শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন
এম এ রকিব :: পঞ্চাশোর্ধ বয়সের স্লিম ফিগারের ফর্সা এবং মায়াবী চেহারা আর রসালো কথাবার্তার মানুষটির সাথে অল্প বয়সি মেয়েটির পরিচয় হয় গত ৭/৮ মাস আগে। শহরের একটি ফলের দোকানে আম কিনতে গিয়ে তাদের পরিচয়। প্রথম দেখাতেই লোকটির কৌশলী কথার ফাঁদে পড়ে মোবাইল নাম্বার বিনিময় হয়। মাঝে মধ্যে মোবাইলে কথাবার্তা বলা থেকে ভাললাগা। এরপর ভালবাসা, শুরু হয় প্রেম, অত:পর বিয়ে।
বাবার বয়সি লোকটির সাথে ডলি স্বপ্ন দেখে সংসার করে সুখি হওয়ার। দীর্ঘ আট মাস স্বামী-স্ত্রীর খুঁটিনাটি ঝগড়ার মধ্যে ভালই কাটছিল ডলির ভালবাসার স্বপ্নের সংসার। কিন্তু বিয়ের মাত্র আটমাস পর স্বামীর নিষ্ঠুর দুই হাত শেষ করে দিল ২০/২২ বছর বয়সি ডলির রঙ্গিন স্বপ্নের সুন্দর জীবন।
ওড়না পেছিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর পুরো একদিন স্ত্রীর লাশের সংগে বসবাস করে ঘাতক স্বামী। প্রিয়তমা মৃত স্ত্রীর পা ভেঙে বস্তাবন্দী করে রাখা হয় নিজের বসত ঘরে। সুযোগ বুঝে রাতের অন্ধকারে সিএনজি যোগে বাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে, উদনাছড়ায় নিস্তব্ধ, নির্জন এলাকায় ব্রিজের উপর থেকে ফেলে দেয় প্রেয়সীর বস্তাবন্দী মৃতদেহটি।
ঘাতকের বুক ভরা গভীর নিশ্বাস, সরে গেল হাজার মণ ওজনের পাথর। আহ! কি শান্তি। কেউ জানল না, শুনল না! পুলিশ হাজার চেষ্টা করেও পেল না হতভাগিনীর পরিচয়। এরমধ্যে অন্ধকারে আশার আলো পায় পুলিশ। যে বস্তা দিয়ে প্রেয়সির লাশ ফেলে দেয় ঘাতক সেই বস্তার গায়ে লেখা দুটি শব্দ। ‘‘মো: অনিক, শ্রীমঙ্গল।”
শুরু হয় পুলিশের অনিককে খুঁজার পালা। অনেকগুলো অনিক খুঁজে পেলেও পায়নি কাঙ্খিত অনিককে। হাল ছাড়েনি বেরসিক পুলিশ। অনেক চেষ্টার পর পরিচিত এক কাপড় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে পেয়ে যায় বস্তার মালিক অনিককে। শুরু হয় অভিযান, কে নিয়েছিল অনিক লেখা সেই বস্তাটি। পুরো শহরজুড়ে চষে বেড়ায় পুলিশের অনেকগুলো টীম।
অবশেষে পেয়ে যায় সেই ব্যাক্তিকে, যিনি অনিকের কাছ থেকে চা পাতা প্যাকেট করার কথা বলে বস্তাটি নিয়েছিলেন। তাকে নেয়া হয় পুলিশি হেফাজতে, কিন্তু তিনি ফেরেশতার মতো আচরন করতে থাকেন, যেন কিছুই জানেন না। নিজের স্ত্রীর লাশের চেহারা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করার পরও বলেন তিনি তাকে চিনেন না।
পুলিশ তখনও জানে না, কি নির্মম সত্য অপেক্ষা করছে। চলছে কথার ঝাপি, নাম-ধাম, স্ত্রী-সংসার আরও কত কি ? ৪টি বিয়ে করার কথা শিকার করেন তিনি। জানান, প্রথম স্ত্রী ২ ছেলে ২ মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকে। দ্বিতীয় স্ত্রীও ১ ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকে। তৃতীয় স্ত্রী বিয়ের একদিন পর’ই চলে যায়। চতুর্থ স্ত্রী’কে নিয়ে তিনি নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন, কিন্তু তিন দিন পূর্বে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গেছে সে।
খটকা লাগে এখানেই। শুরু হয় পুলিশের ব্যাপক জিজ্ঞাসা। তিন দিন পূর্বে আপনার স্ত্রী বাড়ি থেকে চলে গেল। থানায় জানাননি কেন ? জবাব, চতুর্থ স্ত্রীর বড় ভাইকে ফোন করে জানিয়েছেন। ঘাতকের কাছ থেকে ফোন আর ঠিকানা নিয়ে ঝিনাইদহে থাকা চতুর্থ স্ত্রীর ভাইয়ের সাথে পুলিশের শুরু হয় কথা বলা। গ্রামের সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষটির স্মার্ট ফোন না থাকায় বোনের ছবি ভাইয়ের কাছে পাঠানো কিছুটা বিলম্ব হয় পুলিশের।
