈতিক দল সমূহকে বিকশিত হতে দেয় নি। ফলশ্রæতিতে ছাত্র সমাজকেই সংগ্রামী ভূমিকা পালন করতে হত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তির পর ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাহচার্য্য ও সংস্পর্শে এসে আমি রাজনীতির মোহ ও মায়ায় জড়িয়ে যাই। আমার ছ’ফুটি দীর্ঘ দেহ, দুঃ সাহস ও সাংঘটনিক ক্ষমতা দৃষ্টে নেতৃবৃন্দ আমাকে ¯েœহের চোখে দেখতেন। দাদা, আশম রব সহ অনেকের সঙ্গেঁই এখণ ও আমার সু-সম্পর্ক বিদ্যমান আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্ত্তি হয়ে প্রথমেই তৎকালীন ইকবাল হলেই উঠি-যা বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক নামে ধারন করছে। এই হলের একশত একষট্টি নম্বর কক্ষের আবাসিক ছাত্র ছিলেন আমার এলাকাবাসি অগ্রজ প্রতিম গিয়াস উদ্দিন মনির তিনি ছাত্র লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজ সেবা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে পাওয়া যেত। এই হলে থাকতেই আমি উৎসাহী ছিলাম। কিন্তু দাদার ইচ্ছায় আমাকে হাজি মোহাম্মদ মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র করা হল। সেই হলে পাঁচশত উনত্রিশ নম্বর কক্ষে আমার রুম মেইট ছিলেন আমার প্রিয় বন্ধুু ছয়ফুল আলম খাঁন। এই হলে ছাত্র লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভ্রাতৃ প্রতিম মনিরুল হক চৌধুরী, মুশতাক আহমদ, আব্বাছ উদ্দিন আফছারি, ফতে উল্লা ভূইঞা প্রমুখ ছিলেন। মনিরুল ভাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাংসদ হয়েছিলেন। মুশতাক ভাই প্রথম বি,সি, এস, এ যোগ দিয়ে সচিব হয়েছিলেন আফছারি ভাই ইত্তেফাকের সিনিওর সাব এডিটার ছিলেন। আমার শহর বাসি অনুজ প্রতিম সৈয়দ মাসুক আলী, আমার আত্মীয় আব্দুল মজিদ খসরু প্রমুখ এই হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। আমি হল শাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র লীগের মিটিং মিছিলে অংশগ্রহণ করতাম। আমার বিশল গোঁফ, কাধঅব্দি লম্বা চুল, গরম ভাষন ও উচ্চ কন্ঠে শ্লোগান সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করত। তখন জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল তোমার নেতা আমার নেতা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব, “স্বাধীন কর স্বাধীন কর বাংলাদেশ স্বাধীন কর, দুই চারটা মারুয়া ধর সকাল বিকাল নাস্তা কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা” ইত্যাদি। তখন আমি লেখাপড়ার চাইতে ছাত্র রাজনীতি এবং সাংবাদিকতায় অধিকতর মনযোগী হয়ে উঠি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সম্পাদক, রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তক শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত বাংলার বানী যখন সাপ্তাহিক ছিল তখন তিনি আমাকে বাংলার বানীর আমাদের মহকুমা প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছিলেন। পত্রিকাটি দৈনিক হলে আমি স্বনামে অনেক সচিত্র ফিচার লিখেছি। অনুজ প্রতিম মতিউর রহমান চৌধুরী দীর্ঘদিন বাংলার বানীতে দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় আমি স্থায়ী ভাবে ঢাকা বাসি হতে পারিনি, রাজনৈতিক কারনে আমাকে ঢাকা-মৌলভীবাজার দৌঁড়াতে হয়েছে। বিশেষতঃ সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে বঙ্গঁবন্ধু মনোনীত আওয়ামীলীগ প্রার্থীগণকে বিজয়ী করতে ছাত্রলীগ নেতা কর্মিগণকে নিয়ে গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছি। এ সময় আমাদের তিন অগ্রজ অধ্যাপক মোঃ ফয়জুর রহমান, গিয়াস উদ্দিন মনির এবং সুনির্মল কুমার সিংহ মিলন দার গৌরবোজ্জল ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সত্তোর সালের সাধারন নির্বাচনে বঙ্গঁবন্ধু ও আওয়ামীলীগ এর ঐতিহাসিক বিজয়ে আমরা আনন্দ উল্লাস করলাম। মাঠ ময়দান ছেড়ে হলে-ক্যেম্পাসে ফিরে গেলাম। লেখাপড়ায় মনযোগী হলাম।
