বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ০৫:১৬ অপরাহ্ন
: আফতাব চৌধুরী:
ফিতর প্রকৃতপক্ষে মাহে রমজানের রোযার যাকাত। যাকাত যেমন মালদার মুসলমানের মালকে পবিত্র করে, তেমনি ফিতরাও রোযাকে পবিত্র করে। কারণ রোযা পালনকালে যেসব অনিচ্ছাকৃত বা ভুলবশতঃ ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে তা ফিতর আদায়ের মাধ্যমে পূরণ হয়ে যায়। উল্লেখ্য সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেছেন, “মহান আল্লাহর রাসূল (স.) প্রত্যেক মুসলমান কৃতদাস (আধুনিক যুগের গৃহ পরিচালক-পরিচালিকা) আজাদ দাস, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য সদকায়ে ফিতর এক ‘ছা ‘আ’ পরিমাণ খেজুর কিংবা যব নির্ধারণ করেছেন। আর ঈদগাহে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করতে হবে।”(বুকারী ও মুসলিম শরীফ)।
প্রসঙ্গক্রমে বলা আবশ্যক, যাকাত আদায় বা প্রদানের জন্য যে পরিমাণ ধন-সম্পদের প্রয়োজন অর্থাৎ নিসাব পুরোণের শর্ত রয়েছে, সদকায়ে ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ মালের বা ধন-সম্পদের প্রয়োজন নেই। তবে পবিত্র ঈদুল ফিতর এর দিনে যে মুসলমান পরিবারের ঘরে দিন- রাত্রির আবশ্যকীয় খাদ্য তাকে তাদের জন্য সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব। অর্থাৎ দেয় পরিমাণ মালের পরিমাণ থাকলে তাকে অবশ্যই ফিতরা আদায় করতে হবে।
যে পরিবারে প্রধান খাদ্য গম সে পরিবারকে গমের মুল্যমান অনুসারে ফিতর আদায় করতে হবে। তাদের অন্য কোন সস্তা খাদ্যের মূল্যমান অনুসারে ফিতর আদায় করা উচিত নয়। যদি কোন মুসলমান পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্ন প্রকার খাদ্য খায় তাহলে সে পরিবারের নিকট যে খাদ্য প্রধান হিসেবে বিবেচিত, তা হলে সেই অন্যতম প্রধান খাদ্যের বিনিময়ে ঐ পরিবারের ফিতরা ধার্য হবে কেননা এ পদ্ধতি মুস্তাহাব।
যে ব্যক্তিকে তার পরিবারের ভরন পোষনের দায়িত্ব পলন করতে হয় কিংবা পরিবারের প্রধান তাকেই পরিবারের পক্ষ থেকে ফিতর আদায় করতে হয়। কেননা, ঐ পরিবারের পক্ষে তার জন্য সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেছেনঃ “তুমি যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছো বা তোমার উপর যাদের দায়িত্ব অর্পিত রয়েছে, তাদের পক্ষ থেকে ফিতর আদায় কর”। উল্লেখ্য, দাস-দাসী বা আধুনিক যুগের গৃহ পরিচালক-পরিচারিকা অমুসলিম হলে তাদের জন্য সদকায়ে ফিতর আদায় করার প্রয়োজন নেই। জনপ্রতি বা মাথা পিছু অর্থ ‘ছাআ’ অর্থাৎ এক সের সাড়ে তেরো ছটাক গম অথবা অন্যতম প্রধান যে কোন খাদ্য অথবা এক ‘ছাআ’ অর্থাৎ সাড়ে তিন সের এগারো ছটাক কিসমিস, আটা, যব বা খেজুর দিয়ে বা তার মূল্যমানের বিনিময়ে ফিতরা আদায় করা যাবে। মন্ত্ররে, খাদ্যবস্তুর এক ‘ছাআ’ নির্ধারিত হয়েছে। (সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্ব কোষ) উল্লেখ্য, ফিতর এর পরিমাণ নির্ধারিত হারের অধিক হলেও ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে অসুবিধা নেই। কারণ ফিতর এর অতিরিক্ত অর্থ বা খাদ্য বস্তু দান হিসাবে বিবেচিত হবে। এর ফলে দানের সওয়াব হবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন: “আল্লাহর রাসুল (সা.) বাজেকথা ও অশীলতা হতে রোযাকে পবিত্র করার জন্য মিসকীনদের সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন” (আবু দাউদ শরীফ)।