বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ০২:৩১ পূর্বাহ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট : স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কার্যকলাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিভিন্ন মহলের লোকজন। তারা বলছেন, এলজিইডি’র তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের রাস্তা এবং ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম করা হচ্ছে। এতে করে নির্মাণকৃত রাস্তা ও ব্রিজ কালভার্ট অল্পদিনেই ধসে পড়ছে। এরফলে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এদিকে এলজিইডি’র ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই প্রেসব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বন্যায় বিভিন্ন রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে শতশত কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা জানান। কিন্ত এবার সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে নারাজ এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদার জানান, বন্যায় যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তার অধিক বরাদ্দের চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বরাদ্দ এলে অর্ধেক কাজ করে বাকি টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিধ্বস্ত কয়েকজন ঠিকাদার ভাগবাটোয়ারা করে নেন। পরবর্তীকালে আবার বন্যায় বা অন্য দুর্যোগের কারণে মেরামতকৃত রাস্তার ক্ষতি দেখিয়ে আবার বরাদ্দ আনা হয়। এভাবে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। আবার কোনো কোনো ব্রিজ মেরামতের ১৫-২০ দিনের মধ্যেই ধসে পড়ছে। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া-কুইজবাড়ী-মীরপুর রাস্তার ৯৯ মিটার পিসি গার্ডার ব্রিজের অ্যাপ্রোচ ২০২০ সালের ২৭ জুলাই ধ্বসে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসেও এ ব্রিজের অ্যাপ্রোচ মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়নি এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। এতে সদর উপজেলার কুইজবাড়ী, গালাসহ কালিহাতীর এলেঙ্গা যাতায়াত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এর ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে এ সড়কে যাতায়াতকারীরা।
২০১৬ সালের ১ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) টাঙ্গাইলের তত্ত্বাবধানে সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের বড় বাসালিয়ার লৌহজং নদীর উপর নির্মিত এই ব্রিজটির উদ্বোধন করে স্থানীয় এমপি মো. ছানোয়ার হোসেন। এটি সদর উপজেলার আঞ্চলিক সড়কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্রিজ। এটি উপজেলা সদরের মগড়া আর গালা ইউনিয়নের অন্যতম সংযোগ স্থাপনের ব্রিজ।
এর আগে ২০১৯ সালে টাঙ্গাইল এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ‘বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ (নতুন ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা) ফাউন্ডেশন টিটমেন্টের আওতায় ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই অ্যাপ্রোচ উদ্বোধনের ১৫ দিনের মাথায় ভেঙে পড়েছিল। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ এ ব্রিজের অ্যাপ্রোচে নামে মাত্র কয়েকটি বালুর বস্তা ফেলা হয়েছিল। এছাড়া কোনো কাজই করেনি ঠিকাদার বা এলজিইডি কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বন্যায় নদীতে পানি বাড়বে এটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পানি বৃদ্ধি বা স্রোতের কারণে যদি মাত্র চার বছর আগে নির্মিত ব্রিজের গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপ্রোচ ধসে যায় এমন কাজের প্রয়োজন কি? অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ঠিকাদারি নামমাত্র ব্রিজটির অ্যাপ্রোচ নির্মাণের ফলে এ ধসের সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে কুফল ভোগ করছেন এখন এ অঞ্চলের মানুষ।
টাঙ্গাইল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) অফিস সূত্র জানায়, গত বছরের বন্যায় টাঙ্গাইলে ১১টি উপজেলার ৩২৮টি রাস্তা ও ৭৩টি সেতু, কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় পৌনে ৩০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৮টি রাস্তার ১৫৩ কিলোমিটার ভেঙে ১৮ কোটি ৩ লাখ টাকা ও তিনটি সেতু, কালভার্টের ৩৭০ মিটার ভেঙে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাসাইলে ৪০টি রাস্তার ১৫৯ কিলোমিটার ভেঙে ২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা ও সাতটি সেতু, কালভার্টের ৫৬ মিটার ভেঙে ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সখিপুরে আটটি রাস্তার ৮০ কিলোমিটার ভেঙে ১৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা ও ১০টি সেতু, কালভার্টের ৩৫ মিটার ভেঙে এক কোটি ৭৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। মির্জাপুরে ২৫টি রাস্তার ১২৪ কিলোমিটার ভেঙে ৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ও ১১টি সেতু, কালভার্টের ১৮৫ মিটার ভেঙে ১৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। দেলদুয়ারে ৭১টি রাস্তার ২৪১ কিলোমিটার ভেঙে ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ও ১৩টি সেতু, কালভার্টের ৩০২ মিটার ভেঙে এক কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভূঞাপুরে ২৫টি রাস্তার ৫৬ কিলোমিটার ভেঙে ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও দুইটি সেতু, কালভার্টের ২৩ মিটার ভেঙে এক কোটি ১৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
নাগরপুরে ৩৫টি রাস্তার ১৫৯ কিলোমিটার ভেঙে ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ও পাঁচটিসেতু, কালভার্টের ৬৭ মিটার ভেঙে ৬ কোটি ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। কালিহাতীতে ১৯টি রাস্তার ১১৫ কিলোমিটার ভেঙে ৩৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ও পাঁচটি সেতু, কালভার্টের ১২৫ মিটার ভেঙে ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঘাটাইলে ৩৪টি রাস্তার ১৫০ কিলোমিটার ভেঙে ২৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা ও পাঁচটি সেতু, কালভার্টের ১২৩০ মিটার ভেঙে ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ধনবাড়ীতে ২২টি রাস্তার ৮২ কিলোমিটার ভেঙে ৩২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ও সাতটি সেতু, কালভার্টের ৮৬ মিটার ভেঙে ৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। গোপালপুরে ১০টি রাস্তার ৩৯ কিলোমিটার ভেঙে ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও পাঁচটি সেতু, কালভার্টের ২৫৩ মিটার ভেঙে ১০ কোটি ৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে এর মধ্যে কোন কোন রাস্তা এবং ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এ বিষয়ে পুরো তথ্য দিতে নারাজ এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ দুই মাসেও দেই দিচ্ছি বলে তথ্য দিতে পারছেন না তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ঠিকাদার জানান, যে রাস্তা বা ব্রিজ ভালো সেগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে বরাদ্দ আনে এলজিইডি। এরপর বরাদ্দ এলে কোনো বিশ্বস্ত ঠিকাদারের লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ না করেই সেই বরাদ্দের টাকা ভাগাভাগি করে নেয় কর্মকর্তা-কর্মচারি ও ঠিকাদার। এছাড়া অন্য কোজের ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের কাছ থেকে সরকারি আয়কর-ভ্যাটের ১২ শতাংশ ছাড়াও চূড়ান্ত বিলের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের দেওয়া হয় মোটা অংকের ঘুষ। আর এটাকে ঠিকাদারদের ভাষায় বলা হয় অফিস পিসি। আর এই পিসি না দিলে কাজের বিল পেতে অনেকটা বেগ পেতে হয় ঠিকাদারদের।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, কোন কোন রাস্তা বা ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতি হয়েছে সেটির পুরোপুরি তথ্য তার কাছে বর্তমানে নেই। তবে কি কি কাজ করা হয়েছে সেই তথ্যগুলো আছে সেই তথ্য নিতে পারবেন। এই বলে ফোন কেটে দেন তিনি। এদিকে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান জানান, ঠিকাদারদের চূড়ান্ত বিল দেওয়ার জন্য অফিসে কোন ঘুষ নেওয়া হয় কি না এ বিষয়ে অ্যাকাউন্স বলতে পারবে। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
বাংলানিউজকে