মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গত কয়েকমাস ধরেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনার যে অভিযোগ উঠেছিল, তা তিনি নাকচ করে এসেছেন।
কিন্তু এখন তিনি একটি শান্তি চুক্তি নস্যাৎ করে দিয়ে ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দুইটি এলাকায় সৈন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। যাকে তিনি বলছেন, শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত সৈন্য।
গত কয়েকমাসে ইউক্রেন সীমান্ত জুড়ে দেড় লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে রাশিয়া।
অনেকের আশঙ্কা, ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের এটা প্রথম ধাপ।
কিন্তু কেন ইউক্রেনে সৈন্য পাঠালো রাশিয়া?
যখন ২০১৪ সালে রাশিয়া প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে, তখন প্রেসিডেন্ট পুতিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বেশ বড় একটি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এরপর থেকেই তারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে।
যুদ্ধ বন্ধে একটি আন্তর্জাতিক মিনস্ক শান্তি চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু লড়াই তাতে থামেনি। আর এই কারণেই রাশিয়ার নেতা বলছেন, ওই অঞ্চলে তিনি তথাকথিত শান্তি রক্ষী পাঠাচ্ছেন।
তার এই বক্তব্যকে ‘বাজে কথা’ হিসাবে দেখছে পশ্চিমা দেশগুলো। তারা মনে করছে, মস্কো পুরো ইউক্রেনের ওপর হামলা করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
খবর পাওয়া যাচ্ছে, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় ট্যাংক এগিয়ে যাচ্ছে এবং ইউক্রেন সীমান্তের ১৫ থেকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রাশিয়ার সৈন্য অবস্থান নিয়েছে।
ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের সমস্যা কোথায়?
ইউক্রেন যে নেটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে চায়, অনেক দিন ধরে সেই বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে রাশিয়া।
এখন মি. পুতিন দাবি করেছেন, ইউক্রেন পশ্চিমা দেশগুলোর হাতের পুতুল এবং কখনোই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না।
তার মূল দাবী হলো, পশ্চিমা দেশগুলোকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, ইউক্রেন নেটোতে যোগ দেবে না।
নেটো হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর একটি সামরিক জোট, যেখানে ৩০টি দেশ রয়েছে।
তবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি দেশ হিসাবে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের গভীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে রুশ ভাষাও ব্যাপকভাবে বলা হয়।
তবে ২০১৪ সালে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে সেই সম্পর্ক অনেকটা ফিকে হয়ে উঠেছে।
যখন ২০১৪ সালে রাশিয়াপন্থী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, সেই সময় ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। সেই লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী এলাকাগুলোর স্বীকৃতি দিলে সমস্যা কোথায়?
এখন পর্যন্ত তথাকথিত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক প্রজাতন্ত্র প্রকারান্তরে রাশিয়াই পরিচালনা করছে।
এই দুইটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে মি. পুতিনের স্বীকৃতির ফলে রাশিয়া এখন সেখানে সরাসরি সৈন্য পাঠাতে পারবে। তারা সেখানে সামরিক ঘাটিও তৈরি করতে পারবে।
যে এলাকায় প্রতিদিনই অসংখ্যবার যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে রাশিয়ার সেনাদের অবস্থান বড় আকারের যুদ্ধের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
তবে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, বিদ্রোহীরা শুধুমাত্র যেটুকু এলাকার নিয়ন্ত্রণ করছে, শুধু সেটাই দাবি করছে না, তারা পুরো দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করছে।
পূর্ব ইউক্রেনে দেশটির সরকার ‘গণহত্যা’ করেছে, এমন মিথ্যা দাবি তুলে রাশিয়া এর মধ্যেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। ওই এলাকায় দেশটি ৭ লক্ষের বেশি পাসপোর্ট বিতরণ করেছে। সুতরাং তারা সেখানে কোন অভিযান শুরু করলে দাবি করতে পারবে যে, নিজেদের নাগরিকদের রক্ষায় তারা অভিযান করছে।
রাশিয়া কতদূর যেতে পারে?
ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো শুধুমাত্র পূর্ব ইউক্রেনের শান্তি চুক্তি ভেঙ্গে দিয়ে সেখানেই থেমে যেতে পারেন। তারা দাবি করেছে, ইউক্রেনে রাশিয়া কোন হামলা করছে না।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো মনে করে, রাশিয়া আরও সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন,” আমাদের বিশ্বাস, তারা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ লক্ষ্য করে এগোচ্ছে, যেখানে দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষ বসবাস করে।”
এই সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
ধারণা করা হয়, ইউক্রেনের পূর্ব, উত্তর আর দক্ষিণ দিক থেকে হামলা করে ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করতে পারে রাশিয়া।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফলে রাশিয়াকেও চরম বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে।
পশ্চিমা দেশগুলো কী করতে পারে?
ইউক্রেনে রাশিয়ার পদক্ষেপ বেআইনি বলে এর নিন্দা জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এটি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন।
তবে নেটো পরিষ্কার করে দিয়েছে, ইউক্রেনে তাদের সৈন্য পাঠানোর কোন পরিকল্পনা নেই। তবে ইউক্রেনকে তারা পরামর্শক, অস্ত্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করবে।
তবে রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ একাধিক দেশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আরও বড় ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তুতিও রাখা হয়েছে।
রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর এসব নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে সংকটে ফেলবে। বিশেষ করে রাশিয়ার ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশটির আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিপর্যয় তৈরি হবে। তবে সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় অর্থনীতির ওপরেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তবে নেটো জানিয়েছে, বাল্টিক দেশগুলোয় তারা অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করছে।
পুতিন কী চান?
রাশিয়ার প্রথম দাবি হলো, নেটোকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, তারা আর সম্প্রসারণ করবে না। বিশেষ করে ইউক্রেনকে কখনোই ওই জোটে নেয়া হবে না।
মি. পুতিন বলেছেন – ইউক্রেন কোন দিনই প্রকৃত অর্থে একটা রাষ্ট্র ছিল না। তিনি এর আগেও বলেছেন, এখন যা ইউক্রেন তা আসলে ‘প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড।’
তার আরেকটি দাবি, রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি কোন আক্রমণকারী অস্ত্র মোতায়েন করতে পারবে না নেটো।
সেই সঙ্গে ১৯৯৭ সালের পর যেসব দেশ নেটোর সদস্য হয়েছে, সেসব দেশ থেকে সৈন্য এবং সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নিতে হবে।
এর মানে হলো, মধ্য ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ এবং বাল্টিক সাগরের তীরের দেশগুলো থেকে নেটোর সৈন্যদের সরাতে হবে।
নেটো কী বলছে?
নেটো হচ্ছে ৩০টি দেশের একটি প্রতিরক্ষা জোট, নতুন সদস্যদের জন্য যাদের দরজা সবসময়ে খোলা। তারা এই নীতি পাল্টাতে রাজি নয়।
নেটোতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে একটি পরিষ্কার সময়সীমা চেয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট, তবে জার্মানি পরিষ্কার করে দিয়েছে, এটা খুব তাড়াতাড়ি ঘটবে না।
বরং নেটোর কোন সদস্য দেশ তাদের সদস্যপদ ত্যাগ করবে এমন সম্ভাবনাও নেই।
কূটনৈতিক সমাধানের কোন পথ কী আছে?
আলোচনা চলছে, তবে কূটনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। জো বাইডেন-ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠকের চেষ্টা করছে ফ্রান্স, কিন্তু সেখানে সফলতার সম্ভাবনা খুব কম।
আলোচনা সফল হতে হলে সেখানে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ বন্ধ এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সমঝোতা হতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব দিয়েছে যে, স্বল্প এবং মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সীমিত করার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। সেই সঙ্গে আন্ত-মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপারেও একটি নতুন চুক্তি হতে পারে।
পরস্পরের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাটিগুলো পরিদর্শনের একটি পদ্ধতি তৈরির প্রস্তাবেও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে রাশিয়া। এর ফলে রাশিয়ার দুইটি এবং রোমানিয়া ও পোল্যান্ডের দুইটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাটি নিয়মিত পরিদর্শন করবে যৌথ দল।