অনলাইন ডেস্ক: রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়েন ফাহিম জুবায়ের (আসল নাম নয়)। বাবা-মা চাকরি করেন আলাদা দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাবা-মার কাছে টাকা চেয়ে না পাওয়ার হতাশা থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং শিখেন ফাহিম, এরপর ইন্টারনেটের মাধ্যমে আয়ও শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ছেলের আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখতে পান বাবা। ‘হঠাৎ মোবাইল ফোন বন্ধ! দু’তিন দিন খোঁজ নেই। ফিরে আসলে প্রশ্ন করলে চুপ করে থাকে। আমরা চিন্তায় পড়ে যাই। হঠাৎ একদিন রাতে বাসায় পুলিশ আসে। জানতে পারি আমাদের ছেলে একটি জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে গেছে।’ বলছিলেন ফাহিমের বাবা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা ও পারিবারিক সচেতনতায় ফাহিম প্রায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। এভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জঙ্গিদের রিক্রুটমেন্টের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। অনেক তরুণ ও যুবকের হতাশা ও আর্থিক দুর্বলতাকে পুঁজি করছে তথ্যপ্রযুক্তি প্লাটফরমগুলোতে ওঁত পেতে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলো।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম চলমান আছে। অনলাইনে সক্রিয় জঙ্গি কার্যক্রম কিভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে কাজ চলছে। কিছু জঙ্গি সংগঠন মাঝে মধ্যে কিছু ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলেও সরকারের ইন্টেলিজেন্স এবং নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতায় সেগুলো সফল হচ্ছে না। এন্টি টেররিজম ইউনিট দুই বছরে গ্রেপ্তার করেছে জঙ্গি দলের ১১৯ সদস্য। গত পাঁচ বছরে ৫২টি অভিযানে ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব। তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, জঙ্গি সংগঠনগুলোর দৃশ্যমান তৎপরতা বন্ধ। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সদস্য সংগ্রহ তৎপরতা মারাত্মক আকারে বেড়েছে। নামে-বেনামে অসত্য তথ্য দিয়ে তারা আইডি খুলছে। ফলে তাদের শনাক্ত করতেও সমস্যা হচ্ছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, জঙ্গিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আড়ালেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় আইডি খুলতে যারা মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করে না তাদের শনাক্ত করা কঠিন। এমনকি যারা বিদেশ থেকে এসব কার্যক্রম করছে তাদের ঠেকানো কঠিন। তবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষ থেকে সবসময় সহায়তা মিলে না বলেও জানান তিনি।২০০১ সালের পর বেশ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেসময় সারাদেশে একযোগে ৫০০ জায়গায় জঙ্গি হামলায় আঁতকে ওঠে দেশবাসী। নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সিলেটে এক অপারেশনে টুঁটি চেপে ধরা হয় জঙ্গিদের। এরপর টানা নয় বছর নতুন রূপে সংগঠিত হয় তারা, ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়। হত্যা করা হয় দেশি-বিদেশি ২০ জন নাগরিককে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব:) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা ২০১৬ সালের পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু জঙ্গিদের সাইবার নেটওয়ার্ক অবাধ; এমনকি ফিজিক্যাল নেটওয়ার্ক ভাবিয়ে তোলার মতো। তাদের আর্থিক ফিজিক্যাল নেটওয়ার্কে আঘাত হানা যায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাজে লাগিয়ে যেভাবে তারা সংগঠিত হচ্ছে আমাদের শঙ্কা তারা সুযোগ পেলেই বড় ধরনের অঘটন ঘটাতে পারে।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রপের ডেপুটি কমিশনার আব্দুল মান্নান বিপিএম বলেন, সশস্ত্র জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আমরা এখনো জঙ্গিবাদকে রুটআউট করতে পারিনি। এর অন্যতম কারণ হলো অনলাইনে গা ভাসিয়ে কিছু তরুণ জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ বলে শিক্ষার্থীরা অনলাইন প্লাটফর্মে বেশি ব্যস্ত। এই সুযোগে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টারমাইন্ড টেরোরিস্টরা অনলাইনে নানা প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। এ কারণেই অনলাইনে রিক্রুটমেন্টের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তবে আশার কথা শুনিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ’গেল পাঁচ বছরে বিশটি হাই-রিস্ক অপারেশনে নিহত হয়েছে ৬৩ জন জঙ্গি। শীর্ষস্থানীয় জঙ্গীরা অভিযানে নিহত হয়েছে, না হয় গ্রেপ্তার আছে। এই মুহূর্তে তাদের বড় কোনো হামলা করার সক্ষমতা আছে বলে আমরা মনে করি না’। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত মনিরুজ্জামান বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বেশ স্তিমিত হয়ে এসেছে এটা সত্য। এর অর্থ এই নয় যে জঙ্গিবাদ বাংলাদেশ থেকে নির্মূল করা গেছে। নানা প্রেক্ষাপটে জঙ্গিবাদকে পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কৌশলী ভূমিকায় থাকতে হবে। বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতির কারণে বায়োটেররিজমের আশঙ্কা আছে। এ বিষয়ে নতুন করে সজাগ থাকা প্রয়োজন।
এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার (মিডিয়া শাখা) মোহাম্মাদ আসলাম খান বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত এক থেকে দেড়শ লোককে গ্রেপ্তার করেছি যারা অনলাইনে জঙ্গি দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। স্যোসাল মিডিয়াকে আমরা মনিটরিং করছি। প্লাটফর্মটা অনেক বড় হওয়ায় কিছু প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসে এসব তৎপরতা চালানো হচ্ছে। তাদেরকে রিচ করা অনেকটা জটিল। তবে দেশে বসে যারা এ ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের অনেককে আমরা ধরেছি’।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিসিএ) সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বলেন, সরকারিভাবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লােগানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শহর থেকে গ্রামে যেভাবে বেড়েছে সেভাবে উল্লেখযোগ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই। অনলাইনে অপরিচিত মানুষকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে। বাবা-মায়েরও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবে সন্তানের সঙ্গে। শেয়ারিং এর সুযোগ না থাকায়ও সে অন্য কাউকে বেছে নিচ্ছে বন্ধু হিসেবে। এভাবে অনেক তরুণ ও যুবক অজান্তে উগ্রবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
এ জাতীয় আরো খবর..