শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:২৬ পূর্বাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার :: গত ৩০ আগষ্ট চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদ (বিটিএ) সংবাদ সম্মেলন করে ‘অন্য সব শিল্পের চেয়ে চা-শিল্পের শ্রমিকরা বেশি সুযোগ-সুবিধা বেশি পেয়ে থাকেন’ দাবি করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতিবাদ জানিয়েছে চা-শ্রমিক সংঘ। ১ সেপ্টেম্বর সংগঠনটির মৌলভীবাজার জেলা কমিটির আহবায়ক রাজদেও কৈরী ও যুগ্ম-আহবায়ক শ্যামল অলমিক একযুক্ত বিবৃতিতে চা-সংসদের বক্তব্য প্রত্যাখান করে বলেন সরকারের নিতম মজুরি বোর্ড কর্তৃক ঘোষিত বিভিন্ন শিল্প সেক্টর এবং মজুরি কমিশন ঘোষিত রাষ্ট্রায়াত্ব শিল্প সেক্টরের শ্রমিকদের মজুরির সাথে তুলনা করলে চা-শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। শুধু তাই নয় চা উৎপাদনকারী সকল দেশের মধ্যে চা-শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। এমন কি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা এবং আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ পীড়িত কেনিয়ার চা-শ্রমিকরাও বাংলাদেশের শ্রমিকদের থেকে বেশি মজুরি পেয়ে থাকেন। চা উৎপাদনকারী দেশেগুলো মধ্যে একজন চা-শ্রমিক কেনিয়ায় ৫৮৩ টাকা, ভিয়েতনামে ৩০৫ টাকা, নেপালে ৩২৪ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ২৬৪ টাকা এবং ভারতের কেরালায় ৫০৩ টাকা, কর্ণাটকে ৪৯৯ টাকা, তামিলনাড়–তে ৪০৬.৮০ টাকা, পশ্চিমবঙ্গে ২৭৭ টাকা, আসামে ২৫১ টাকা, ত্রিপুরায় ২১০ টাকা, বিহারে ২০৯ টাকা মজুরি পান। যেখানে এখনো বাংলাদেশের একজন চা-শ্রমিকের মজুরি মাত্র ১৭০ টাকা। রাজধানীর প্লাজা কনকর্ড টাওয়ারে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা মিলিয়ে একজন শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকার ওপরে দাড়ায় দাবি করা হয়। এছাড়া একজন চা-শ্রমিককে প্রতি সপ্তাহে ন্যূনতম ৮ কেজি রেশন(চাল/আটা) প্রদানের তথ্য তুলে ধরা হয়। নেতৃবৃন্দ চা-সংসদের বক্তব্যকে অস্বীকার করে বলেন একজন চা-শ্রমিককে প্রতি সপ্তাহে ন্যূনতম ২ কেজি ৩৭০ গ্রাম রেশন প্রদান করা হয়। তাও আবার যাদের ক্ষেতের জমি আছে তাদের প্রাপ্য রেশন থেকে প্রতি বিঘায় বার্ষিক ১১২ কেজি রেশন কেটে রাখা হয়, আদতে সেই সব শ্রমিক কোন রেশনই পান না। চা-সংসদের বক্তব্য প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিককে বাসস্থান প্রদান করা হয় অর্থাৎ ৫ লক্ষাধিক চা-জনগোষ্টির শ্রমিকদের কোম্পানি প্রদত্ত দুই কক্ষবিশিষ্ট বাসস্থানে গড়ে ৭ জনের বেশি মানুষকে বাস করতে হয়। যেখানে কোম্পানি রান্না করার জন্য আলাদা ঘরেরও ব্যবস্থা দেয় না। প্রায় এক লাখ স্থায়ী শ্রমিককের অনেককে বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করা হয়নি যার কারণে কোম্পানি প্রদত্ত একটি বাসস্থানে একাধিক পরিবারকে থাকতে হয়। চা-শ্রমিক ও তার পরিবারকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের কথা বলে চা-সংসদের তুলে ধরা ২ টি আধুনিক গ্রæপ হাসপাতাল এবং ৮৪ টি বাগানে ৭২১ শয্যার ব্যবস্থা, ১৫৫ টি ডিসপেনসারিসহ মোট ৮৯০ জনের অধিক মেডিকেল স্টাফ থাকার তথ্যকে নেতৃবৃন্দ ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ উল্লেখ করে বলেন মেডিকেল স্টাফ বলতে মূলত কম্পাউন্ডার, ডাক্তার ও নার্স নাই বললেই চলে। এছাড়া গত মে মাসে চা-সংসদ প্রদত্ত হিসেবে ৪০২ টাকা মজুরির তথ্য দিয়ে চিকিৎসা বাবদ ৭.