একাত্তোরের মার্চ মাসে আমি ঢাকায় ছিলাম, মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র হিসাবে মহসিন হলেই ছিলাম। রাজনৈতিক কারনে সন্ধ্যার পরই তৎকালীন ইকবাল হলে চলে যেতাম। এলো, একাত্তরের পহেলা মার্চ জেঃ এ, এম, ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করেন। আওয়ামী লীগ প্রধান, সংখ্যা গরিষ্ট দলের নির্বাচিত নেতা বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুঃখ প্রকাশ ও নিন্দা জানিয়ে পহেলা মার্চ ঢাকায় এবং তেছরা মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহŸান করেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকার ফার্ম গেইটে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি বর্ষন করে। দোছরা মার্চ, একাত্তর, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় কলা ভবনে পূর্ব ঘোষনা মোতাবেক “ডাকসুর” ভি.পি. ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সেকাল থেকে একালের অনলবর্ষী বক্তা আ.শ.ম.রব স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ঐ দিন ঢাকার সকল স্কুল কলেজের ছাত্র কলা ভবন প্রাঙ্গঁনে এসে সমবেত হয়েছিলেন। লক্ষ ছাত্র জনতার মিছিলে-সমাবেশে টি.এস.সি. থেকে নিউ মার্কেট পর্য্যন্ত লোকে লোকারন্য হয়ে উঠে ছিল। জয় বাংলা ধ্বনির সঙ্গেঁ আওয়াজ উঠে ছিল “জেগেছে জেগেছে বীর বাঙ্গাঁলি জেগেছে”। তেছরা মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি অনল বর্ষি বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিশাল ছাত্র জনসভায় স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র লীগের সংগ্রামী সাধারন সম্পাদক শক্তিমান সংঘটন শাহ জাহান সিরাজ। মূহুর্মূহু গগন বিদারী “জয় বাংলা’ শ্লোগান ও উত্তেজনার মধ্যে ছাত্র নেতা শাহ জাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। আমার ছাত্র ও ছাত্র রাজনৈতিক জীবনের চরম সৌভাগ্য ও পরম পাওয়া এই, মার্চ মাসের দুই, তিন তারিখের দৃষ্টি সভানুষ্ঠানে আমি ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত ছিলাম, কার্য্যক্রমে অংশ গ্রহনের সুযোগ পেয়ে ছিলাম। মার্চে পাক ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার ঘোষনা ঘৃনা ভরে প্রত্যাখ্যান করে বাংলার মানুষ প্রত্যহ প্রতিবাদ কর্ম্মসূচীতে মেতে উঠেন। রাত্রি কালীন মিটিং মিছিল বন্ধ করার জন্য সামরীক সরকার সান্ধ্য আইন-কার্ফূ জারী করেন। কার্ফূ ভঙ্গঁকারীকে দেখা মাত্র গুলির বে-আইনী বিধান থাকলেও সন্ধ্যা হলেই সান্ধ্য আইন ভঙ্গঁ করে ঢাকা বাসি গর্জে উঠতেন-“ইয়াহির ঘোষনা মানি না-মানব না”- বলে রাস্তায় নামতেন ঢাকার ছাত্র জনতা। ‘নিউক্লিয়াসের জনক সিরাজুল আলম খানের পরামর্শ ও নির্দেশ মোতাবেক আমরা বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগের নেতা কর্মি, নীল ক্ষেত, নিউ মার্কেট এলাকার যুবা বিদ্রোহীগণ-ইয়াহিয়ার ঘোষনা মানি না-মানব না, “সান্ধ্য আইন সান্ধ্য আইন” প্রত্যাহার কর প্রত্যাহার কর- শ্লোগান দিয়ে সান্ধ্য আইন ভঙ্গঁ করতঃ মিছিল করতাম। সন্ধ্যা রাতের প্রতিবাদি মিছিল দেখে মনে হত ঢাকা বাসি বুঝি সন্ধ্যার অপেক্ষায় আছেন, সান্ধ্য আইন জারী হলেই, মানি না মানব না বলে রাস্তায় নামবেন। একদিন সন্ধ্যা রাতে টি.