শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৩:১১ পূর্বাহ্ন
আফতাব চৌধুরী:
পানিই জীবন-এ কথাটি আমরা সবাই জানি। কিন্তু আজকে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে পানীয়জল একটা বড় সমস্যা। পানি না থাকার সমস্যা, পানিপ্লাবনের সমস্যা, পানীয়জলে রাসায়নিক দ্রব্যের সমস্যা। সম্প্রতি দেশের কয়েকটি অঞ্চলে পানীয়জলে পাওয়া যাচ্ছে বিষাক্ত আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড যা জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানির মাধ্যমে যে-সব রোগ হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো আর্সেনিকযুক্ত পানি। দীর্ঘদিন এ পানি ব্যবহার করলে আর্সেনিক বিষক্রিয়া বা আর্সেনিকোসিস হয়। কিছু এলাকার পানিতে কম ও কিছু এলাকার পানিতে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। তাই সে হিসেবেই কম-বেশি পরিমাণে এ রোগে আক্রান্ত হন মানুষ। প্রকৃতির বুক থেকে প্রাপ্ত এ উপাদান কখনওই ধ্বংস হয় না। এমনকী পানি হাজার হাজার বছর পরও একই রূপে থাকে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পানীয়জলে প্রচুর পরিমাণে আর্সেনিকের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ওই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার কম গভীরতার কুয়ো ও টিউবওয়েলগুলোতে ২৭ শতাংশের বেশি আর্সেনিক রয়েছে। একশোজনের মধ্যে একজন প্রতি লিটার পানীয়জলের সঙ্গে ০.০৫ মিলিগ্রাম আর্সেনিক সেবন করে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছেন, তাদের আর্সেনিককোসিস হওয়ার প্রবণতা বেশি। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের পানি পান করায় প্রভাব পড়ে ত্বকে বা চামড়ায়। এতে ত্বকের রং পরিবর্তন, ত্বকের ক্যান্সার, কিডনি বা বুকে ক্যান্সারের আশঙ্কা থাকে। আর্সেনিক হলো বর্ণহীন এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য যা প্রকৃতির বুকে মিশে থাকে। পুষ্টিহীনতায় ভোগা ব্যক্তিদের রক্তবাহী নালীতে সহজেই প্রভাব বিস্তার করে আর্সেনিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পানিতে ০.০১ মিলিগ্রামের চেয়ে বেশি আর্সেনিক থাকলে তা বিপজ্জনক হতে পারে। আর্সেনিকোসিস হলে কিডনির স্বাভাবিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে। পেটের ব্যথার কারণ হতে পারে আর্সেনিক। এ রোগ হলে রোগীর বুকের উপরের অংশ, পিঠ, বাহু ইত্যাদিতে কালো দাগ পড়ে, হাত-পা ফেটে যায় ভীষণভাবে। পেটের ব্যথা হওয়াও এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। স্নায়বিক দুর্বলতা মাথাচড়া দিয়ে উঠে, কোনও কারণ ছাড়াই শরীরের ওজন হ্রাস পায়, আর্সেনিক থেকে রক্ষা পেতে হলে গভীর কুয়োর পানি ব্যবহার করা উচিত। যে-সব এলাকার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি, সেখানকার মানুষের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখা ভালো। পানি আর্সেনিকমুক্ত করতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সে সম্পর্কে জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগ জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এ ধরনের এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীর পাশপাশি বিশেষজ্ঞরা নিয়মিত পানীয়জল পরীক্ষা করে আর্সেনিকের মাত্রা নির্ণয় করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
দেশের পাহাড়ি অঞ্চলের আশপাশের এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিতে ফ্লোরাইড থাকা প্রাকৃতিক ব্যাপার। কিন্তু তা মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। দাঁতের ক্ষয় রোগ নিরাময় করতে অবশ্য ফ্লোরাইড কিছুটা উপকারী। এজন্য টুথপেস্ট মেশানো হয়। কিন্তু ফ্লোরাইডের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক হুমকিস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যুরো বিশেষজ্ঞদের মতে, পানীয়জলে প্রতি লিটারে ১ মিলিগ্রাম ফ্লোরাইড থাকতে পারে। এটি বাংলাদেশী