1. [email protected] : Admin : sk Sirajul Islam siraj siraj
  2. [email protected] : admi2017 :
  3. [email protected] : Sk Sirajul Islam Siraj : Sk Sirajul Islam Siraj
  • E-paper
  • English Version
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩১ অপরাহ্ন

ব্রেকিং নিউজ :
বিনোদন :: গান গাইতে গাইতে মঞ্চেই গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু!,  খেলার খবর : অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, বিমানবন্দরে যুবাদের জানানো হবে উষ্ণ অভ্যর্থনা,

খাসি পানের চাহিদা বেড়েছে- অপার সম্ভাবনার ধারক কুলাউড়ার পান শিল্প

  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২১
  • ২৯৬ বার পঠিত

মাহফুজ শাকিল : অন্যান্য আদিবাসীদের মতো সিলেটের পাহাড়েই একমাত্র খাসিয়া জনগোষ্ঠির বসবাস। তাদের একমাত্র অবলম্বন পান চাষ। খাসি পান চাষে যেমন বৈচিত্রতা রয়েছে তেমনই চাহিদাও রয়েছে তুঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় পান চাষে যুক্ত হয়েছেন নানা শ্রেণীর মানুষ। বাজারজাত হচ্ছে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায় পান পুঞ্জি বেশি থাকায় লংলা পরগনায় গড়ে উঠেছে সর্ববৃহৎ রবিরবাজার পানের আড়ৎ। সেখান থেকে পান দেশ বিদেশে রুপ্তানি হচ্ছে। স্বাদে এ পান যেমনিই সুস্বাদু তেমনিই রং তৈরিতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এরফলে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও এ পান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
পানের প্রচলন শুরুর পূর্বে পান চাষাবাদের প্রয়োজন সর্ব প্রথম। কারণ চাষাবাদ না করলে পান কোথায় পাবে। পান কৃষকদের উৎপাদিত একটি কৃষিজ পন্য। মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন পানপুঞ্জিতে পানের চাষাবাদ হয়ে থাকে। খাসিয়া পানপুঞ্জি সূত্রে জানা গেছে, কুলাউড়ার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ছোটবড় ৩১টি পানপুঞ্জি রয়েছে। বিশেষ করে উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের প্রায় ২৩টি পানপুঞ্জিতে পানের চাষাবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। কুলাউড়ার মুরইছড়া, মেঘাটিলা, ভালাইরমা, গুজাছড়া ও সিঙ্গুর পুঞ্জীতে গিয়ে এ প্রতিবেদক পান চাষের বিস্তর খবর জেনে এসেছেন।
পান চাষের মৌসুম ঃ
বিশেষ করে জৈষ্ঠ্য মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত পান চাষের উত্তম মৌসুম। এসময় পুরাতন গাছ থেকে কাটিং করে পানের চারা রোপণ করা হয়। চারা রোপণের এক বছরের পর গাছ থেকে পান উৎপাদন শুরু হয়ে ৩ বছর পর্যন্ত এই গাছ থেকে পান সংগ্রহ করা হয়। পানগুলো পাহাড়ের সারি সারি টিলায় সুপারি গাছ ও অন্যান্য গাছে চাষাবাদ হয়। জুমে লতানো পানগাছের পরিচর্যা করেন মূলত খাসিয়া পুরুষরা। বছরে একবার গাছের ডালপালা ও পাতা ছেঁটে দেয় তারা। এছাড়া ছাঁটানো ডালপালা ও পাতা পানগাছের গোড়ায় দিতে হয় বছরে একবার। ডালপালা ও পাতা পচে প্রাকৃতিক জৈব সার তৈরি হয়। তবে এখন অনেকে বাজার থেকে জৈব সার কিনে নিজেদের পান জুমে বেশি ফলানোর আশায় দিয়ে থাকে। খাসিয়া পুরুষরা লু-উ নামে (মই) এক ধরনের বাঁশের মই দিয়ে পান তুলে থাকে। পান তোলার সময় এরা সঙ্গে পান সগ্রহ করার জন্য ঝুঁড়ি রাখে। এই পান তুলে রাখা হয় ঝুঁড়িতে। পরে পান সংগ্রহ করে জুম থেকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসেন খাসিয়া পুরুষরা। আর খাসিয়া নারীরা ঘরে বসে পান গুছিয়ে তা বিক্রি করে। প্রথা অনুয়ায়ী সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্র“য়ারি মাস পর্যন্ত পানের ‘লংখং’ বা গাছের সম্পূর্ণ পান তোলা হয়ে থাকে। মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাস গাছে পান তেমনটা থাকে না। কিন্তুু এবার আগাম বৃষ্টি হওয়ায় পানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
