শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৪:১০ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার:: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের সেই আলোচিত বাইশালী টিলার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আগে পলায়ন করা ১৭ জঙ্গি সদস্যকে সিএনজি অটোরিকশা চালকদের সহযোগিতায় আটক করেছে কুলাউড়া থানা পুলিশ। আটককৃতদের কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের হলরুমে পুলিশী পাহাড়ায় রাখা হয়েছে। হলরুমের বাইরে পুরো ইউনিয়ন পরিষদ এলাকা ঘিরে রেখেছে জেলা পুলিশ, কুলাউড়া থানা পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রায় শতাধিক পুলিশ।
আটক ১৭ জনের মধ্যে সিরাজগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক পলাতক থাকা সোহেল তানজিম ও আব্দুল আহাদ মেন্দি নামের একজন ব্যক্তি রয়েছেন। মেন্দি জঙ্গিদের সংগঠনের কমান্ডার নামে পরিচিত।তিনি নিজেকে ইমাম মাহমুদ বলে দাবি করছেন বলে প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান।
এর আগে গত শনিবার সকালে কর্মধা ইউনিয়নের বাইশালী টিলায় থাকা জঙ্গি আস্তানা থেকে নারী-পুরুষসহ ১০ জঙ্গিকে আটক করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, সোয়াট ও পুলিশ। এসময় অভিযানের খবর পেয়ে জঙ্গিদের সাথে থাকা অন্য সদস্যরা পাহাড়ের ভিতরে আত্মগোপনে চলে যায়। অভিযানের পর থেকে স্থানীয় এলাকায় আতঙ্ক কাজ করছিল৷ সবার ধারণা ছিল পাহাড়ের ভেতরে সেই আস্তানা থেকে জঙ্গিদের কমান্ডার হিসেবে পরিচিত আব্দুল আহাদ মেন্দিকে কাঁধে বহন করে চলে যায় অন্য সদস্যরা।
জানা যায়, সোমবার সকাল দশটার দিকে কর্মধা ইউনিয়নের আছকরাবাদ চা-বাগানের খেলার মাঠ থেকে কিছু অপরিচিত লোক ৫টি সিএনজি অটোরিকশায় অন্যত্র যাওয়ার জন্য উঠেন। এসময় ৪টি সিএনজি অটোরিকশার চালকরা তাদেরকে নিয়ে সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ে আসে৷ আরেক সিএনজি চালক লকুছ মিয়ার গাড়িতে তাদের কমান্ডার আব্দুল আহাদ মেন্দি ছিলেন সেটি রবিরবাজার পর্যন্ত যাওয়ার পর সেখানে চালক ও সিএনজি স্ট্যান্ডের লোকজন ১০-১২ টি সিএনজি যোগে কমান্ডার মেন্দিকে আটক করে ইউনিয়নে নিয়ে আসেন।
এসময় কুলাউড়া থানা পুলিশের এস়আই পরিমৰ চন্দ্র দাস, এএসআই নাজমুল হোসেনসহ পুলিশের একটি দল চালকদের সহযোগিতায় তাদের আটক করে। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কুলাউড়া সার্কেল দীপঙ্কর ঘোষ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো: মেহেদী হাসান, থানার
ওসি মো: আব্দুছ ছালেক, জুড়ী থানার ওসি মো: মোশাররফ, জেলা গোয়েন্দা সংস্থা ডিবির ওসি মো: আশরাফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। রাতে সিটিটিসি প্রধান মো: আসাদুজ্জামান ইউনিয়ন পরিষদে আসেন। সোমবার রাত সাড়ে আটটায় আটক জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশী পাহারায় মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ লাইনে নেয়া হয়েছে।
সন্দেহভাজন জঙ্গিদের ধরতে ভূমিকা রাখেন কর্মধা গ্রামের বাসিন্দা সিএনজি চালক লকুছ মিয়া (৩৫), পূর্ব ফটিগুলির রব উল্লাহ, (৫৭), নলডরী গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস (৪০), হুসনাবাদের সাইফুল ইসলাম (৩৭), রনি মল্লিক (২৬)। এসময় রবিরবাজার- কর্মধা সিএনজি লাইনের প্রায় ২০-২৫ টি সিএনজি চালক এ কাজে সহযোগিতা করেন।
