মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ১১:৩৩ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী :: জীবনকে জীবন্ত করে রাখতে, সমাজ-সংসারকে সতেজ করে তুলতে যৌবনের অবদান অনস^ীকার্য। এ মানব জীবনে যৌবন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়। বিশ্ব কবি তারুণ্যকে প্রকাশ করেছেন যৌবনের দূত হিসাবে। উচ্ছ¦ল-উচ্ছ¦াস, দূরন্ত, চাঞ্চল্য, অনন্ত উদ্দাম, অস্থির উš§াদনা, সাফল্যের স্নিগ্ধতা, ব্যর্থতার গøানি, প্রেম-বিরহ, পূর্ব রাগ-অনুরাগ, আনন্দ-বেদনা, সৃষ্টিশীল কাজ, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির উৎকর্ষতার মাঝে জীবনকে মেলে ধরার পূর্ণ আলোকজ্যোতিকায় প্রকাশ করার মাহেন্দ্রক্ষণ হলো যৌবন।
কবি বলেছেন, যৌবন যতো আকর্ষনীয় কিংবা রোমাঞ্চকর হোক না কেন তা কিন্তু ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক। শারীরিক এবং মানসিক উভয়ক্ষেত্রে এর ছাপ লক্ষণীয়। এ যেন ভরা জোয়ারের বিক্ষুব্ধ নদীর খল খল, ছল-ছলাৎ অবস্থা। তরঙ্গ ভঙ্গে, জল উপচে পড়ছে, ক‚ল ভাঙ্গছে, পলি গড়ছে আর কোথাওবা সৃষ্টি হচ্ছে ঘুর্ণিপাক, যৌবনের এ হচ্ছে এক আকর্ষণীয় উপমা।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন “যৌবন জল তরঙ্গ ……..”। মানুষের জীবনে যখন যৌবন আসে তখন যেন ভরা নদীর বুকে তরঙ্গ-দোলায়িত ছন্দের সুর তোলে সে সুর কখনও বা মধুর কখনও বা বেদনার সুর।” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “যৌবন বেদনা রস ……..”।
ফুল ফোটার আগে কুড়ি
যেমন বিকাশের বেদনায়,
মেলে ধরার তীব্র আবেগে, সৌরভ ছড়াবার দুর্দান্ত বাসনায় থরোথরো কম্পমান হয়ে উঠে, তেমনি জীব জগতে সর্বভ‚তে সর্বপ্রাণীতে বিশেষতঃ মানব মানবীর মধ্যে যৌবনে এ লক্ষণ দেখা যায়। এর অন্য নাম যৌবন যন্ত্রণা।শত যন্ত্রণা জর্জরিত হওয়া সত্তে¡ও যৌবন যে জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট স্বর্ণালী সময় তা সর্বতভাবে স্বীকার্য সত্য। এ জন্য যৌবনের জয় গানে সমগ্র ভুবন মুখরিত। যৌবনকে ধরে রাখার অ¤øান করে তোলার জন্য প্রয়াসের অন্ত নেই।বর্তমান বিশ্বে এ পর্যন্ত মহৎ কাজ স¤পন্ন হয়েছে তার অধিকাংশ কৃতিত্ব হচ্ছে যৌবন শক্তির। স্মরণীয় বরণীয় সে সব মহাপুরুষের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তার সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জিত সাফল্য যৌবনেই এসেছে।
গৌতম বুদ্ধ দুঃখ মুক্তির উপায় অন্বেষণে রাজ্যপাট প্রিয়া পরিজন ত্যাগ করে ছ’বছর কঠোর সাধনা শেষে বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন ৩৫ বছর বয়সে, যৌবনের সুবর্ণ অধ্যায়ে। তেমনিভাবে হযরত মোহাম্মদ (স.), যীশুখৃষ্ট, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ যুগস্রষ্টা ধর্ম প্রবর্তকদের জীবনেও এ সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। তাঁরা সবাই যৌবনে জগত সংসারকে কিছু দেওয়ার, দুঃখ জয়ের সাধনায় নিজেকে সমর্পনের মাধ্যমে সিদ্ধিলাভে সক্ষম হয়েছিলেন। যৌবনের অমিত শক্তিকে তাঁরা সুষ্ঠুভাবে শাসনে রেখে সাধনা করেছিলেন বলে এ কালজয়ী সাফল্য কৃতিত্ব এসেছিল।
আমাদের বাংলা সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জসিম উদ্দিন, সুফিয়া কামাল, শামসুর রহমান প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের সৃষ্টি সম্ভারের শ্রেষ্ঠ ফসল যৌবন জীবনে এসেছে।