পুঞ্জিগুলোতে পরিবারভিত্তিক পান চাষ ঃ
উপজেলার বিভিন্ন পানপুঞ্জিতে অনেক পরিবারের বসবাস। খাসিয়া মেয়েরা খুব লাজুক। সমাজে মেয়েদের প্রাধান্য বেশি। মেয়েরা ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী। খাসিয়া আদিবাসীরা মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। বংশ পরিচয় দেওয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে। তাই পরিবারে নারীদের অধিকারই বেশি। পুঞ্জিতে অনেক পরিবারের ৪/৫টি পানের জুম থাকে এবং নূন্যতম একটি পরিবারে ১/২টি পানের জুম থাকে। প্রতিটি জুমে ১০০০-৫০০০ পানের চারা থাকে।
পান চাষের সমস্যা ও প্রতিরোধ ঃ
পান চাষ করতে গিয়ে পানের বিভিন্ন রোগ ধরা পড়ে। উথ্রাম (পান পঁচা) একটি রোগ মারাত্মক ভাবে পানকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এছাড়া পান গাছের লতা পঁচা ক্লাম নামে একটি বিষাক্ত রোগ রয়েছে। সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হলে পানের যতœ না নিলে জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসে পানগুলো লালচে হয়ে যায়। তখন তারা নিজেদের মত পানের গোড়ায় চুন দিয়ে থাকে। খাসিয়ারা জানায়, তারা নিজেরা আদি ফর্মূলায় পান চাষ করে থাকে। কৃষি বিভাগের কোন সহযোগিতা ছাড়াই তারা এ চাষাবাদ করে আসছে। পানের রোগ নির্মূল করার জন্য সরকারীভাবে উদ্যোগ নিয়ে গবেষণা করার প্রয়োজন বলে মনে করছেন আদিবাসীরা।
পান চাষে খাসিয়াদের আয় ঃ
সপ্তাহে প্রতি সোমবার ও শুক্রবার পরে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খাসিয়ারা পান সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটান। সাঁঝের আগেই ঘরে ফেরেন। ছেলেরা গাছ থেকে পান পাড়েন। মেয়েরা ঝুড়িতে করে তা ঘরে নিয়ে আসেন। কর্মঠ প্রায় সব খাসিয়াদের হাতে একটা করে দা থাকে। নাম টাখলি দা। ঘরের মহিলারা পানের গুছি করেন। পান গুছিরত অবস্থায় স্থানীয় রবিরবাজার থেকে প্রতিদিন পাইকাররা পান ক্রয় করতে আসেন। হিসেবে ১২টি পান পাতায় এক গুছি ও ১২টি গুছিতে এক মোটা আর ২০ মোটায় হয় এক কুঁড়ি। তাদের নিজেদের মধ্যে নারী শ্রমিকও আছেন, যারা শুধু নিজের পুঞ্জিতে পান গুছি করে। এক কুঁড়ি গুছি করলে পারিশ্রমিক হিসেবে ৫০-৬০ টাকা পায় নারীরা। এক কুঁড়ি নতুন পানের (নই) দাম ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা। আর খাসিয়া পুরান পান এক কুঁড়ির দাম ৫৫০০ থেকে ৬৫০০ টাকা। বর্তমান মৌসুমে সপ্তাহে যেদিন পান বিক্রি হয় সেদিন পুঞ্জিগুলোত প্রতি পরিবার থেকে ৫ কুঁড়ি পান হলে ৬০০০-৬৫০০ টাকা পেয়ে থাকে।
পান চাষে কর্মসংস্থান সৃষ্টি :
পান চাষকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পুঞ্জিতে অনেক বাঙ্গালী যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সবগুলো পুঞ্জিতে বিশেষ করে বড় পরিবারগুলোতে ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক কাজ করে আর ছোট পরিবারগুলোতে ৪ থেকে ৫ জন শ্রমিক কাজ করছে। এই পান চাষকে কেন্দ্র করে স্থানীয়ভাবে ৪৫০ থেকে ৫০০ জন শ্রমিক কাজ করে। পুঞ্জি থেকে ৩০/৪০ টি সিএনজি গাড়ি করে পানগুলো আড়ৎ এ নিয়ে আসে। পুঞ্জি থেকে প্রায় ২০০ শ্রমিক পানগুলো পাহাড়ি টিলা বেয়ে গাড়িতে নিয়ে আসে। প্রতিজন শ্রমিক পারিশ্রমিক হিসেবে দৈনিক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত পান।