এস.সি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় মিছিল নিয়ে যেতেই উদ্যান এলাকা থেকে সেনাবাহিনী ব্রাশ ফায়ার করলেন। আমি সতর্ক হলাম। আমার পাশেই ছিলেন আমার আত্মীয় ছাত্র ইউনিয়নের বলিষ্ট নেতা মৌলানা ভাষানীর একনিষ্ট ভক্ত আব্দুল মজিদ খসরু। খান সেনাদের গুলিতে বুক পেতে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় বিবেচনায় আমি তাঁর হাত ধরে বল্লাম চাচা চল, এই অটোমেটিক গান পুলিশের নয়, মিলেটারির, খাতির করবে না, চল পালাই বলে বিশ্ব বিদ্যালয় মসজিদ এলাকায় ঢুকে কলা ভবন হয়ে ফাঁড়ি পথে এক দৌড়ে মহসিন হলে এলাম। একজনের পায়ে গুলি লেগে রক্তপাত হচ্ছে। খসরু চাচা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। আমি বলেছিলাম চাচা পায়ের গুলিতে রক্তপাত হলেও প্রাণহানি হয় না, ফাষ্ট এইডে রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাবে, তাছাড়া গুলি তোমার পায়ে নয়, আমার গায়েও নয় লেগেছে আরেক জনের পায়ে খামাকা কাঁদছ কেন চাচা, ছাত্র হিসাবে জুনিওর এবং বয়সে কনিষ্ট হলেও দায়িত্ববান আব্দুল মজিদ খসরু বল্লেন ভাতিজা তোমার কিছু হয়ে গেলে তোমার বাপ মায়ের কাছে আমি কি জবাব দেব।
আমার পিতা মাতা আর বেঁচে নেই, শুভ্র শশ্রæ মন্ডিত সোনালি ব্যাংক এর অবসর প্রাপ্ত ব্যবস্থাপক আমার মরহুম পিতার কাজিন আব্দুল মজিদ খসরু এখন ও বহাল ভবিষ্যতে বেঁচে বর্তে আছেন, সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিলেও শেয়ার ব্যবসায় সুনামের সাথেই আছেন।
চৌঠা মার্চ দেশব্যাপী সাফল্য জনক ভাবে হরতাল পালিত হলে বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিব দেশবাসীকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। পাঁচ মার্চ বঙ্গঁবন্ধুর আহŸানে দেশব্যাপী হরতাল পালন। পরাজিত বাম শক্তি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর নেতৃত্বে আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। ছয়মার্চ একাত্তোরে ঢাকায় উত্তেজনা জল্পনা কল্পনা, আগামী কাল সাতই মার্চ রেস কোর্স ময়দানে বঙ্গঁবন্ধু বাংলার স্বাধীনতা ঘোষনা করবেন। ব্যস্ত ও উত্তেজনাময় দিন কাটালেন তিনি। বিভিন্ন মহল তাঁর সঙ্গেঁ স্বাক্ষাত করতঃ বৈঠক করলেন। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফার ল্যান্ড ও সাক্ষাত করতঃ বৈঠক করলেন বঙ্গঁবন্ধুর সঙ্গেঁ। সাত মার্চ একাত্তোরে রেস কোর্স ময়দানে বঙ্গঁবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্টতম ভাষনটি দিলেন। সেই ঐতিহাসিক ভাষনটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে জাতি সংঘ কর্তৃক স্বীকৃত ও সম্মানিত। সকল জল্পনা কল্পনার অবসান হল। নয়ই মার্চ একাত্তোর মজলুম জন নেতা মৌলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাষানী কর্তৃক পল্টন ময়দানে একজন সভায় বঙ্গঁবন্ধকে সমর্থন জ্ঞাপন এবং পাকিস্তানকে “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়াল ইয়া দ্বীন”- এর নিয়মে বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার আহŸান।
পনেরোই মার্চ বঙ্গঁবন্ধু ঘোষনা করেন লক্ষ অর্জিত না হওয়া পর্য্যন্ত আন্দোলন চলবে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত নির্দেশনাবলি ঘোষনা করলে মোট নির্দেশনার সংখ্যা দাঁড়ায় পঁয়ত্রিশে। পনেরাই মার্চ কড়া নিরাপত্তায় পাক প্রেসিডেন্টের ঢাকা আগমন। ষোলই মার্চ কোন পরামর্শক ছাড়া সরাসরি ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক।
