রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৮:১১ পূর্বাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার :: সিলেট বিভাগে দ্বিধা-বিভক্ত অবস্থায় চলছে চা শ্রমিকদের আন্দোলন। গত ১১ দিন ধরে দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে টানা কর্মবিরতি পালন করছেন সারা দেশের চা শ্রমিকরা।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) সকাল থেকে বিভাগের সিলেট ও হবিগঞ্জে চা বাগানের সকল শ্রমিক কর্মবিরতি পালন করেন। তবে মৌলভীবাজারে প্রশাসনের অনুরোধে শ্রমিকদের একটি অংশ কাজে যোগদান করে।
জানা যায়, মঙ্গলবার সিলেটের কোনো চা বাগানে কাজে যোগ দেননি শ্রমিকরা। সোমবার যেসব বাগানের শ্রমিকদের একাংশ কাজ শুরু করেছিলেন, মঙ্গলবার তারাও ফের কর্মবিরতি শুরু করেন। আন্দোলনের বিষয়ে দুপুর সোয়া ১২টা থেকে সিলেটের ২৩ বাগানের পঞ্চায়েত কমিটি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে চা শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকে লাক্কাতুড়া, মালনিছড়া ও তারাপুর বাগানের শ্রমিকরা ৩শ’ টাকা মজুরির দাবি নিয়ে মিছিল করে লাক্কাতুড়া বাগান সংলগ্ন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তায় জড়ো হন। তারা রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের প্লেকার্ড নিয়ে বসে মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানান। সিলেটের অন্যান্য বাগানের শ্রমিকরাও কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকেন।
সোমবার লাক্কাতুড়াসহ যেসব বাগানের শ্রমিকদের একাংশ কাজে যোগ দিয়েছিলেন তারা মঙ্গলবার সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন করেন। বাগানে গিয়ে তারা চা পাতা চয়ন না করে বসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। এক পর্যায়ে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সিলেটের ২৩টি বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির নেতারা লাক্কাতুড়ায় বৈঠকে বসেন। বৈঠকে সব শ্রমিক একযোগে জানান- তারা কাজে যোগ দিবেন না। এসময় তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা।
আন্দোলনরতদের মধ্যে থেকে রিতেশ মোদি নামের এক চা শ্রমিক বলেন- আমরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতেই আন্দোলনে নেমেছিলাম। এখন কিছু সংখ্যক শ্রমিক পিছটান দিলেও আমরা বেশিরভাগ শ্রমিক দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। তাই আজকের ব্ঠৈকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজু গোয়ালা বলেন- সকল চা শ্রমিক যেহেতু একটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- ৩০০ টাকা মজুরি ছাড়া তারা কাজে যোগ দেবেন না, সেহেতু আমিও তাদের সঙ্গে একমত। তারা কাজে যোগ না দিলে তো আর জোর করে কাজ করানো যাবে না।
এদিকে, বাংলাদেশ চা–শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অমান্য করে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে মঙ্গলবার সকাল থেকে ধর্মঘট পালন করেন শ্রমিকেরা। দুপুর ১২টা পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলের সব কটি চা–বাগানে শ্রমিকেরা বাগানে কাজ করা থেকে বিরত ছিলেন। তবে দুপুরে জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া, বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপপরিচালক নাহিদ আহসান, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলী রাজীব মাহমুদ কয়েকটি বাগানে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা চা–শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে দেন এবং কাজে ফেরার অনুরোধ জানান। তাদের অনুরোধ ও আশ্বাসে ১২টি বাগানের সব শ্রমিক কাজে যোগ দেন। তবে ৫০টিরও বেশি বাগানে অর্ধেক চা শ্রমিক কাজে যোগ দেন, আর বাকিরা কর্মবিরতি পালন অব্যাহত রাখেন।
কাজে যোগ না দেওয়া শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকজন বলেন, ‘আমরা এত দিন ধরে আন্দোলন করছি। হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া আমরা কাজে যোগ দেব না। এখন যদি ৩০০ টাকা ঘোষণা দেওয়া হয়, আমরা এখন কাজে যাব। আমাদের শ্রমিকেরা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।’
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, ‘আমরা রোববার রাতে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে একটা সুন্দর সমাধান করেছিলাম। শ্রমিকেরা প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে চাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিনের ভেতরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শ্রমিকেরা চা–বাগানকে ভালোবেসে কাজে ফিরুক। তাঁদের সব দাবি বিবেচনা করে মানা হবে। মঙ্গলবার সকাল থেকে জেলার অনেক চা–বাগানে কাজ শুরু হয়েছে। শ্রীমঙ্গলেও চা–শ্রমিকেরা কাজ করতে চাচ্ছেন, কিন্তু কিছু দুষ্কৃতকারী তাঁদের যেতে বাধা দিচ্ছে। শ্রমিকদের উসকাচ্ছে। আমরা সাধারণ শ্রমিকদের কাজে যেতে অনুরোধ করছি, তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।’