রবীন্দ্র সাহিত্যের মহত্তম লেখাগুলো রচিত হয়েছিল তাঁর যৌবনকালে। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে নজরুল বাকশক্তি হারিয়ে ছিলেন কিন্তু তাঁর স¤পূর্ণ সৃজনশীল সৃষ্টিকাল ভরা যৌবনে। ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ৪২ বছর আর সুকান্ত ভট্টাচার্য ২২ বছর বয়সে মারা যান। সুতরাং তাঁদের যৌবনকালে রচিত সাহিত্য, সমৃদ্ধ করেছে আমাদের বাংলা সাহিত্যকে। যৌবনকে নিয়ে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ভাবনা-চিন্তার অন্ত নেই বরং তা এখন দেশে দেশে নিয়ত অব্যাহত রয়েছে। যৌবনের স্থিতিকাল বিশ থেকে চল্লিশ এ দুই দশক হলে মনের দিক থেকে উদ্দীপ্ত থাকলে এ পরিধি আরো বাড়ানো যায় তবে এটা মানুষভেদে সম্ভব। তাইতো অমিতভোজী যৌবনের জয়গানে কবিরা, মুখর হয়েছে সব সময়। ওরে সবুজ, ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।”মিথ্যা-পঁচা, কুসংস্কার, গোঁড়ামী, ধর্মান্ধতা ক‚পমন্ডুকতার বিরুদ্ধে যুবশক্তি সর্বকালে সোচ্চার থেকেছে। অচলায়তনের নাগপাশ ছিন্ন করে “অরুণ প্রাতের তরুণ দল” সব সময় সম্মুখপানে এগিয়ে গেছে। সামাজিক বিভেদ বৈষম্য উঁচু-নীচু জাতক‚ল, অসাম্যের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে মিথ্যা ভন্ডামীর বিরুদ্ধে জাগ্রত থেকেছে যুবশক্তি।
মানবতার জয় গানে মুখরিত যুবসমাজ চিরদিন চায় মুক্তবিহঙ্গের মতো ডানা মেলে আকাশে উড়তে। তাদের কাছে হিমালয়ের সুউচ্চ তুষার শৃঙ্ঘ কিংবা আফ্রিকার গহিন জঙ্গল কোন দুর্গম বা শাপদসংক‚ল নয়। সংসপ্তক মন নিয়ে তারা এগিয়ে চলে-জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে তারুণ্যের শক্তি দুর্ণিবার-দর্বিনিত-দুর্বার।
সকল প্রকার সংকীর্ণতা, জীর্ণতা, আবিলতা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে যৌবন শক্তি বিভিন্ন সময়ে সংগ্রামী ভ‚মিকা পালন করেছে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলাদেশের স^াধীনতা সংগ্রাম।
দু’শো বছরের নিঠুর শাসন, সে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ফাঁসীর মঞ্চে যাঁরা জীবনের জয়গান গেয়ে নিজেকে আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে একটা স্বাধীন স্বদেশের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিলেন এবং ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশ ছিল ছাত্র-যুব-সমাজ। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের বুকে মায়ের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে যে ক’জন বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন ১৯৫২ সালে ২১ শে ফেব্রæয়ারীতে এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানী সবাই কিন্তু যুবসমাজের প্রতিনিধি।
তাইতো কবি বলেছেন, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার শ্রেষ্ঠ সময়তার । সে সব শহীদের সে সব যৌবন উদ্দীপ্ত যুবকদের আত্মত্যাগ কি বিফলে গেছে? অবশ্য না। জাতি শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের স্মৃতির প্রতি অর্ঘ দিয়ে স্মরণ করে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, যৌবন শক্তির উদ্বোধন চাই। যৌবনের জয়গানে আমরা যেমন বিভোর, তেমনি অন্যদিকে শংকিতও বটে। আজকের বিশ্বজুড়ে যৌবন যেন ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এখনকার যৌবন যেন বিকারগ্রস্ত, বিপদক্লিষ্ট, তারুণ্যের বিপথগামী স্রোত এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে। সময় এসেছে- এখনই এ পথ রুদ্ধ করার। কারণ এ পাপ পংকিল পথ দীর্ঘ হলে দেশ ও জাতি হয়ে পড়বে জীবন্ত ফসিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে, যুবসমাজের ভ‚মিকা খুব হতাশা আর বেদনাদায়ক। কিছু সংখ্যক অপরিনামদর্শী যুবকের কারণে গৌরবোজ্জ¦ল যুবসমাজ আজ কলংকিত।