শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৬:৪৬ অপরাহ্ন
মো: সাকির হোসেন চৌধুরী: ব্যবসা থেকে বছরে তার আয় ২লাখ ৬০হাজার, কৃষি খাত থেকে আসে ১০হাজার ৩৮টাকা। সব মিলিয়ে আয় ২ লাখ ৭০হাজার ৩৮টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমানো রয়েছে ২ লাখ টাকা। নগদ ১লাখ ১২হাজার টাকা। ৩২হাজার টাকা মূল্যমানের স্বর্ণ ও অন্যান্য অলংকার। দুটি গাড়ির মূল্য ১১লাখ ৮৫হাজার টাকা। ঘরের আসবাবপত্রের মূল্য ৬০ হাজার টাকা। নিজের কোনো জমি নেই। পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কৃষি-অকৃষি জমি দেড় একরের মতো। এটি সংসদ নির্বাচনের সময় একজন রাজনীতিকের হলফনামায় দেওয়া সম্পদের বিবরণ । যদি এটাই প্রকৃত চিত্র হয়ে থাকে, তবে সংসদ সদস্য হওয়ার পর বদলে গেছে তার অর্থভান্ডার। নানাভাবে উদর ভরে রোগাক্রান্ত সেই ভান্ডার এখন বড্ড নাদুসনুদুস। ফুলেফেঁপে ওঠার এই গল্পের নায়ক হচ্ছেন মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য নেছার আহমদ। তিনি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার আগে আধাপাকা একটা বাড়িতে যার বাস ছিল, এখন তিনি আলিশান বাড়ির বাসিন্দা। তা-ও আবার দু-দুটি। শহরের গুজারাই এলাকায় একতলা পুরোনো ভবনের সামনেই এমপি হওয়ার বদৌলতে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ভবন দুটি। চারতলা বিশিষ্ট প্রতিটি ভবনই বিশাল এলাকাজুড়ে বানানো। শহরের ব্যস্ততম চৌমুহনীতেও কিনেছেন বাড়ি। তবে পুরোনোকে ভুলে যাননি তিনি। আগের বাড়িটিকেও রিনোভেট করে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছেন। সম্পদ গড়েছেন সিলেট শহরেও। এ তো গেল তার ‘মাথা গোঁজার’ ঠিকানা। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া নেছার আহমদের হলফনামা ঘেঁটে দেখা যায়, অনেকটা নিঃস্ব জীবনযাপন করতেন জেলা আওয়ামী লীগের এ সভাপতি। কৃষি ও ব্যবসা থেকে যে আয় আসত, তা দিয়েই চলতেন তিনি। হলফনামায় অবশ্য পেশা হিসেবে কিছু উল্লেখ করেননি। এমন একজন ‘অতি সাধারণ’ জীবনযাপনকারী রাজনীতিকের জীবনটা এখন পাল্টে গেছে। মৌলভীবাজার ঘুরে দেখা গেছে, এমপি হওয়ার পর তিনি রাতারাতি সম্পদশালী। এবার আসা যাক তার ‘জীবিকার’ দিকে। খালি কলস তার এখন পূর্ণ হয়ে যেন উপচে পড়ছে। দিনে দিনে গড়ে তুলেছেন নানা ব্যবসা-বাণিজ্য। আসলে সাধারণ মানুষের আপত্তি অন্যখানে। তারা বলছেন, সিএনজি স্টেশন থেকে শুরু করে ভবন নির্মাণ, টেন্ডার, সর্বত্র এমপির নামে বখড়া আদায় করা হয়। তা-ও আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে। রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এখন তার তুঙ্গে! মৌলভীবাজার আওয়ামী লীগের একক নিয়ন্ত্রক এ সংসদ সদস্য। স্থানীয়ভাবে যা এমপি লীগ নামেই পরিচিতি পেয়েছে। এই যে একাধিপত্য, এর চালকের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন এমপির স্ত্রীর বোনজামাই আজমল আহমেদের ওপর। আজমল আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। সিএনজি থেকে শুরু করে শহরের সব সরকারি অফিসের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে একক আধিপত্য তার। আজমল আহমেদের ছেলে ইমরান আহমেদ শাওন এমপির ব্যক্তিগত সহকারী। তিনি আবার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। নেছার আহমেদ বিশ্বস্তদের মাধ্যমে দখলে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের অন্য সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের পদ। এমপি এবং তার ভায়রা ভাইয়ের আধিপত্যের কারণে এ জেলার আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আজিজুর রাহমান ও সৈয়দ মহসিন আলীর পরিবার স্থানীয় রাজনীতি থেকে প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে। সুযোগ পেয়েছেন অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিত ব্যক্তিরা, যারা বর্তমানে এমপির নিজের মানুষ হিসেবে পরিচিত। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে এ দুই পরিবারের সদস্যরা এলাকায় দলীয় বা সরকারি অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান না। এমনকি নেতাকর্মীদের দুই পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না রাখতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমপি নেছার আহমদের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন আজিজুর রহমান। রাজনীতিকে ভালোবেসে চিরকুমার হিসেবেই থেকে গেছেন। ছিলেন কেন্দ্রীয় এবং জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা। আজিজুর রহমানের মৃত্যুর পর তার অবদানকে মুছে ফেলার আয়োজন শুরু করেন নেছার আহমদ। পরিবারের সদস্যদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তার ভাতিজা সজিব হাসান চাঁদনীঘাট ইউনিয়নে নির্বাচন করতে চাইলে এমপি তাকে নির্বাচন করতে দেননি। জেলা যুবলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন আরেক ভাতিজা নাহিদ আহমেদ। তবে নেছার আহমদের রোষানলে পড়ে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়। অন্যদিকে জেলার রাজনীতিতে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। তিনি মারা যাওয়ার পর তার বলয়ের নেতাকর্মী এবং তার পরিবারকেও রাজনীতি থেকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অনুসারীদের মারধর এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন রাজনীতি থেকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ, এলজিআরডি, সমাজসেবা, সড়ক ও জনপথসহ প্রতিটি অফিসে একক নিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলেছেন আজমল হোসেন। নিজেদের পছন্দসই কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন এলাকায় রেখে দেন। আর যারা তার কথামতো কাজ করেন না, তাদের বদলির ব্যবস্থা করা হয়। জানা যায়, সদর উপজেলার প্রকল্প কর্মকর্তা বহু বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন। এমপি ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। এমনকি সব উন্নয়ন কাজ থেকে নেওয়া হয় উপঢৌকন। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরেও দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আহমেদ হোসেন। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। ইউনিয়ন পরিষদের তিনবার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। আহমেদ হোসেনের আগে তার বাবা-চাচাও এ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই আহমেদ হোসেন অভিমানে রাজনীতি করতে চান না। তিনি বলেন, অপমান-অপদস্থ হতে আর ভালো লাগে না। এমপি নানা সময়ে অপমান করেন। প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শত শত মানুষের সামনে গালমন্দ করেছেন। মারধর করতেও উদ্যত হন। সারাজীবন আওয়ামী লীগ করে নিজ দলের নেতার হাতে লাঞ্ছিত হতে হবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। শুধু আহমেদ হোসেনই নয়, এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক। ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না তারা। সবাই বলছেন, এমপি লীগের সদস্যরা এমপির বিরুদ্ধে মিনিমাম সমালোচনা সহ্য করতে পারে না।আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে বংশপরম্পরায় যুক্ত অনেকেই জানান, মৌলভীবাজার জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আমিরুল হোসেন চৌধুরীর বাবা জাসদ নেতা এবং সাধারণ সম্পাদকের মাহবুব আলমের বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে তাদেরই সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক বানানোর সুপারিশ করেন নেছার আহমদ। এ ছাড়া সদর উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালিক তরফদার শোয়েব বিলেত প্রবাসী। তাকে দেশে এনে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বানান নেছার আহমদ। বর্তমানে এমপি ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা রুমেল আহমেদ। একসময় অটোরিকশার ব্যবসায়ী এ যুবনেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে ছাত্রদলের রাজনীতি করারও। এর পরও নেছার আহমদ তাকে যুবলীগের সাংঠনিক সম্পাদক বানান। বর্তমানে তিনি জেলা যুবলীগের সভাপতি প্রার্থী। জানা যায়, মৌলভীবাজার শহর এবং শহরতলির অটোরিকশার নিয়ন্ত্রণ এ রুমেল আহমেদ এবং তার অনুগতদের। অবৈধ এ বাহনটি রাস্তায় চলাচল করতে বিভিন্ন জায়গা ম্যানেজ করেন তিনি। আর এ বাবদ নতুন কোনো অটোরিকশা রাস্তায় চলাচল শুরু করলে রুমেল সিন্ডিকেটকে দিতে হয় ২ লাখ টাকা করে। একই সঙ্গে মৌলভীবাজার জেলায় কয়েক হাজার অবৈধ সিএনজির নিয়ন্ত্রকও রুমেল সিন্ডিকেট। প্রতিটি সিএনজি মাসে ১ হাজার টাকা দিয়ে চলে কোনো কাগজ ছাড়াই। এ ১ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি কার্ড ইস্যু করা হয়, যা দিয়ে এক মাস চলতে পারে। এর বাইরে যেসব বৈধ সিএনজি রয়েছে, তাদেরও মাসে আড়াইশ টাকা দিয়ে কার্ড কিনতে হয়। ২০১৮ সালে মৌলভীবাজারে ভয়াবহ বন্যা হয়। সে বন্যার পর নানা উন্নয়নকাজে বেশ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এ প্রকল্প গ্রহণ করতেই পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলীকে সরিয়ে অন্য একজনকে নিয়ে আসেন নেছার আহমদ। সেই কর্মকর্তা নিজেকে নেছার আহমদের আত্মীয় পরিচয় দিতেন। বেশ কয়েকটি দুর্নীতির ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা এলে পরবর্তী সময়ে তাকে বদলি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার মাধ্যমে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কতটুকু কাজ পাবেন, তা নির্ধারণ করেন এমপি নেছার আহমদ। ভুক্তভোগীরা বলছেন, মৌলভীবাজার সদরে ১২টি ইউনিয়নে এমপি ঘনিষ্ঠ মাত্র চারজন চেয়ারম্যান। বাকিদের মধ্যে পাঁচজন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী এবং তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন। ফলে এমপির বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা নিজ এলাকায় তেমন উন্নয়নকাজ করতে পারছেন না। ভুক্তভোগী একজন ইউপি সদস্য বলেন, রাজনগর উপজেলায় তিন বছর আগে প্রতিটি ইউনিয়নে ৩০টি টিউবওয়েলের কাজ নেন এমপির ব্যক্তিগত সহকারী ইমরান আহমেদ শাওন। তিনি কামরুজ্জামন নামে একজনের লাইসেন্স ব্যবহার করেন। তিনবার মেয়াদ বাড়ানোর পরও নলকূপ স্থাপনের কাজ শেষ করেননি তারা। এমপির আত্মীয়স্বজনরা এখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক মুনজর আহমেদ চৌধুরীর জমি দখলে নিয়েছেন এমপির ভাগ্নে শফি মিয়া। ভুক্তভোগীরা নালিশ জানালেও এমপি বিষয়টির সুরাহা করেননি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য নেছার আহমদ কালবেলার কাছে সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, মৌলভীবাজারে সবাই সবার মতো রাজনীতি করতে পারছেন। কাউকে বাধা দেওয়া হয় না। সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অবান্তর অভিযোগ আনা হচ্ছে বলে তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন। হঠাৎ এত সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়ে এমপি কথা বলতে চাননি। মৌলভীবাজারের নিরপেক্ষ যারা আছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে নেছার আহমদ বলেন, যারা আমাকে পছন্দ করেন না, তারা নানা কথা বলতে পারেন। যারা নিরপেক্ষ, তারা জানেন আমি কেমন মানুষ। তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, আমি অবৈধ অর্থ আয়ের পথে জড়াইনি।