অপরদিকে, সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জের বাগানগুলোতেও কাজে যোগ দেননি চা শ্রমিকরা। ৩০০ টাকা মজুরি দেওয়ার দাবিতে তারা অনঢ় রয়েছেন। এ অবস্থায় মঙ্গলবার বিকালে বাগানগুলোর পঞ্চায়েত প্রধানদের নিয়ে বৈঠকে বসেন চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। সে বৈঠকেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন চা শ্রমিকরা। ফলে চা শিল্পে সৃষ্ট অচলাবস্থা কাটছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন- প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এ শিল্পে।
উল্লেখ্য, ১২০ থেকে ৩০০ টাকায় দৈনিক মজুরি উন্নতকরণের দাবিতে সিলেটসহ সারা দেশের চা শ্রমিক গত ৯ আগস্ট থেকে আন্দোলনে নেমেছেন। ৯ থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত তারা ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালনের পর গত ১৩ আগস্ট থেকে তারা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি পালন করছেন। আন্দোলন থামাতে শ্রম অধিদপ্তরের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। চলমান জটিলতা নিরসনে সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম দফতর অফিসে মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেণ পাল বৈঠকে বসেন।
তিনপক্ষীয় ওই বৈঠকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে নেতারা এ সিদ্ধান্ত মেনে আসলেও শ্রমিকরা তা প্রত্যাখ্যান করে ৩শ’ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এ অবস্থায় ওই দিন রাতে সিলেট ভ্যালির শ্রমিক নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন জেলা প্রশাসক। বৈঠকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করার আহ্বান জানানো হয় চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের প্রতি। সে আহ্বান মেনেও নেন স্থানীয় চা শ্রমিক নেতারা। কিন্তু সাধারণ চা শ্রমিকরা বেঁকে বসেন এবং সিলেট বিভাগে পরদিন (২১ আগস্ট) দিনভর কর্মবিরতি পালনের পাশাপাশি সড়ক অবরোধ, মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তারা।
এক পর্যায়ে ২১ আগস্ট রাতে জেলা প্রশাসন, শ্রমদপ্তরের প্রতিনিধি, শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে ১২০ টাকা মজুরি রেখেই কাজে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রস্তাব মেনে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ইউনিয়নের নেতারা। এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আবারও কর্মবিরতি অব্যাহত রাখেন সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ চা শ্রমিক। এ অবস্থায় ২১ আগস্ট (রোববার) রাত সাড়ে ৮টার দিকে সিলেটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চা শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ ও সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
দেড় ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান, সিলেট জেলা পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি) ফরিদ উদ্দিন, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুদ উদ্দীন আহমদ ও জেলা সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, মহানগর সেক্রেটারি অধ্যাপক জাকির হোসেন, জেলা সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান এবং চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা ও অন্যান্য চা শ্রমিক ইউনিট এবং পঞ্চায়েত প্রধান।
বৈঠকে সিলেটের জেলা প্রশাসক চা শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবগত আছেন বলে চা শ্রমিক নেতাদের জানান। তিনি বলেন- প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে চা শ্রমিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করবেন। বৈঠকে এর সমাধান করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু উপস্থিত চা শ্রমিক নেতারা বিষয়টি নিয়ে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পরবর্তীতে তাদের সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানান।
বৈঠক শেষে রাত দশটায় চা শ্রমিক ইউনিয়ন সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন- আমাদের সঙ্গে আবারও বৈঠক করা হয়েছে। কিন্তু আমরা প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের প্রস্তাবনা শুনেছি। এ নিয়ে আমাদের অন্যান্য ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলবো। পরবর্তীতে আমাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেব।
তবে রাজু গোয়ালা এমন কথা বললেও উপস্থিত বেশিরভাগ চা শ্রমিক ও পঞ্চায়েত প্রধানরা প্রশাসনের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।