রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা হোক বা কৃত্রিম মেধার দুনিয়া। প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে ভূরাজনৈতিক। সব ক্ষেত্রেই আমেরিকাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে চিন। শুধু তা-ই নয়, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে যুদ্ধের ময়দানে দুই মহাশক্তির মুখোমুখি হওয়াও খুব একটা আশ্চর্যের নয়। ড্রাগন বনাম যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আগে সামরিক দিক থেকে কে কতটা এগিয়ে, তা নিয়ে দুনিয়া জুড়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
সম্প্রতি ফৌজিশক্তি অনুযায়ী বিশ্বের ১৪৫টি দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’। সেখানে প্রথম স্থানে রয়েছে আমেরিকা। তালিকায় তিন নম্বর জায়গা পেয়েছে চিন। দুই মহাশক্তিধরের মধ্যে পার্থক্য ক্রমশ কমছে। একে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে দাবি করেছেন বিশ্লেষকেরা।
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’ জানিয়েছে, একাধিক বিষয়ের উপরে ভিত্তি করে ওই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সামরিক বাজেট, হাতিয়ার এবং সৈন্যসংখ্যা। কোন দেশ কী ধরনের মারণাস্ত্র ব্যবহার করে, সে দিকটিও খতিয়ে দেখেছে তারা। শূন্যকে সূচক ধরে বিশ্বের তাবড় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির ফৌজি র্যাঙ্কিং দিয়েছে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’। যে দেশ শূন্যের যত কাছে যেতে পেরেছে, তালিকায় তত উপরে স্থান পেয়েছে সে।
‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার’-এর তালিকা অনুযায়ী, চলতি বছরে আমেরিকান ফৌজের প্রাপ্ত নম্বর দাঁড়িয়েছে ০.০৭৪৪। অন্য দিকে চিনকে ০.০৭৮৮ নম্বর দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। বাজেটের ক্ষেত্রে অবশ্য দুই দেশের আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ৯০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ করে ওয়াশিংটন। সেখানে ফৌজের পিছনে বেজিং খরচ করেছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি ডলার।
চিনের জনসংখ্যা আমেরিকার কয়েক গুণ বেশি। আর তাই বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ (পিএলএ) কলেবরে বেশ বড়। ড্রাগনের লালফৌজে রয়েছে ২০ লক্ষের বেশি সৈনিক। ওয়াশিংটনের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগনের হাতে রয়েছে প্রায় ১৪ লক্ষ সেনার বাহিনী।
তবে রিজ়ার্ভে থাকা সৈনিকদের সংখ্যার নিরিখে পিএলএ-র থেকে এগিয়ে রয়েছে আমেরিকান ফৌজ। যুক্তরাষ্ট্রের রিজ়ার্ভ ফোর্স ৭.৯৯ লক্ষ সৈনিককে নিয়ে গঠিত। আর চিনের রিজ়ার্ভ বাহিনীতে রয়েছে ৫.১ লক্ষ সেনা। পেন্টাগনের কোনও আধা সেনার বাহিনী নেই। বেজিঙের কাছে এই ধরনের সৈনিক রয়েছে ৬.২৫ লক্ষ।
বর্তমানে ১৩ হাজার ৪৩টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করছে আমেরিকান বায়ুসেনা। এর মধ্যে বোমারু বিমান ও লড়াকু জেটের সংখ্যা ১,৭৯০। পিএলএ বায়ুসেনার কাছে রয়েছে ৩,৩০৯টি যুদ্ধবিমান। এর মধ্যে রয়েছে ১,২১২টি বোমারু বিমান ও লড়াকু জেট। দু’টি দেশ মালবাহী ফৌজি বিমান ব্যবহার করে যথাক্রমে ৯১৮ এবং ২৮৯টি। মাঝ আকাশে জ্বালানি ভরতে সাহায্য করা এবং রাডার সম্বলিত সেনা বিমান আমেরিকার কাছে রয়েছে ২,৬৪৭টি। অন্য দিকে ৪০২টি এই ধরনের বিমান ব্যবহার করে পিএলএ বায়ুসেনা।
পেন্টাগনের কাছে রয়েছে ৫৮৪৩টি ফৌজি হেলিকপ্টার। এর মধ্যে হামলাকারী কপ্টারের সংখ্যা ১,০০২। চিনা বায়ুসেনা ব্যবহার করছে ৯১৩টি হেলিকপ্টার। এর মধ্যে ২৮১টি যে কোনও ধরনের আক্রমণে সক্ষম।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থলবাহিনীর কাছে রয়েছে ৪,৬৪০টি ট্যাঙ্ক। পাশাপাশি ৩ লক্ষ ৯১ হাজার ৯৬৩টি সাঁজোয়া গাড়ি ব্যবহার করে তারা। চিনা লালফৌজে ট্যাঙ্ক রয়েছে ৬,৮০০টি। এ ছাড়াও ১ লক্ষ ৪৪ হাজার ১৭টি সাঁজোয়া গাড়ি আছে পিএলএ-র কাছে।
৩,৪৯০টি চাকাযুক্ত কামান রয়েছে বেজিঙের অস্ত্রাগারে। অন্য ধরনের কামানের সংখ্যা হাজার। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হাতে থাকা চাকাযুক্ত কামানের সংখ্যা ৬৭১। পাশাপাশি ১,২১২টি অন্য ধরনের কামান রয়েছে। আমেরিকা ও চিনা বাহিনীতে রকেট আর্টিলারির সংখ্যা যথাক্রমে ৬৪১ এবং ২,৭৫০।
বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবহরের মালিকানা রয়েছে বেজিঙের কাছে। সেখানে রয়েছে ৭৫৪টি রণতরী। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা ৪৪০। এর মধ্যে ১১টি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে আমেরিকার। পিএলএ নৌসেনা ব্যবহার করে ৩টে বিমানবাহী যুদ্ধপোত।
আমেরিকার ডুবোজাহাজ ও হেলো ক্যারিয়ারের সংখ্যা যথাক্রমে ৭০ এবং ৯। চিনের কাছে রয়েছে ৬১টি ডুবোজাহাজ। এ ছাড়া ৪টি হেলো ক্যারিয়ার রয়েছে পিএলএ নৌসেনার অস্ত্রাগারে।
আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে দাপিয়ে বেড়াতে ৮১টি ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ রয়েছে আমেরিকার কাছে। যুক্তরাষ্ট্রকে টক্কর দিতে ৫০টি ডেস্ট্রয়ার ব্যবহার করেন চিনের জলযোদ্ধারা। বেজিঙের কাছে ফ্রিগেট রয়েছে ৪৭টি। এই শ্রেণির কোনও যুদ্ধজাহাজ ব্যবহার করে না আমেরিকার নৌসেনা।
পিএলএ-র নৌবহরে রয়েছে ৭২টি করভেট, ১৫০টি পেট্রল ভেসেল এবং ৩৬টি মাইন সুইপার শ্রেণির ছোট যুদ্ধজাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রের নৌসেনা বা উপকূলরক্ষী বাহিনীর কাছে একটিও পেট্রল ভেসেল নেই। তবে ২৬টি করভেট এবং আটটি মাইন সুইপার রয়েছে পেন্টাগনের।
পরমাণু অস্ত্রের নিরিখে অবশ্য বেজিঙের থেকে বহু যোজন এগিয়ে রয়েছে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের কাছে রয়েছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি আণবিক অস্ত্র। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর দাবি, চিনা লালফৌজের কাছে রয়েছে অন্তত ৬০০টি পরমাণু ওয়ারহেড। এই সংখ্যা হাজারে নিয়ে যেতে লাগাতার চেষ্টা করছেন ড্রাগনভূমির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বর্তমানে দু’টি দেশই ড্রোন শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। আমেরিকার কাছে ১৪ হাজারের বেশি মানববিহীন উড়ুক্কু যান রয়েছে। চিনের হাতে থাকা ড্রোনের সংখ্যা স্পষ্ট নয়। তবে বেজিং একটি ড্রোনবাহী রণতরী তৈরিতে হাত দিয়েছে। অদৃশ্য লেজ়ার হাতিয়ার, সমুদ্রের গভীরে চলাচলে সক্ষম ড্রোন, সাইবার এবং মহাশূন্যের যুদ্ধের অস্ত্র প্রস্তুতিতেও দুই দেশের মধ্যে বেশ প্রতিযোগিতা রয়েছে।
সব দিক বিচার করে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা চিনের থেকে আমেরিকাকে বেশ কিছুটা এগিয়ে রেখেছেন। এর মূল কারণ হল যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। গত কয়েক দশক ধরে এর সঙ্গে কোনও পরিচয় নেই চিনা লালফৌজের। অন্য দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ছোট ও বড় মিলিয়ে একাধিক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই পেন্টাগনের সেনাকর্তারা পিএলএ জেনারেলদের লড়াইয়ের ময়দানে মাত দিতে পারবেন বলে মনে করেন তাঁরা।