শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৪১ অপরাহ্ন
আফতাব চৌধুরী : লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর বুকে যেদিন প্রাণ ও প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছিল সে দিন প্রকৃতি ও পরিবেশে এক সাম্য ছিল। এ ভারসাম্য বজায় রাখতে এক এবং একমাত্র ভূমিকা ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের পথ ধরেই মানুষ একটু একটু করে গড়ে তুলেছে নিজের পরিবেশ। মানুষের রচিত পরিবেশ তারই সভ্যতার বিবর্তন-ফসল। মানুষ তার নুতন নুতন আবিষ্কারের প্রতিভা, পরিশ্রম আর দক্ষতা দিয়ে সংগ্রহ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন পদ্ধতি। অধিগত করেছে জীবন-বিকাশের নানা উপকরণ। তাই দিয়ে সে তার নিজের প্রয়োজন ও রুচি অনুযায়ী তৈরী করেছে তার পরিবেশ। এই পরিবেশের মধ্যেই তার বিকাশ তার বিনাশের ইঙ্গিত। আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার অগ্রগতিই তার কাছে বিভীষিকার বস্তু, এক দুঃস্বপ্নের মহাত্রাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরবে মোহান্ধ মানুষ পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করেছে। আজও করছে। ছড়িয়ে দিয়েছে ক্ষতিকর সব আবর্জনা। তার ফল হয়েছে বিষময়। পরিবেশ হয়েছে দূষিত। আর দূষিত পরিবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য করছে বিনষ্ট। তাই গোটা জীব-জগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন।
মানব সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে পরিবেশ দূষণের শুরু। মানুষ শিখল আগুন জ্বালাতে, বন কেটে করল বসত। সে সাথে সভ্যতার বিচিত্র বিকাশের প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ হতে থাকল দূষিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে শুরু হল নতুন যুগের নতুন সভ্যতার, শুরু হল নগর জীবনের, গড়ে উঠল অসংখ্য শিল্প কারখানা, যানবাহনের প্রাচুর্য দেখা দিল পথে পথে, সবুজ বিপ্লব ঘটাতে এল কীটনাশক। আণবিক ও পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে গেল আকাশ বাতাসে। ফলে পরিবেশ দূষণ দেখা দিল ব্যাপকভাবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ পানি, মাটি ও বায়ুর ওপর পড়ছে প্রচন্ড চাহিদার চাপ। শুরু হয়েছে বনসম্পদ বিনষ্টের অমিত উল্লাস। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণীজগৎ। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য এসে পৌছেছে এক সঙ্কটজনক অবস্থায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি উৎপাদনের চাহিদা। শক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে নির্গত হয় মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশদূষক নানা রাসায়নিক। রাসায়নিক দ্রব্যই নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধির দ্রæত প্রসারণের কারণ। এতে বায়ু, পানি ও খাদ্যদ্রব্য মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
আমাদের পরিবেশদূষণকাী অপদ্রব্যগুলো মোটামুটি দু’ভাগে বিভক্ত। ১. প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে রয়েছে-সীসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ইত্যাদি। এর মধ্যে কতগুলো আবার আমাদের মলমূত্র শরীরের পচন থেকে উৎপন্ন। সুতরাং জনসংখ্যা পালিত পশুর সংখ্যা বৃদ্ধির অর্থ এ ধরনের দূষকের নিয়মিত হারে বৃদ্ধি। ওসব দূষকের সঙ্গে যুক্ত হয় জ্বালানী দহনের ফলে সৃষ্ট অজৈব দূষক। তার উপর আছে কৃত্রিম দূষকের সমস্যা। কৃত্রিম দূষকের অন্তর্গত হলো-নানা কীটনাশক, গুড়ো সাবান ঔষধপত্র ও প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি প্লাস্টিকও। এসব যৌগের কয়েকটি আমাদের পরিবেশে বহুদিন ধরে টিকে থাকে। রোদ, জ্বর, বাতাস, জীবাণু এদের কোন ক্ষতিই করতে পারে না। এ ধরনের যৌগ নিয়েই পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তা বেশী। দূষণের প্রকৃতি ও পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে বিভিন্নতা। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম সম্ভার হলো বায়ু। সে বায়ুদূষণ আজ সারা বিশ্বজুড়ে। সকলের স্বাস্থ্যের পক্ষেও এক গুরুতর সমস্যা। ঝুলজাতীয় কার্বন কণা থেকে শুরু করে ভারী ধাতু, জটিল জৈব যৌগ, নিউক্লিয় আবর্জনা, জীবাশ্ম জ্বালানী অর্থাৎ তেল, কয়লা ইত্যাদি পুুড়িয়ে কার্বন-ডাই অক্সাইডকে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া, ক্লোরোফ্লুরোমিথেন, নাইট্র্রাস অক্সাইড, আলোক-রাসায়নিক ধোয়াশা ইত্যাদি সবই হলো বায়ুদূষণের প্রধান উপকরণ। বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ত বাড়ছে। এর ফলে আবহাওয়ায় তাপমাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। অকালবর্ষণ, ঝড়জল, কুয়াশা