সা¤প্রতিক সময়ে খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, ছিনতাই, রাহাজানী, চুরি-ডাকাতি, সর্বনাশা ড্রাগ নেশায় আসক্ত হয়ে অতলান্ত চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের যুবসমাজ।
একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উৎকর্ষতার মাঝে প্রগতির উল্টো পিঠে সওয়ার হয়ে আমরা পিছনের দিকে ছুটে চলেছি। এখানে যৌবনের জৌলুস যেন রূপ কথার গল্প। সামাজিক-সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সব দিকে যুবসমাজ আজ অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার। পরীক্ষাগারের গিনিপিগ বানিয়ে বুকে ধারালো ছুরি চালিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে উঁচুতলার সমাজপতিরা। হাসিমুখে বিষের পেয়ালা তুলে দিচ্ছে তারুণ্যদীপ্ত সে সব যুবকের ঠোঁটে। অবুঝের মতো আকন্ঠপান করে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে তারা।
লক্ষ লক্ষ যুবক-যুবতী বেকার, কর্মসংস্থানের অন্বেষায় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অভিভাবকদের যথাযথ কর্তব্য পালনে অবহেলা, সুদৃষ্টির অভাবে বিপথে পরিচালিত হচ্ছে যুবকেরা। ধর্মীয় নীতি বোধের অভাব কিংবা ধর্মান্ধতা, কু-শিক্ষার ফলে পরীক্ষায় নকল প্রবণতা যা শিক্ষা ব্যবস্থাকে, আগামী ভবিষ্যতকে পঙ্গু করে নতুন প্রজš§কে অন্ধকারে নিমজ্জিত করার প্রয়াস চলছে।
মাদকদ্রব্যের বিষাক্ত ছোবলের বিষে বিষে নীল হয়ে আছে পুরো যুবসমাজ। শহরের অলি-গলি থেকে গ্রামগঞ্জের হাটবাজারেও পৌঁছে গেছে সে সব নেশা দ্রব্য, গাঁজা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, আফিম, সরস, মারিজুয়ানা ইত্যাদি। সমাজের প্রায় প্রতিটি পরিবারের যুবকেরা এ সব নেশায় আসক্ত। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকারী, বেসরকারী, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।
জীবন স্রোতের এ উপক‚লে যৌবনের জলতরঙ্গের টুং টাং সুরধক্ষনি, জীবনকে প্রাণিত করে, প্রাণবন্ত করে। যৌবনকে সুন্দর সুশ্রী ও উপভোগ্য করতে হলে প্রথমতঃ চাই সৎ শিক্ষা। উপযুক্ত শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন ছাড়া যৌবন জীবন নিষ্ফলা হতে বাধ্য। সদাচারে, বিনয় নম্রতায় ও সৌন্দর্যে কখন আর্থিক ব্যয় হয় না। যে কোন সামাজিক পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সাংগঠনিক পরিবেশে কিংবা সভা-সমিতিতে এ সব সহজে অধিগত করা যায়।মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, ভ্রাতৃত্বভাব, সহমর্মিতা ও মানবিক গুণাবলী একটু সচেতন হলেই অর্জন করা সম্ভব। আর এ সব গুণাবলী, মহিমা যৌবনের বড় স¤পদ-চরিত্রভ‚ষণ।জীবন যৌবনের প্রতি আহবানই, সুন্দর, মহৎ মানুষ চাই, আলোকিত মানুষ ও আলোকিত জীবন যৌবনই আমাদের কাম্য।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট।