শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ০৮:৫৩ অপরাহ্ন
: আফতাব চৌধুরী :
পিতৃ-আজ্ঞা পালনের জন্য রামচন্দ্রের বনবাস যাত্রার পর তাঁর পিতা অযোধ্যার রাজা দশরথ ‘হায় রাম, হায় রাম’ বিলাপ করে করে প্রাণত্যাগ করেছিলেন। আজ সে রামও নেই সে অযোধ্যাও নেই। কিন্তু হায় হায় নামক হাহাকারটি দিব্যি বেঁচে আছে। যত দিন যাচ্ছে ততই তার ব্যাপ্তিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে এটির এখন বাড়বাড়ন্ত। এ দেশে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পানীয় জল-সব কিছুর জন্যই এ হায় হায় রব। এ হায় হায় করে প্রাণ ত্যাগ হচ্ছে না সত্যি, কিন্তু প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে আছে। জীবন্ত কই কাটার পরও তার ছটফটানি থাকে। মাছের বেঁচে থাকার আকুতির সঙ্গে আমাদের অবস্থাও প্রায় এক। আধুনিক সভ্যতার উপকরণগুলো, যেমন- বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, পানীয় জল, শিক্ষা ইত্যাদি সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ গুলোর মধ্যে বর্তমান যুগে বিদ্যুতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক চবিক্ষশ ঘন্টার, বিশেষত শহরবাসীদের। বিদ্যুৎ না থাকলে দৈনন্দিন জীবন অচল হয়ে পড়ে-জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এর প্রয়োজন। হাসপাতালে প্রস–তিগারে মাতৃজঠর থেকে যখন ডাক্তাররা একটি শিশুকে নিষ্ক্রান্ত করে পৃথিবীর আলো দেখান তখনও বিদ্যুতের হাজির থাকা জরুরি। তাই বিদ্যুৎ সর্বঘটে প্রয়োজন।
আমাদের দেশে এ চব্বিশ ঘন্টার সঙ্গীর বিরহ কাতরতা খুব বেশি। কারণ অনুসন্ধান করলে একটা কথাই শোনা যায়-দেশে নিজস^ বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রয়োজনের তুলনায় কম। যেসব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে তা থেকে নাকি চাহিদা মত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়না কারণ উৎপাদন কম। আবার বিদ্যুৎ বিভাগের কোন কোন কর্মকর্তার বক্তব্য বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করলেও পরিবাহী লাইনগুলো ধারণ করতে পারে না। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বিদ্যুৎ বিভাগের এ বয়ান সবাংশে সত্য নয়। দুর্জনেরা অবশ্য বলে, বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে বলে দোষ দিয়ে স্থানীয়ভাবে বিদ্যুতের কালোবাজারি হয়। পর্ষদের চেয়ারম্যানও এ অপচয়ের কথা স^ীকার করেছেন বলে প্রকাশ। এটা কি দায়ীত্বহীনতা না ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের অভিপ্রায়?
বিদ্যুৎহীনতার যন্ত্রণা সীমাবদ্ধ থাকে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে। ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, হোটেল মালিক, নার্সিংহোমের মালিক, নেতা-মন্ত্রীদের বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে কোনও ক্ষতি হয় না, কারণ ওদের আছে ছোট, মাঝারি ও বড় মাপের জেনারেটর, আইপিএস ইত্যাদি। এ দিয়ে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ব্যবসার মুনাফাও লোটেন আর ঘরকেও রাখেন বাতানুক‚ল। সাধারণের অনুযোগ জানানোর জায়গা নেই, হামেশা মিথ্যা প্রতিশ্রæতি ও মিথ্যা তথ্য ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না কুর্সিতে আসীন জনগণের ভাগ্য-বিধাতাদের কাছ থেকে। বিদ্যুৎ বিভাগের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কিছুদিন পূর্বে জাতীয় সংসদে ঘোষণা করলেন যে আরো ক’বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, নতুন নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন হলে পরিস্থিতি উন্নতি ঘটবে। সংবাদে প্রকাশ, আমাদের সামনে আরেকটা ললিপপ ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে- বলা হচ্ছে ছোট ছোট বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপিত হলে বিদ্যুৎ সংকট দূর হবে। এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের মাননীয় মন্ত্রী এবং দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন জনসভায় নির্বাচন পূর্বে বলেছিলেন তারা নির্বাচিত হলে দেশের বিদ্যুৎ সংকট দূর করবেন। আবার বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রীও একই বক্তব্য জনস¤মুখে উপস্থাপন করেছিলেন। এখানে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন এত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তারা এতদিন পর্যন্ত সমাধান করলেন না কেন? এটাও একপ্রকার রাজনীতি। তাল গাছের গল্প সবারই জানা- তাল গাছ যে রোপণ করে তার পৌত্ররা পেতেও পারে, তবে প্রপৌত্ররা তার সুমিষ্ট ফল পান। জাতীয় প্রকল্প যখন হয়েছে, আমাদের প্রপৌত্ররা এর ফল নিশ্চয়ই পাবে। তৎসঙ্গে গাছটাকে রক্ষণাবেক্ষণের অজুহাত তিন পুরুষের জন্য গদিটাকেও পাকা করে নেওয়া যাবে।