একে একে ঢাকায় এলেন নাটের গুরু পিপুলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা, ওয়ালী ন্যাপ প্রধান খাঁন আব্দুল ওয়ালী খাঁন। জমাতুল উলামায়ে ইসলামের প্রধান মুফতি মাহমুদ প্রমুখ। তাঁরা বঙ্গঁবন্ধুর সঙ্গেঁ বৈঠক করলেন। কিন্তু সামরীক স্বৈর শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এক গুয়েমির কারনে মুজিব ইয়াহিয়া আলোচনা পাকিস্তানের বেসামরীক সরকার গঠন তথা নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া ব্যাহত হল। আলোচনায় অগ্রগতির কোন সম্ভাবনা নাই এবং আন্দোলনই মুক্তির একমাত্র পথ বিবেচনায় নেতাদের নির্দেশে প্রয়োজনীয় পরামর্শ সহ আমরা যার যার এলাকায় চলে আসি। এ ব্যাপারে দাদাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এলাকায় ছাত্র লীগের নব-নির্বাচিত কমিটির সঙ্গেঁ কাজ করতে থাকি। আসে তেইশে মার্চ একাত্তোর, পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দিবসটিকে প্রটেষ্ট ডে প্রতিরোধ দিবস হিসাবে ঘোষনা করেন।
ছাত্র লীগের উদ্যোগে চৌমুহনা চত্বরে তেইশে মার্চ একাত্তর বিকালে ছাত্র-জন-প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ছাত্র লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি ছাত্র নেতা দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং মহকুমা ছাত্রলীগের সম্পাদক শক্তিমান সংঘটক নূরুল ইসলাম মুকিতের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সেই বিশাল ছাত্র-জন-সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে আমি সভাপতি সম্পাদক কে নিয়ে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি, পাকিস্তানী জাতির জনক মিঃ জিন্নার ছবি পুড়িয়ে বাঙ্গাঁলি জাতীয়তা বাদী আন্দোলনের আপোষহীন জনক বঙ্গঁবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি উত্তোলন করি। আনন্দ উল্লাস, আবেগ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত সেই উড়ানো-পুড়ানোর ছবি উঠিয়ে ছিলেন চৌমুহনাস্থ মুক্তাষ্টুডিও কর্তৃপক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাগে পাক সেনারা এই ছবি হাতে নিয়ে “গুন্ডা মুজিব কাঁহা হ্যায় উছকা পাতা বাতাও” বলে অনেককে নির্যাতন করেছে। পাকিস্তান টিকে থাকলে জাতীয় পতাকার অবমাননাও অসম্মান করায় রাষ্ট্রদ্রোহীতার অপরাধে আমার ও আমাদের ফাঁসি হত। হাজার হাজার উপস্থিত ছাত্র জনতা প্রতিরোধ দিবসের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে জয় বাংলা শ্লোগানে চৌমুহনা এলাকা প্রকস্পিত করেছিলেন। সভা শেষে আমাদেরকে নিয়ে আনন্দ মিছিল করেছিলেন।
তখন মোবাইল ফোন কিংবা ব্যাপক ভাবে লেন্ড ফোন এর ব্যবহারও ছিল না। আমরা পরদিন কমলগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সংবাদ পাই মুসলিম লীগ অধ্যুসিত কমলগঞ্জ এলাকায় তেইশ তারিখের প্রতিরোধ দিবস এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করতে দেয় নি। আমরা পরদিন পঁচিশে মার্চেই কমলগঞ্জে পতাকা উত্তোলন এবং প্রতিবাদ সভা আহŸানের তারিখ দেই। কমলগঞ্জ থানা ছাত্র লীগের সভাপতি খালিকুর রহমান এর সভাপতিত্বে এবং থানা ছাত্র লীগের সেক্রেটারি মবশ্বির আলীর পরিচালনায় সাব-রেজিস্ট্রারি মাঠে এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে ছিল। তখন মহকুমা সদরে এখনকার মত এত যানবাহন ছিল না। আমরা একটি পুরাতন জীপ ভাড়া করে থানা আওয়ামী স্বেচ্ছা সেবক বাহিনী প্রধান আব্দুল মছব্বির এশ্বাদকে নিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী এবং সম্পাদক নূরুল ইসলাম মুকিত সহ চলচল কমলগঞ্জ চল আওয়াজ তুলে কমলগঞ্জ যাই। তখন কমলগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডাঃ চেরাগ উদ্দিন আহমদ মরহুম এবং সেক্রেটারি আব্দুল গফুর মরহুম। সেই সভা আয়োজনে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন আহমদ এবং জয়নাল আবেদীন প্রমুখ প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
আমরা স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে আমাদের রাজনৈতিক প্রতি পক্ষকে কঠোর সমালোচনা করে বীরের বেশে নিজ শহরে ফিরে আসি। শহরে চৌমুহনায় মিছিল করি। ম্যানেজার স্টলের রসে ভরা রসগোল্লা খাই। চা পান করি। নিয়ম মাফিক সাধনার বারান্দায় এক দফা ছুটিয়ে আড্ডা মারি। আমার মুসলিম কোয়ার্টারস্থ পৈত্রিক বাসগৃহ ব্যেচেলার্স হাউস হিসাবে আমাদের দলীয় অস্থায়ী আস্থানা-ঠিকানা হিসাবে ব্যবহৃত হত। তখন শহরে আওয়ামী লীগ নেতাদের এখনকার মত এত বাস ভবন ও এত নেতা ছিলেন না। মৌলভীবাজার মহকুমা ছাত্রলীগ এর প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক আমার সহপাঠি ও বিশিষ্ট বন্ধু সাংবাদিক আজিজুল হক ইকবাল এর বাসা হক ভিলা আমিও আমার সহপাঠি বন্ধু দেওয়ান গোলাম ছরোওয়ার হাদি গাজির আড্ডা খানা ছিল। হক ভিলার বৈঠক খানার বৃহদাকৃতির পুরাতন পালংকে আমরা তিন বন্ধু প্রায়ই গলাগলি করে ঘুমাতাম।
পঁচিশে মার্চ রাত্রে বন্ধুবর আজিজুল হক ইকবাল বল্লে আরো কথা আছে কাজ আছে চল হক ভিলায় চলে যাই। বন্ধুবর হাদি গাজি বল্লে আমার বাসা মুসলিম কোয়ার্টারে সে যাচ্ছে, তাঁর বাসার তাঁর কিছু কাজ আছে। মশহুর মরহুম আইনজীবী আব্দুল মোহিত চৌধুরী তাঁর মামা। মামার বাসায় থেকেই লেখাপড়া শুরু হাদি গাজির। আল্লাহর কুদরত পঁচিশে মার্চের কাল রাত্রিতে আমি আমার বাসায় গেলাম না, থাকলাম না, গেলে এবং থাকলে সকালে আমি খান সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হই, ব্রাশ ফায়ারে মারা যাই। কারন তেইশে মার্চে পাকিস্তানের পতাকা পুড়ানোর কারনে এবং ছাত্র লীগ নেতা হিসাবে পঁচিশে মার্চের দিবাবসনে খান সেনারা আমার বাসায় হানা দিয়েছিল কিন্তু আমি ঐ রাতে ছিলাম বন্ধুবর ইকবালের বাসগৃহ হক ভিলায়।
পঁচিশে মার্চ, একাত্তোর আধুনিক মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলংক ময় দিন। ঐ দিন “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গাঁলিদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষনা করে। মৃত্যো হয় পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্ম নেয় একটি নুতন জাতি নুতন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
মাস আসে মাস যায়, ঠিক তেমনি মার্চ আসে মার্চ ও যায় কিন্ত ু একাত্তোরের অগ্নি ঝরা মার্চ ছিল এর ব্যতিক্রম। একাত্তোরের অগ্নি ঝরা মার্চ এমনিতে আসেনি-মার্চ কে আসতে হয়ে ছিল। বাঙ্গাঁলির দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রামের ফল ও ফসল ছিল একাত্তোরের অগ্নি ঝরা মাস মার্চ। স্বাধীনতার মাস মার্চ মাস। একাত্তোরের মার্চের বীর নওযোয়ানগণকে সংগ্রামী সালাম-শহীদানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

[ষাটের দশকের ছাত্র নেতা। মুক্তিযোদ্ধ। সাবেক সভাপতি, জেলাবার ও মৌলভীবাজার প্রেসক্লাব]

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..