স্থানীয় অনেকেই বলছেন, যদি সিএনজি চালকরা টাকার জন্য জঙ্গি সদস্যদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নিয়ে অন্যত্র নিয়ে পৌছে দিতো তাহলে ওই জঙ্গি সদস্যদের আটক করা যেতনা। ইমাম মাহমুদের কাফেলার ১৭ সদস্যদের আটক করে বীরত্ব দেখানোতে স্থানীয়রা তাদের ভূয়সী প্রশংসা করছেন।
সিএনজি চালক রবউল্লাহ
বলেন, সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায় অপরিচিত ৪জন লোক তাদের সাথে থাকা পঙ্গু একজন ব্যক্তিকে কাঁধে বহন করে নিয়ে সিএনজি গাড়িতে উঠেন। আমার গাড়িতে অন্য তিনজন উঠে৷ তারা সবাই আমাদের জানায় তারা বনভোজনে এসেছে। তারা বলেছে তাদের পঙ্গু ব্যক্তি নাকি গাছ থেকে পড়ে কোমর ভেঙে গেছে৷ তাকে চিকিৎসার জন্য মৌলভীবাজার নিয়ে যাবে বলছে৷ আমরা তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞেস করে কথাবার্তা সন্দেহজনক হলে তাদের কৌশলে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসি। আমাদের সাথে ওই লোকেরা প্রতি সিএনজি গাড়ির ভাড়া এক হাজার টাকা নির্ধারণ করেছিল৷ কিন্তু আমরা টাকার লোভ না করে তাদেরকে কৌশলে পরিষদে নিয়ে এসে প্রশাসনের কাছে তুলে দেই। কিন্ত আমরা এখনো গাড়ি ভাড়া পাইনি।
আরেক সিএনজি চালক আবদুল কুদ্দুস বলেন, আমার গাড়িতে ছয়জন অপরিচিত লোক উঠেন৷ এরমধ্যে একজন চিকিৎসক রয়েছেন। আমিও তাদের নিয়ে আসি পরিষদে৷
সিএনজি চালক লকুছ মিয়া জানান, আমার গাড়িতে ল্যাংড়া (পঙ্গু) একজন ব্যক্তি উঠেছিল তার ৪ জন সহযোগীদের নিয়ে। আমি তাদেরকে নিয়ে যাই রবিরবাজারে। সেখানে আমাদের সিএনজি স্ট্যান্ডে গিয়ে গাড়িটি থামাই। এসময় রবিরবাজার-কর্মধা সিএনজি লাইনের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় ১০-১২টি সিএনজি যোগে কড়া পাহাড়ায় তাদের ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসি।
কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ ১৭জন জঙ্গি সদস্য আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গত শনিবারের অভিযানের পর থেকে কুলাউড়া থানা পুলিশ ও আমাদের নজরদারি ছিল। রবিবার রাতে তারা পাহাড় থেকে নেমে অন্যত্র পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল। থানা পুলিশের সদস্যদের সাথে আমার পরিষদের সকল সদস্য পুরো পাহাড় এলাকা নজরদারিতে রেখেছিল৷ রবিবার বিকেলে আমার এলাকার একটি যুবক পাহাড়ের ভিতরে বনায়ন দেখতে যায়৷ সেখানে ফানাই পুঞ্জির পূর্ব পার্শ্বে পাহাড়ের গহীনে ১৭-১৮ জন অপরিচিত লোককে ওই যুবক দেখে এসে বিষয়টি আমাকে জানায়। আমি বিষয়টি প্রশাসনকে অবগত করি। রবিবার রাতেই থানা পুলিশের সদস্য, পরিষদের সদস্য, গ্রাম পুলিশসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের খোঁজাখুজি করি। তারা একত্রে জুড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী ফুলতলা ইউনিয়নের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো৷ সোমবার সকালে জঙ্গি সদস্যরা পাহাড় থেকে নেমে স্থানীয় আছকরাবাদ চা-বাগানের গেইটে এসে সিএনজিতে উঠে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টা করে৷ কিন্তু আমার ইউনিয়নের সিএনজি চালক ভাইয়ের তাদের কথাবার্তা সন্দেহ হলে কৌশলে তাদের পরিষদে নিয়ে আসেন। সিএনজি চালক ভাইদের সাহসী বীরত্বের জন্য তাদেরকে পরিষদ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