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলা দরকার, ইসলামী শরীয়াহ সে ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। তাই কেবলমাত্র স্বচ্ছল ও ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে যাতে ঈদের আনন্দ সীমাবদ্ধ না থাকে সে জন্যেই বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) স্বচ্ছল তথা ধনী পরিবারের অভিভাবকদের নিজের এবং তার পরিবারের সকল সদস্যদের পক্ষ থেকে পবিত্র ঈদুল ফিতর এর নামাযে রওয়ানা হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। ফিতর এর তাৎপর্য ও গুরুত্বের প্রেক্ষিতে এখানে বলা প্রয়োজন এই যে, এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে, যারা কিনা তাদের প্রধান খাদ্য চালের পরিবর্তে রেশনের গম কিংবা বাজারের আটার দরে ফিতর আদায় করেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে দেয় একটি ফিতর এর অর্থ কয়েক ভাগে বিভক্ত করে দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করেন। ফিতর এর তাৎপর্য অনুযায়ী এভাবে ফিতর আদায় প্রদান করা উচিত নয়। এরূপ পদ্ধতি পরিহার করাই উত্তম। বলা আবশ্যক, সেই উৎকৃষ্ট সদকা, যা ধনীর নিকট থেকে আদায় করে গরীবদের জন্য ব্যয় করা হয়।(বুখারী শরীফ) উল্লেখ্য, সদকাতে আল্লাহর গজবের আগুন নিভে যায় এবং অপমৃত্যুর হাত হতে রক্ষা পাওয়া যায়। (তিরমিযী)
এ প্রসঙ্গক্রমে এখানে আর একটি কথা বলা জরুরী যে, দ্বীন-ই-ইসলাম কখনো কোন মুসলমানকে কৃপা বা অন্য কারও মুখাপেক্ষী তথা দান নির্ভরশীল করে নাই। ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হলোঃ যারা অক্ষম তাদের জন্য সম্মানজনক জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান করা। কৃপা বা দান হিসেবে নয়, অবশ্য করণীয় কর্তব্য হিসেবে। পারে যারা কর্মক্ষম তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। তবে সমাজে যতক্ষণ পর্যন্ত গরীব বা দুঃস্থ লোক থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের জীবন সহজ ও স্বাচ্ছন্দময় করার জন্য ইসলামী বিধান মোতাবেক রাষ্ট্র সর্বতোভাবে চেষ্টা চালাতে বাধ্য। কাজেই আত্মগতভাবে ধারণা করা অনুচিত যে, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় গরীব, দুঃস্থ বা ছিন্নমূল পরিবার থাকবেই। বলা বাহুল্য যখন ইসলামী রাষ্ট্র তার মূল লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে তখন পর্যায়ক্রমে অনেক লোকেরই সদকার প্রয়োজন হবে না। যেমন এক সময় বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে সদকা তো দূরের কথা যাকাত গ্রহণ করার মতো কোন গরীব মানুষ পাওয়া যেত না। তবে এমতাবস্থায়, যাকাত ও সদকার দেয়া অর্থ এমন কাজের জন্য বরাদ্দ হবে, যা দুনিয়ার যে কোন জাতি বা সমাজের জন্য অপরিহার্য। অর্থাৎ এ অর্থ কোন সমাজ বা জাতির অসমর্থ লোকদের জন্য তথা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের জন্য ব্যয় করা যাবে। এটাই দ্বীন-ই-ইসলামের শিক্ষা। লেখক সাংবাদিক-কলামিস্ট।০৮.০৩.২০২৫