লংলা পরগণার রবিরবাজারে পানের সর্ববৃহৎ আড়ৎ ঃ
কুলাউড়া উপজেলার সর্ববৃহৎ পানের আড়ৎ রবিরবাজারে অবস্থিত। বিভিন্ন পাহাড়ের গহিনে চাষকৃত এসব পানের সিংহ ভাগ-ই আসে রবিরবাজারের বিভিন্ন আড়তে। রবিরবাজারে তিনটি মার্কেটে ছোটবড় প্রায় ৬০টি পান আড়ৎ রয়েছে। ১২০ থেকে ১৩০ জন মহাজন রয়েছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন পুঞ্জি থেকে খাসিয়া পান ও নতুন পান (নই) বাজারজাত করেন স্থানীয় প্রায় দুই হাজার পান ব্যবসায়ী। এসব আড়ৎ থেকে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারী ক্রেতারা পান ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় নিয়ে বাজারজাত করেন। এবং এই বাজারগুলো থেকে পান দেশের বাইরে বিশেষ করে লন্ডনে বাজারজাত করা হয়। সিলেটের বিভিন্ন বাজার থেকে আসা পান ব্যবসায়ী রহমান মিয়া, আব্দুল জলিল, বশির মিয়া জানান, কুলাউড়ায় চাষকৃত খাসিয়া পানের চাহিদা দেশের বিভিন্ন বাজারে রয়েছে। সহনশীল মূল্যে ভাল পান ক্রয়সহ পরিবহন ব্যবস্থা ভাল থাকায় আমরা এখান থেকে পান ক্রয় করি।
পান ব্যবসায়ীদের বক্তব্য ঃ
পূর্ব রবিরবাজার পান ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রমজান আলী ও সাধারন সম্পাদক হাজী এলাইছ মিয়া জানান, বর্তমান মৌসুমে প্রতিদিন রবিরবাজার আড়ৎ থেকে ৬-৭ লক্ষ টাকার পান বিক্রি হয়। কিন্তু এর আগে প্রতিদিন রবিরবাজার আড়ৎ থেকে ৪০ থেকে ৪৫ লক্ষ টাকার পান বিক্রি হতো। আড়ৎ থেকে সেই পানগুলো প্রায় শতাধিক গাড়ি দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।
খাসিয়াদের বক্তব্য ঃ
আন্তঃপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন (কুবরাজ) এর সাধারন সম্পাদক ও কুলাউড়া মুরইছড়া পান পুঞ্জির মন্ত্রী ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, পান চাষকে এখনো সরকারীভাবে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পানচাষে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সরকারী বেসরকারীভাবে ঋণ দেয়া হয়। কিন্তুু কুলাউড়ায় এই সুযোগ নেই। পান চাষকে কেন্দ্র করে আদিবাসী ছাড়া অনেক বাঙ্গালী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। পান চাষকে শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
কুলাউড়ার গুজাছড়া পুঞ্জীর মন্ত্রী জিমরিস ফেলে­ই বলেন, ‘এবার আগাম বৃষ্টিপাত হওয়ায় জেলার ছোট-বড় সব পুঞ্জিতেই কম-বেশি নতুন পান উত্তোলন হচ্ছে। এ পান দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। তাই সরকারি আর্থিক সহায়তা পেলে খাসিয়া পান চাষীরা আরও লাভবান হতে পারতেন। তিনি আরো বলেন, খাসিয়াদের পাহাড়ে বসবাস করা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। পাহাড়ে অনেক কষ্টের মাঝেও আমরা বসবাস করছি। একটি চক্র পাহাড় আর খাসিয়াদেরকে আলাদা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। পান চাষ করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করি।

প্লিজ আপনি ও অপরকে নিউজটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ করছি

এ জাতীয় আরো খবর..