শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:১৪ পূর্বাহ্ন
নূরুল হক এমন এক মহৎ ব্যক্তি-যিনি এক যুগান্তকারী অবদান রেখে গেছেন, তাঁর জীবদ্দশায় আমাদের সাহিত্য সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। আজকে তার মৃত্যু দিবসে তাঁকে স্মরণ না করলে তা হবে অকৃতজ্ঞতার নামান্তর।
আমি ছিলাম সাহিত্যিক নূরুল হকের আপনজন। অতি আদরের একজন। আমি ছিলাম তাঁর প্রিয়পাত্র। সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জগতে আমার প্রবেশ বলতে গেলে তাঁর হাত ধরেই। আমি তাঁর কাছে ঋণী। কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁকে স্মরণ করতে হয়। মনের তাড়নায় তাঁর সমন্ধে দু’টি কথা লিখতে হাতে কলম নিয়েছি। তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ-ভালবাসা আর আদরের কথা আমি কি ভুলতে পারি? মোটেই না। আমাদের জীবন যখন শুরু তাঁর জীবনের তখন প্রায় শেষ পর্যায়। কিন্তু তারপর এ সময়ের মধ্যে তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন অনেক কিছু। যার জন্য তাঁকে ভুলতে পারি না, ক্ষণে ক্ষণে তাঁর কথা মনে পড়ে। শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করতে হয়। তাঁর মোলায়েম ভাষার কথাগুলোকে আজও যেন সেদিনের কথা বলে মনে পড়ে। একজন দক্ষ কলম সৈনিক, সাহিত্যিক হিসাবে মরহুম নূরুল হক অর্ধ শতাব্দীর বেশি
সময় ধরে জাতির খেদমত করে গেছেন। সহজ সরল মন নিয়ে একজন সাধারণ মানুষের মত জাতির জন্য কাজ করেছেন-সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ। ন্যায় ও নীতিতে তিনি ছিলেন একজন আপোষহীন যোদ্ধা, তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তা প্রকাশ করে গেছেন। আল ইসলাহ্ধসঢ়; আর কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রতি তাঁর যে নাড়ির টান ছিল তা সকল নবীন ও প্রবীণেরা আজো এক বাক্যে স্বীকার করেন। এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি অগণিত মানুষের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্য-তাঁকে চিনতে পারলেও তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি তাঁর জীবদ্দশায়। তাঁর কন্ঠ আজও ভুলিনি, মনে পড়ে বার বার কারণ আমি ছিলাম তাঁর পাশে। অবসরে তাঁর পাশে বসতাম, তিনিও আসতেন সময় পেলে আমার বাসায়। মরহুম নূরুল হকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল ছাত্র শিক্ষকের মতো। কিন্তু
সাদাসিধে চালচলন ছিল বলে তাঁর সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শাহজালালের দরগার সামনে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও আল ইসলহ্ধেসঢ়;র কথা মনে পড়লেই নূরুল হকের কথা মনে পড়ে। তিনি যে একজন বলিষ্ঠ চরিত্রের
অধিকারী, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি সেবক ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। মুসলিম সাহিত্য সংসদ আর আল ইসলাহ প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন এসবের জন্য নিবেদিত প্রাণ।
