শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪৬ পূর্বাহ্ন
বিনোদন ডেস্ক:অভিনয়ের কিংবদন্তি বলা হয় তাকে। অনেক জুনিয়র অভিনেতার কাছে তিনি গুরু। প্রয়াত এই অভিনেতার নাম হুমায়ূন ফরীদি। সব ধরনের চরিত্রে স্বাচ্ছন্দ্যে মানিয়ে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন গুণী এই অভিনেতা। ছিলেন আবৃত্তিকারও। ভাষা আন্দোলনের বছরে ২৯ মে গাজীপুরে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন ফরীদি। বাবার নাম এটিএম নুরুল ইসলাম, মায়ের নাম বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে ফরীদি ছিলেন দ্বিতীয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে যান। আশির দশকের দিকে তার চলচ্চিত্রে আগমন। তবে তার আগে মঞ্চ ও টেলিভিশনে অভিনয়ের মাধ্যমে নিজের আসন পাকাপোক্ত করেন এই জাঁদরেল অভিনেতা। অভিনয় করেছেন অসংখ্য নাটক ও চলচ্চিত্রে। পর্দায় তার উপস্থিতি মানে দর্শকদের বুঁদ হয়ে থাকার ক্ষণ শুরু। অভিনয়ের কারণেই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার পর ২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান তিনি।
তবে অভিনয়ের বাইরেও প্রতিবছর তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করেন সহকর্মী ও ভক্তরা। নানা স্মৃতিকথার বাইরেও হুমায়ূন ফরীদির নানা উক্তির মাধ্যমে তৈরি মিম ও কার্ডে সয়লাব হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় হুমায়ূন ফরীদির বলা, ‘উঠে দাঁড়াতে একটা হাত লাগে, আর ঘুরে দাঁড়াতে আঘাত’।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন কিংবদন্তি অভিনেতা ছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। খল চরিত্রে অভিনয় করেও যে সুপারস্টার হওয়া যায়, লাখ লাখ দর্শকের মনে জায়গা করে নেয়া যায়, সেটি তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। ভিলেন চরিত্রটিকে ভিন্ন এক মাত্রা দিয়েছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। রুপালি পর্দায় কখনো তাকে দেখে ভয় লাগতো, কখনো হাসি পেত, কখনো আবার মায়া লাগতো।
আজ যদি অভিনেতা বেঁচে থাকতেন, ঘটা করে হয়তো তার ৭১তম জন্মদিনের উৎসব পালন করা হতো। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন হাজারো ভক্ত তাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়, কেউবা ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতেন। সহকর্মীরা যেতেন বাসায় কেক নিয়ে। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, বাংলা চলচ্চিত্র আরও সমৃদ্ধ হতো তার অভিনয়শৈলীতে। এমন আরও অনেক কিছুই হতে পারতো।
কিন্তু তিনি বেঁচে নেই। অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদির আরও একটি বড় পরিচয়, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ফরীদি ১৯৭০ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেন চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সশরীরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ফের শিক্ষাজীবন শুরু করেন।
হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় প্রতিভার বিকাশ ঘটে এই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই। নাট্যগুরু সেলিম আল দীনের কাছে নাট্যতত্ত্বে দীক্ষা নেন। যুক্ত হন ঢাকা থিয়েটারে। সহজাত অভিনয়-গুণে আদায় করে নেন দর্শকের ভালোবাসা। আশি ও নব্বইয়ের দশকে যে কজন অভিনয়শিল্পী মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র- এই তিন মাধ্যমেই তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন, তাদের মধ্যে হুমায়ুন ফরীদি অন্যতম।
এই গুণী অভিনেতা কাটিয়েছেন দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য অভিনয়জীবন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘নীল নকশার সন্ধ্যায়’ ও ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’ নাটকে অভিনয় করে হুমায়ুন ফরীদি তাক লাগিয়ে দেন। তার অভিনীত ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’ আজও দর্শকের স্মৃতির পাতায় ভাস্বর। সেখানে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি।
বহুমাত্রিক এই অভিনেতা ১৯৮৪ সালে অভিনয় শুরু করেন চলচ্চিত্রে। এখানেও সাফল্যের দেখা পান। খুব কম সময়ে দখল করেন শ্রেষ্ঠ খল-অভিনেতার স্থান। বাংলা চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে তিনি যোগ করেন নতুন মাত্রা। ২০০৪ সালে ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য পান সেরা অভিনেতা শাখায় ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’। যদিও সেই সম্মাননা তিনি নিজ হাতে নিতে পারেননি।
ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ূন ফরীদি দুটি বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রীর নাম মিনু। ১৯৮০ সালে তাদের বিয়ে হয়েছিল। সেই সংসারে শারারাত ইসলাম দেবযানী নামে এক মেয়ে রয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় ফরীদির। ওই বছরই তিনি খ্যাতিমান অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফাকে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালে ভাঙে সেই সংসারও। তবে ২৪ বছর একসঙ্গে থাকলেও এ সংসারে অভিনেতার কোনো সন্তান নেই।
২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ফাল্গুনের প্রথম দিনে অসংখ্য ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন হুমায়ূন ফরীদি। এর আগে তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। তাকে ভর্তি করা হয়েছিল রাজধানীর মডার্ন হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে বাসায়ও ফিরেছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান হুমায়ূন ফরীদি। সেই আঘাতেই উড়ে যায় প্রাণপাখি।