পরে প্রেসবিফিংয়ে সাংবাদিকদের ১৭ জন জঙ্গি সদস্যদের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটিটিসি প্রধান মো: আসাদুজ্জামান বলেন, তাদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে একজন চিকিৎসক ও চায়নায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুজন ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন৷ তারা একদিনে ঘর থেকে হিজরত করতে বের হয়নি। রাত গভীর হওয়ায় পাহাড়ের নির্জন স্থানে যাওয়া সম্ভব হবেনা বিধায়
আগামীকাল মঙ্গলবার সকালে আটককৃতদের নিয়ে পাহাড়ের ভিতরে তাদের সেই আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করা হবে। কারণ পাহাড়ের ভিতরে নির্জনস্থানে কিভাবে আস্থানা করে তারা আত্মগোপনে ছিল এবং তাদের ভবিষ্যৎ মূল পরিকল্পনা কি ছিল সেটি তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে। তিনি আরো বলেন, উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ নির্মুলে বাংলাদেশ পুলিশ সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। একদম নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করেছিল কিন্তু গত ৭ আগস্ট ঢাকা থেকে ১০ জন, ১২ আগস্ট কুলাউড়া থেকে ১০ জন ও ১৪ আগস্ট স্থানীয় জনগণের সহায়তায় আরো ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই। জঙ্গি ও উগ্রবাদদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য পাওয়া সময় সাপেক্ষ বিষয়। তাদেরকে স্বল্প সময়ে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। তবে আমাদের ধারণা, তাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রায় দেড় মাস আগে কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলী গ্রামের বাসিন্দা ও কাতারপ্রবাসী রাশিদ আলীর মালিকানাধীন ৫০ শতকের টিলাভূমি কেনেন ইমাম মাহমুদের কাফেলা সংগঠনের সদস্যরা। তিনটি টিনের ঘর তৈরি করে তারা বসবাস শুরু করেন। স্থানীয়দের সন্দেহ হলে নদীগর্ভে নিজেদের বাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখানে এসে ভূমি ক্রয় করেছেন বলে জানাত। তারা সেখানে সবজি চাষ, সামাজিক বনায়ন করার কথা বলত।
গত শনিবার (১২ আগস্ট) সেই বাইশালী টিলায় চার ঘন্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালিয়ে সিরাজগঞ্জের একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক তানজিম সোহেলের স্ত্রী মায়েশাসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, সোয়াট, জেলা পুলিশ ও কুলাউড়া থানার পুলিশ৷ এর আগে গত শুক্রবার রাত ৮টা থেকে ওই বাড়ি ঘিরে রাখে জেলা ও স্থানীয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ১০ জঙ্গি সদস্যরা নব্য জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র সদস্য। তাদের আস্তানা থেকে প্রায় তিন কেজি বিস্ফোরক, ৫০টির মতো ডেটোনেটর, তিন লাখ ৬১ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণসামগ্রী, কমব্যাট বুট এবং কয়েক বস্তা জিহাদি বই জব্দ করা হয়।
ঢাকা থেকে আগত সিটিটিসি এর আভিজানিক দল কুলাউড়ায় আটককৃত জঙ্গিদের হেফাজতে নিয়েছেন। আগামীকাল অভিযান অব্যাহত থাকবে। বিস্তারিত অভিযান শেষে জানানো হবে।