সত্যি আজকের অবক্ষয়ের এ যুগে আমরা নূরুল হকের মত ব্যক্তিত্বের বড়ই অভাব অনুভব করছি। সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলেও তার চিন্তা ও চেতনা ছিল উন্নত ধরণের। সৎ চিন্তা, সৎ জ্ঞান ও সৎ ধারণা ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যান। সত্য চির সুন্দর চির উজ্জ্বল। এ চিরন্তন সত্যকে তিনি প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ নামের এক নির্ভেজাল প্রতিষ্ঠানে রাতদিন নিরলস কাজ করে। তিনি যে স্মৃতি রেখে গেছেন তা ভোলা যায় না। সে স্মৃতি মানুষকে কাঁদায় না-হাসায়। আজ কাগজের পাতা জুড়ে তাঁর মহৎ গুণাবলীর সমাবেশ ঘটছে কিন্তু তিনি বেঁচে থাকাকালে এরকম প্রকাশ পেলে তা হয়ত তাঁর জন্য সুখের হতো।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অনেকে বড় লোকের দাবী নিয়ে সুন্দর বাড়ি, গাড়ি ও লেবাস নিয়ে বড়াই করেন কিন্তু তা দিয়ে কি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা যায়? তাকে খুশী করা বড়ই কঠিন কাজ। আজ পর্যন্ত কেউ এ নজির দেখাতে
পারেননি যে, বড়লোক হয়ে সৃষ্টিকর্তার নিকট আলাদা লেবাস বা মর্যাদা নিয়ে দুনিয়া থেকে যেতে পেরেছেন। সবারই যাবার পথের একমাত্র সম্বল এক শুধু সাদা কাপড় আর সাড়ে তিন হাত মাটি-দুই বা আড়াই ফুট যার গভীরতা। পাশের বাড়ির গরিব ছেলে সুমন আর রাজ পরিবারের ছেলে রহিম-রাজা, মৃত্যুর পর সকলের স্থান একই জায়গায়। তাহলে গর্ব আর অহংকার করে লাভ কি? মরহুম নূরুল হক আজীবন সাহিত্যের সেবা করে গেছেন। তাঁর হাতে অনেকেই সাংবাদিক হয়েছেন, সাহিত্যিক হয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনদিন প্রকাশ করেননি। বিত্তের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লোভ কোনদিন ছিল না। মোটা কাপড় আর মোটা ভাতেই তিনি ছিলেন সন্তুষ্ট। যতদূর জানি তাঁর গৃহিনীর সাথে এমনভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যে, ওখান হতেও তাঁর উপর কোন চাপ আসেনি। চিত্তের প্রসারতা তারাও চেয়েছিলেন। এটা ছিল তাদের বেঁচে থাকার অহংকার। তাই তাঁর মৃত্যুদিনে আমাদের সান্ত¡না-তিনি ছিলেন আমাদের অহংকার আমাদের গৌরব।
“তোমার কীর্তির চেয়ে
তুমি যে মহৎ
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায়
কীর্তিরে তোমার। ”
মরহুম কৃতী পুরুষ নূরুল হক আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কোনদিন আর আসবেনও না। আমার দুর্ভাগ্য তাঁর জানাযায় আমি থাকতে পারিনি-ছিলাম লন্ডনে। ওখান থেকে খবর পেয়ে দু’ফোটা চোখের পানিই ফেলেছি আর তাঁর
জান্নাত কামনা করেছি মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে। তিনি তো কবুলের মালিক। আমরা নূরুল হকের উত্তরসূরী। তাঁর মহান আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশদরদের কাছে নূরুল হকের মতো একটি মহৎ ও আদর্শ চরিত্রকে তুলে ধরার প্রয়োজন আছে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই।
আজ কৃতী পুরুষ নূরুল হকের মৃত্যুদিবসে আমার প্রস্তাব দরগাহ- আম্বরখানা-সুনামগঞ্জ সড়কে যে রাস্তাটি এসে সংযুক্ত হয়েছে, তার নাম হোক ‘নূরুল হক সড়ক’। আর তার প্রাণপ্রিয় আল ইসলাহ্ধসঢ়; প্রকাশের ব্যবস্থা করা হোক
নিয়মিতভাবে যা নিয়ে ইতিমধ্যেই আলাপ আলোচনা হয়েছে বহুল। আমি জানিনা আমার এ প্রস্তাবে সংশ্লিষ্টরা এগিয়ে আসবেন কি না? কিন্তু এজন্য এগিয়ে আসা উচিত। কারণ অতীত হয়ে যাওয়া গুণীজনদের আমরা ভুলে গেলে ভবিষ্যৎ
বংশধরেরাও আমাদের স্মরণ করবে না-ঠিক একইভাবে ভুলে যাবে চলতে থাকবেও। ইতিহাস রচিত হবে না, আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে-এটাই নিয়ম। এ নিয়ম চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
সাংবাদিক-কলামিস্ট।