‘… দেওয়ার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই’। প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ আমাদের বিদ্যুৎ বিভাগ জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করেই হঠাৎ বিদ্যুৎ মাশুল বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন কারণ বিদ্যুৎ পর্ষদ নাকি লোকসানে চলছে। এ লোকসানের দায়িত্ব কার-পর্ষদের না গ্রাহকদের? অবশ্যই পর্ষদের। ওদের ব্যর্থতার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রাহকদের ওপর। এটা অনৈতিক ও অনুচিত। পর্ষদ যদি তার পরিকাঠামোর উন্নতি না ঘটিয়ে লোকসান ঘটিয়ে দায়ভার চাপিয়ে দেয় গ্রাহকদের ওপর এবং তা আদায়ের প্রক্রিয়া চালাতে থাকে তা হলে জনরোষ সামলানো কঠিন হবে। গ্রাহক আমরা যারা আছি তাদের ঘুমন্ত বললেও ঠিক বলা হবে না-প্রত্যেকেই এক একটা শব- শবের পাঁচ মণের যায়গায় সাত মণ ওজন চাপিয়ে দিলেও শবের কোনও আপত্তি থাকে না। আমরাও সেরূপ হয়ে যে যা করছে তা মেনে নিচ্ছি। উপরের ওজন ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। বর্ধিত হারে মাশুল না দেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে হবে। ফিক্সড চার্জ নামে একটা মাসিক মাশুল গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করে বিদ্যুৎ বিভাগ যেটি গাণিতিক নিয়ম অনুসারে এক মাস মানে সাতশ বিশ ঘন্টার সমাহার। এ সাতশ বিশ ঘন্টার যায়গায় অর্ধেক সময়েরও বেশি সময় বিদ্যুৎ পরিসেবা না দিয়ে পুরো মাসের মাশুল নেওয়াটা অনৈতিক। ঘন্টার হিসেবে পরিষেবা দেওয়া অনুযায়ী বিল দেওয়া উচিত বিদ্যুৎ বিভাগের। এটা বাধ্য করতে পারলে বেশি সময় পরিসেবা দেওয়ার একটা প্রবণতা আসতে পারে এবং গ্রাহকরাও একটু রেহাই পাবেন। গ্রাহকদের এ দাবি করাটা ন্যয় সঙ্গত।
বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সঙ্গে আরেকটা বিষয় অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত- তা হল পরিবেশ দূষণ। বিদ্যুৎহীনতার সময় সাধারণ পথচারীরা হোঁচট খেতে খেতে বাজার অঞ্চলে গিয়ে পান বিষাক্ত পরিবেশ। জেনারেটরের শব্দ এবং এর থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া পরিবেশকে এত দূষিত করে যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং শ্রবণেন্দ্রিয় প্রায় বধির হয়ে যায়। এ বিষাক্ত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে যে মানুষগুলো তিলে তিলে মরছে তার খবর রাখার কেউ নেই মনে হয়। শহর গুলোতে পরিবেশ দূষণের একটা কার্যালয় আছে, যার কাজ হল পরিবেশ দূষণ রোধ করা, কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ বিভাগটির কর্তাব্যক্তিরা এটি দেখেও দেখেন না, শুনেও শোনেন না। মনে হয়, পলিথিন ব্যবহার রোধ করাই তাদের একমাত্র কাজ ছিল কিন্তু তাতেওতো তারা ব্যর্থ হয়েছেন। এখানেও বিড়ম্বনা-কারণ বাজার এখন পলিথিন ব্যাগে সয়লাব। ভাবখানা যেন পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করেই এ অঞ্চলের পরিবেশ নির্মল করে দিয়েছেন তারা। আমরা কি প্রশ্ন করতে পারি না যে শব্দ দূষণ, বায়ুদূষণ কি পলিথিন থেকে কম ক্ষতিকর? জেনারেটর নিঃসৃত ধোঁয়া এবং এর শব্দ কি পরিবেশকে ভারসাম্যহীন করে না? এ বিভাগে বলিষ্ঠ বাস্তুকারা আছেন, তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, লোডশেডিংকালে তিনি শহরে কোনও ব্যস্ততম অঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকুন, তা হলে অনুমান করতে পারবেন কতটুকু দূষণ ধারণ করে বেঁচে আছেন সাধারণ মানুষ। একমাত্র হাসপাতাল ছাড়া যদি জেনারেটর ব্যবহার বন্ধ করা যায় তা হলে দূষণটা বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং এ ধনিক শ্রেণীর লোক, নেতা, মন্ত্রী, ব্যবসায়ীরা বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের যন্ত্রণা ভোগ করে বুঝতে পারবেন আমরা কী যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। এটি বন্ধ করতে যদি অনীহা থাকে তবে জেনে রাখবেন, লক্ষ লোকের ফুসফুস ও কানের রোগের জন্য দায়ী হবে এ প্রদূষণ বিভাগ।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতি অনুরোধ, আপনারা অপারগ হলে আমদের জানিয়ে দিন, তা হলে আমরা অন্য রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করব। বৃহৎ বৃহৎ আত্মসহায়ক সংস্থা আছে। আমার বিশ্বাস, ওরা আমাদের বিকল্পের সন্ধান দিতে পারবে। একই বিষয় নিয়ে বারবার চর্বিত চর্বণ করায় পাঠকদের হয় তো বা ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। কিন্তু আমরা আপনাদের বন্ধ অর্গলে কড়া নাড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাব। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ জননেতারা সংবর্ধনা নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কেউ হাজার গাড়ি শত তোরণের শোভাযাত্রা করে সোনার মুকুট পরছেন। কেউ কেউ আবার লন্ডন, নিউইয়র্কের চিন্তায় আছেন। তাই জনতাকেই শেষ কথা বলতে হবে। সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।