৫ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। সেই হিসেবে মাসিক ২২৫ টাকা দিয়ে কি চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না; যেখানে একটি গ্যাসের ট্যাবলেটের দাম ৮/১০ টাকা।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যে চায়ের বাজারের জিডিপিতে চায়ের অবদান শতকরা ১ শতাংশ দাবি করে চা-সংসদ শ্রমিকদের কর্মবিরতির কারণে দৈনিক ২০ কোটি টাকা হিসেবে মোট ৪২০ কোটি টাকা ক্ষতির কথা তুলে ধরেন। প্রশ্ন হলো যদি কর্মবিরতির কারণে মালিকদের দৈনিক ক্ষতি ২০ টাকা হয়ে থাকে তাহলে শ্রমিকরা কাজে থাকলে মালিকদের লাভ কত টাকা হয়? আর শ্রমিকদের ৩০০ টাকা মজুরি দাবি মেনে নিলেও তো মালিকদের মজুরি বাবদ এক লক্ষ স্থায়ী শ্রমিকের জন্য দৈনিক পরিশোধ করতে হতো ৩ কোটি টাকা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধি করলেও তো ৫ কোটি টাকার বেশি কোন ভাবেই ব্যয় হতো না। তাহলে কেন মালিকরা ২০ কোটি টাকার ক্ষতি মেনে নিলেন? আসলে মালিকদের কৌশল হচ্ছে বার বার ক্ষতির বক্তব্য তুলে ধরে আগামী জানুয়ারিতে যাতে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিকে ফাঁকি দিয়ে তাদের অধিক মুনাফা নিশ্চিত করতে পারেন। সাপ্তাহিক মাত্র ১৫০ টাকা ভাতাকে মালিকপক্ষ পেনশন হিসেব প্রচার করা হয় উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন চা-শ্রমিকদের শ্রমআইন অনুযায়ী নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিসবুক, গ্রাচুয়েটি, কোম্পানীর লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ও কল্যাণ তহবিলে প্রদান ইত্যাদি অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উৎসব ভাতার(ঋবংঃরাধষ ইড়হঁং) পরিবর্তে কাজে উপস্থিতির উপর উৎসাহ ভাতা(ওহপবহঃরাব ইড়হঁং) প্রদান করে যুগ যুগ ধরে শ্রমিকদের ঠকিয়ে চলেছেন। এছাড়া মালিকদের দ্বারা প্রভাবিত শ্রমআইনেও নৈমিত্তিক ছুটি(১০ দিন) থেকে বঞ্চিত এবং অন্য শ্রমিকরা যেখানে ১৮ দিন কাজে ১ দিন ছুটি ভোগ করেন সেখানে চা-শ্রমিকদের জন্য প্রতি ২২ দিন কাজে ১ দিন বার্ষিক ছুটি নির্ধারণ করে চা-শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। নেতৃবৃন্দ ধর্মঘটী শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও রেশন প্রদান এবং বর্তমান বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে ৬/৭ জনের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য বাজারদরের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মজুরিসহ চা-শিল্পে নৈমিত্তিক ছুটি(বছরে ১০ দিন) কার্যকর ও বার্ষিক ছুটি প্রদানে বৈষম্যসহ শ্রমআইনের বৈষম্য নিরসন করে গণতান্ত্রিক শ্রমআইন প্রণয়ন, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মজুরি ও উৎসব বোনাস প্রদানে সকল অনিয়ম বন্ধ করে শ্রমআইন মোতাবেক নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিসবুক প্রদান এবং ৯০ দিন কাজ করলেই সকল শ্রমিককে স্থায়ী করার দাবি জানান।