এরই ফলশ্রæতি। এরকম আবহাওয়ায় চাষাবাস হয় অনিশ্চিত। কুয়াশা আর তেল, কয়লা দহনের ফলে নির্গত গ্যাসের মিশ্রণে ধোয়াশার সৃষ্টি। এরকম আবহাওয়ায় চাষাবাস হয় অনিশ্চিত। কুয়াশা আর তেল, কয়লা দহনের ফলে নির্গত গ্যাসের মিশ্রণে ধোয়াশার সৃষ্টি। তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা মারাত্মক। মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট, হাপানী, দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস, ফুসফুস-ক্যান্সার এ জাতীয় দূষণের ফল। বিভিন্ন যানবাহনের নির্গত ধোয়া সূর্যের আলোর সংস্পর্শ এসে তৈরী করে আলোক-রাসায়নিক ধোঁয়াশা। অক্সাইড ও হাইড্রোকার্বনের বিক্রিয়ায় আরও কিছু বায়ুদুষণের সৃষ্টি হয়। ওজোন গ্যাস ও পরক্সি অ্যাসিটাল নাইট্রাট তার অন্যতম। এতে তরিতরকারী ও শস্যের ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক। এছাড়া আরও এক ধরনের বায়ুদূষণ আবহাওয়ার ছড়িয়ে থাকে। এগুলো হলো বাতাসে ভেসে বেড়ানো জীবাণু। অ্যালার্জিজনিত রোগে এসব জীবাণুর ভূমিকা অনেকখানি।
পানিদূষণ আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ। পৃথিবীর সমুদ্র, নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদির পানি নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। ভারী ধাতু. হ্যালেজেন নিষিক্ত হাইড্রোকার্বন, কার্বন-ডাই অক্সাইড, পেট্রোলিয়াম, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা, সর্বোপরি সংলগ্ন শহরের নির্গম নাল বেয়ে আনা দূষিত তরল আবর্জনা এগুলোই হলো সমুদ্র দূষণের কারণ। আমাদের নদীর পানি আজ নানা কারণে দূষিত। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ জনপদ, শহর। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক চটকল, কাপড় কল, কাগজের কল, চিনিকল ভেষজ তেল তৈরীর কারখানা, চামড়া পাকাকরণ কারখানা ইত্যাদি। এসব কল-কারখানার আবর্জনা প্রতিনিয়ত নদ-নদীকে করছে দূষিত। দেশের নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদি দূষণের জন্য নালা, নর্দমা, ঘর-বাড়ীর আবর্জনা ইত্যাদি দায়ী। এ থেকেই দূষিত হয় মাটি, দূষিত হয় পানীয় পানি। সমুদ্র, নদী, খাল-বিল পুকুরের মাঝেও নানারূপ দূষণ ঘটছে। ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকমের সংক্রামক রোগ। মাঝে মাঝে তা মহামারির আকার ধারণ করে। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায় কত জীবন। এমনি করেই দিনের পর দিন জনস্বাস্থ্য বিনষ্ট হচ্ছে।
শব্দদূষণ এ যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শহরে শব্দদূষণের মাত্রা সর্বাধিক। প্রতিনিয়ত এখানে মোটর গাড়ীর হর্ণ, কল-কারখানার বিকট আওয়াজ, বাজি-পটকার শব্দ রেডিও-ক্যাসেট-টেলিভিশনের শব্দ, লোকজনের চিৎকার, চেচামেচি, উৎসবের মত্ততা, মাইকের চড়া সুর, সব মিলে মিশে এক অপস্বর সৃষ্টির মহযজ্ঞ চলছে। শব্দদূষণের পরিণাম ভয়াবহ। এর ফলে হয় নানা বিপর্যয়ের সৃষ্টি। শ্রবণক্ষমতার বিলোপ ঘটে। মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়, রক্তচাপ বেড়ে যায়, অনিদ্রা রোগের শিকার হয়। হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি ও ¯œায়বিক অস্থিরতাও শব্দদূষণের পরিণাম। শব্দের ২০ থেকে ৪০ ডেসিবেল পর্যন্ত মাত্রা হলো স্বাভাবিক। শহরে এখন শব্দের পরিমাণ ৬০ থেকে ৬৫ ডেসিবেল, কোথাও কোথাও ৮০ ডেসিবেল যা মারাত্মক।
আয়নকারী বিকিরণ শক্তির এক ক্ষমতাশালী উৎস। সায়নাইড বা অন্যান্য বিকারকের তুলনায় এর তাপশক্তি ১০ কোটি গুণ তীব্র। পারমাণবিক যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে তেজস্ক্রিয় দূষণের বিপদ সবচেয়ে বেশি নিহিত। ১৯৬৩ সালে একটি মার্কিন নিউক্লিয় সাবমেরিন আটলান্টিক মহা-সাগরে হারিয়ে যায়। তা থেকে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে। নিউক্লিয় জ্বালানী উৎপাদন কেন্দ্রের আবর্জনা তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা নিয়ে ৬০০ বছর টিকে থাকতে পারে। প্লুটোনিয়ামের অর্ধ বায়ু ২৪.৩৬০ বছর এবং তার ক্ষতি করার ক্ষমতা ঐ অর্ধ আয়ুর কয়েক গুণ সময় পর্যন্ত বজায় থাকে। আণবিক ও পারমাণবিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ ক্যান্সার রোগের কারণ। তা থেকে অঙ্গবিকৃতিও হতে পারে।
পরিবেশ দূষণ মানব জাতির জন্য এক মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এ ব্যাপারে সারা বিশ্বের মানুষের সচেতনতা দরকার। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে এ সমস্যা আরও প্রকট, তবে জাতির স্বার্থেই তার মোকাবেলা করতে হবে । আর প্রয়োজন নদী ও সমুদ্রকে বাচানো। মনে রাখতে হবে নদী ও সাগরকে দূষণমুক্ত রাখতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।