শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ১১:৩২ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্ক: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অবৈধভাবে কিডনি কেনা-বেচার সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা শাহরিয়ার ইমরানসহ এই চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনারদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাঠাতেন। চক্রটি প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য রোগীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিলেও কিডনি ডোনারকে তিন থেকে চার লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে দিতেন দুই লাখ টাকা। চক্রটি এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষকে কিডনি বিক্রির জন্য পার্শ্ববর্তী দেশে নিয়ে গেছে। মঙ্গলবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, সোমবার দিনগত রাত থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত র্যাব-৫, র্যাব-২ ও র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার যৌথ অভিযানে জয়পুরহাট ও রাজধানীর নর্দা এলাকা থেকে কিডনি কেনাবেচা সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ, মেহেদী হাসান, সাইফুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান ও তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু।
অভিযানে ভুক্তভোগী কিডনিদাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য পাসপোর্ট, ভিসা সম্পর্কিত বেশকিছু কাগজপত্র, পাঁচটি মোবাইল ও দেশি-বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়ে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ ক্ষেত্র বিশেষ গ্রাহকরাও প্রতারিত হচ্ছে। আইন বহির্ভূত, স্পর্শকাতর ও অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের কার্যক্রম চক্রের সদস্যরা অর্থের লোভে অমানবিক কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব সাইবার মনিটরিং সেল ভার্চুয়াল জগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবৈধ কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গ কেনাবেচা সিন্ডিকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। সিন্ডিকেট সদস্যরা অনলাইনে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহক ও ডোনারদের আকৃষ্ট করছে। একইসঙ্গে অপরাধের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করছে। ফলে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানায়, চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে অবৈধ কিডনি কেনাবেচার সম্পূর্ণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে। চক্রের প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। চক্রের দ্বিতীয় দলটি প্রথম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে তৃতীয় একটি গ্রুপ প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পর তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে। এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারকে বিদেশের এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমদের বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে বিমান ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রেপ্তাররা এই চক্রের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করতো। বিপরীতে তারা কিডনি ডোনারকে তিন থেকে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করে অগ্রিম দুই লাখ টাকা দিতো। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের পর প্রলোভনের শিকার কিডনিদাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে নানা ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করতো।
চক্রের হোতা ইমরান প্রতিটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন বাবদ পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা, মান্নান ও তাজুল প্রতি কিডনি দাতা সংগ্রহ বাবদ যথাক্রমে পাঁচ লাখ ও তিন লাখ টাকা গ্রহণ করত। আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য চক্রটি কোনো ধরনের রিসিট, পাসপোর্ট বা অন্যান্য প্রমাণ ভুক্তভোগী ডোনারকে সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকতো। চুক্তি অনুযায়ী কিছু অর্থ ও ভয় ভীতি দেখিয়ে ভিকটিমদের চুপ রাখার চেষ্টা করতো তারা।
চক্রের মূলহোতা ও অন্যতম আসামি শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতায় একটি দালাল চক্র প্রতিষ্ঠা করে অনলাইনের মাধ্যমে আগ্রহী বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতেন। ইমরান ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসা সেবা’ এবং ‘কিডনি লিভার চিকিৎসা সেবা’ নামের দুটি পেজের এডমিন। এ পর্যন্ত তিনি কিডনি বিক্রির জন্য শতাধিক মানুষকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছেন।
চক্রের অন্যতম সদস্য আব্দুল মান্নান মূলত ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এই অনৈতিক কাজে প্রলুব্ধ করতেন। ইতিপূর্বেও এই অপরাধের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হন তিনি। তার বিরুদ্ধে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টির বেশি মামলা রয়েছে।