সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৩:৩৬ অপরাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক: মিয়ানমারের দুই নাগরিকের (রোহিঙ্গা) নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র। আর এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকজন বাংলাদেশি প্রতারকও। চক্রটির বাংলাদেশের হোতা মো. ইসমাইল ও তার দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। সংস্থাটি বলছে, এই চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ এবং যুবকদের কোনও অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভন দেখাতো। তারা বলতো— সেই দেশে যাওয়ার পর কাজ করে তাদের ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেই হবে। আর এই প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব অনেক তরুণ। এমনকি চক্রের নির্যাতনে প্রাণও গেছে এক বাংলাদেশির।
শুক্রবার (১৮ আগস্ট) রাতে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে অভিযান চালিয়ে চক্রের তিন জনকে গ্রেফতার করে র্যাব ১১-এর একটি দল। মো. ইসমাইল ছাড়াও গ্রেফতার অপর দুজন হলো— জসিম ও মো. এলাহী। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে র্যাব। শনিবার দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, চক্রটি মূলত মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ-যুবকদের নিয়ে যেতো মিয়ানমারে। সেখানে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করতো তারা। মুক্তিপণ না পেলে চালানো হতো নির্যাতন। এই নির্যাতনে একজনের মৃত্যুও হয়েছে।
চক্রটি গড়ে ওঠার তথ্য তুলে ধরে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘র্যাবের হাতে গ্রেফতার ইসমাইল ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় ছিল। সেখানেই তার পরিচয় হয়েছে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের বাসিন্দা (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামালের সঙ্গে। এক পর্যায়ে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ইসমাইল দেশে ফিরে আসে। কিন্তু রশিদুল ও জামালের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তাদের সঙ্গে মিলে ১০ থেকে ১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র এবং দেশে চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। তিনি বলেন, ‘চক্রটি প্রথমে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীদের বাসে করে কক্সবাজার টেকনাফের মানবপাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের কাছে হস্তান্তর করতো। আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে ট্রলারে করে মিয়ানমারে অবস্থানরত জামালের কাছে পাঠিয়ে দিতো।
চলতি বছরের শুরুর দিকে এই চক্রের খপ্পরে পড়েন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ২২ তরুণ যুবক। তারা গত ১৯ মার্চ সেখান থেকে বাসে টেকনাফ যান। পরে তাদের নৌ-পথে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমারে। মূলত সেখানে চক্রটি সেখানেই আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করতো। যেসব ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিতো, তাদের মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের কাছে পাঠিয়ে দিতো। রশিদুল প্রায় ২৫ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে এবং প্রায় ২০ বছর মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
আড়াইহাজার থেকে যাওয়া ২২ যুবককে তাদের ক্যাম্পে নেওয়ার আগেই মিয়ানমারের কোস্টগার্ডের কাছে আটক হয় ১৯ জন। আর বাকি তিন জনকে কৌশলে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে যায় চক্রটি। মিয়ানমারের নাগরিক জামাল তার ক্যাম্পে ওই তিন জনকে আটকে রেখে নির্যাতন করে। সেই নির্যাতনের চিত্র ভিডিও করে গ্রেফতার ইসমাইলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে।
এই তিন জনের মধ্যেই একজন জহিরুল ইসলাম। র্যাব জানায়, জহিরুলের পরিবার গত ১০ মে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠায় এবং বাকি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর পাঠাবে বলে জানায়। পরবর্তী সময়ে ভিকটিম জহিরুলকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া (জোহার বারুত) পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি (জহিরুল) মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে গত ২৪ মে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুসনদে কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে।
২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে আনা হয়। বাকি দুই জন এখন মালয়েশিয়ায় আছেন। আর মিয়ানমার কোস্টগার্ডের হাতে আটক ১৯ জন দেশটির কারাগারে আটক আছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের কার্যক্রম চলমান বলেও জানান র্যাবের মুখপাত্র।
গত ১০ জুলাই আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানান ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা। ওই ঘটনায় এক ভুক্তভোগীর ভাই কালাম আজাদ বাদী হয়ে আড়াইহাজার থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলাও করেন। সেই মামলার তদন্তে নেমেই তিন জনকে গ্রেফতার করলো র্যাব।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘তাদের একটি উন্নত জীবনের এবং ভালো চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়েছে। এজন্য কোনও টাকা-পয়সা দিতে হবে না। তারা যখন মালয়েশিয়াতে যাবেন, চাকরি পাবেন, তখন আস্তে আস্তে টাকা পরিশোধ করলেই হবে। এ প্রলোভন থেকে তারা যেতে রাজি হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের যখন টেকনাফ থেকে মিয়ানমার নেওয়া হয়, তখন বুঝতে পারে পথটি সঠিক নয়। পরে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ার নীরব একটা জায়গায় রাখা হয়। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পৌঁছাতে পারে না।’
দেশে এই চক্রের ১০ থেকে ১৩ জনের তথ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের যে জামাল রয়েছে, সে মালয়েশিয়ার নাগরিক। সবাই তাকে রোহিঙ্গা হিসেবেই জানে। তার সঙ্গে ইসমাইলের ভালো সম্পর্ক। জামালের নেতৃত্বেই নৌকা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া হয়েছে। এটি বড় নৌকা। এই নৌকায় করে মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা, থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা এবং সিঙ্গাপুরের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছায়। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পেয়েছি নৌকাটি জামালের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।’