মান। কিন্তু এ পরিমাণের চেয়ে বেশি হলে অর্থাৎ দু’মিলিগ্রাম থেকে বেশি থাকলে ওই পানি কোনও অবস্থায়ই ব্যবহার করা উচিত নয়। এ বিকৃতির কোনও চিকিৎসা নেই। ফ্লোরাইড মানুষের শরীরে খুব ধীরে ধীরে ক্রিয়া করে। অতিরিক্ত ফ্লোরাইড মানবদেহে হাড়ে জমা হয়। হাড় থেকে ক্যালসিয়ামের অংশ বেরিয়ে গিয়ে মাংসপেশি, ঘাঁট এবং অন্যান্য অংশে জমা হতে থাকে। ফলে হাড়ের গঠনও বাধাগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকৃত হয়। হাড়ের গাঁটে গাঁটে ক্যালসিয়াম জমা হয়ে দেহের জোড়াগুলো বিকল হয়। গাঁটগুলো নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারায়, মানবদেহে অনবরত যন্ত্রণা আরম্ভ হয়। পেটের ব্যথা, বমি ইত্যাদি কিছু সমস্যা নিয়মিতরূপে দেখা দেয়। শরীরের স্বাভাবিক গঠন ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। কৈশোর ও বৃদ্ধাবস্থার লক্ষণগুলো দেখা দেয়। এটা সমাজের পক্ষে একটি মর্মান্তিক ঘটনা এবং এটি একটি জাতীয় সমস্যা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ নিয়ে কয়েক মাস থেকে চর্চা চলছে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। তথাকথিত, চিন্তাবিদ, থিঙ্কট্যাঙ্ক, উচ্চ মেধাসম্পন্নরা এসবের খবরাখবর রাখেন না। আমাদের হাতে ইতিমধ্যে যে-সব তথ্য এসে পৌঁেছছে, তা জেনে পাঠকরা হতভম্ব হয়ে পড়বেন। সে সব পানি আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডমুক্ত কিনা, তা খুব শীঘ্র জরিপ হওয়া প্রয়োজন। এসব টিউবওয়েলের পানি পান করে শিশু কিশোররা আগামীদিনে যে পঙ্গু হবে না তার গ্যারান্টি কি দেবেন জনস্বাস্থ্য কারিগরি বিভাগের প্রকৌশলী-বাস্তুকার বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী?
ফ্লোরাইডযুক্ত পানি খেয়ে বেশ কিছু মানুষ তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বলে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। এ ধরনের কর্মক্ষমতাহীন মানুষ শারীরিক পরিশ্রম করতে অপারগ। তারা দুঃখভরা জীবন নিয়ে বেঁচে আছে। দেখা গেছে, ফ্লোরাইড ও আর্সেনিক আক্রান্তদের সঙ্গে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন স্থানীয় লোকজন সামাজিক সম্পর্কও রাখছেন না। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে?
এসব তথ্য জেনেশুনেও আমাদের অঞ্চলের চিন্তাবিদ, বিশেষজ্ঞরা নীরবে কেন বসে আছেন? পত্র-পত্রিকায় আর্সেনিক ফ্লোরাইডযুক্ত পানীয়জলের কুফল নিয়ে জনসচেতনতা জাগ্রত করা দরকার , তারা কেন সেটা করছেন না। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো গ্রামে গ্রামে লিফলেটের মাধ্যমে প্রচারপত্র, প্লে-কার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে পারে। সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। দেশের প্রত্যেকটি স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষক রয়েছেন। তারাও নিজ নিজ স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় লোকজনদের নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে স্কুলে স্কুলে মাসে একটি বা দু’টি শুক্রবার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন।
দেশে গন্ডায় গন্ডায় মানবতাবাদী (?) স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। কি তাদের কাজকর্ম? যেখানে হরির লুটের বাতাসা পাওয়া যায় না, সেখানে তারা হাজির হয় না। পানীয়জলের ক্ষেত্রে সরকারের একটা নির্দিষ্ট পানি নীতি থাকা দরকার। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বিশুদ্ধ পানীয়জলের জোগান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য হতে হবে। তা না হলে নিকট ভবিষ্যতে ফ্লোরাইড অথবা আর্সেনিকের প্রভাব দেশের মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিষয়টি ভুক্তভোগী অঞ্চলের মানুষের স্থানীয় সমস্যা বলে ঠেলে দেয়া উচিত হবে না। প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকলকেই এর সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।