তখন ঝিনাইদহে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির কারনে লোকটি কোনভাবেই ইন্টারনেট সাপোর্টেট মোবাইল নম্বর দিতে পারেনি। পুলিশের অনুরোধে এক পর্যায়ে প্রতিবেশীর একটা মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে দিলে তাতে বস্তাবন্দী মৃতদেহের ছবি পাঠিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করতে থাকে পুলিশ। বেশ সময় পর তিনি জানান, মৃতদেহটি তার হতভাগিনী বোন ডলির। লোকটি পুলিশকে আরো জানায়, ডলির বিয়ে হয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। স্বামীর নাম মাসুদ মিয়া। ডলি শ্রীমঙ্গলেই স্বামীর সাথে বসবাস করেন। ঈদের পরদিন ফোন দিয়ে ডলি বলেছিল ভাল নেই সে। স্বামী খুব’ই নির্যাতন করছে।
বলছিলাম, গত মঙ্গলবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখান ইউনিয়নের উদনাছড়ার ব্রিজের নিচ থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় নাম পরিচয় বিহীনভাবে উদ্ধার করা অজ্ঞাত তরুনী (পরে পরিচয় পাওয়া) ডলির কথা। ডলি ঝিনাইদহ সদর থানার বধনপুর এলাকার মৃত ফেনু মন্ডলের মেয়ে এবং উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের মৃত এখলাস মিয়ার পুত্র মসুদ মিয়ার ৪র্থ স্ত্রী।
শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (সদ্য পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) মোঃ আশরাফুজ্জামান এসব তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ ততক্ষণে সবকিছ বুঝে গেলেও মৃতদেহটি যে তার চতুর্থ স্ত্রীর সেটা ঘাতক শিকার করেনি। চিনতে পারেনি তার স্ত্রীর মরদেহ! তার আচরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক। গভীর রাত তখন, তাই বলে থেমে যাওয়ার সুযোগ নেই পুলিশের। ঘাতক মসুদকে নিয়ে গভীর রাতে পুলিশ তার বাড়িতে যায় ডলির সংসার দেখতে। মসুদের বাড়িতে গিয়ে প্রতিবেশীর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি ঘটনার আগের রাত সাড়ে আটটায় সিএনজি অটোরিক্সার শব্দ পেয়েছেন তারা। এ তথ্য পেয়ে শুরু হয় আমাদের সিএনজি খোঁজার পালা।
তিনি জানান, স্থানীয় পরিবহণ শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় পুলিশ সহজেই পেয়ে যায় সিএনজি চালককে। খবর দিতেই থানায় এসে হাজির হয় সিএনজি চালক। সিএনজি চালকের সাথে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে কিভাবে, কোন পথে, মসুদ তার প্রিয়তমা ডলির লাশ বস্তাবন্দী করে ব্রিজের উপর থেকে নীচে ফেলে দেয়। কতটা নিষ্ঠুর হলে সম্ভব এমন ঠান্ডা মাথায় স্ত্রী’কে খুন করে লাশ বস্তাবন্দির পর গুম করার। মাত্র আট মাসে বাবার বয়সি লোকের সাথে প্রেমে পড়ে বিশ্বাস করে ভালবেসে সংসার করে সুখি হওয়ার যে স্বপ্ন দেখেছিল ডলি, সেই স্বপ্নভেঙ্গে অনাকাঙ্খিত মৃত্যুই হল তার শেষ পরিনতি।
তিনি আরো জানান, মসুদ মিয়া একজন খারাপ চরিত্রের লোক। সে এলাকায় সুদের ব্যবসা করে আসছিল দীর্ঘদিন থেকে। একাধিক স্ত্রী ছাড়াও সে বিভিন্ন মহিলাদের সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত থাকায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যের জেরে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় গত ১৭মে দিবাগত রাতে। এসময় মসুদ মিয়া ডলিকে কাপড় দিয়ে গলায় চেপে শ^াসরোধ করে হত্যা করে। পুলিশের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে ক্লুলেস একটি হত্যাকান্ডের হত্যাকারীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
এব্যাপারে শ্রীমঙ্গল থানায় এসআই আসাদুর রহমান বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামিকে বুধবার আদালতের মাধ্যমে জেলে প্রেরন করা হয়। আর ডলির মৃতদেহ তার স্বজনদের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বাদ যোহর মসুদের এলাকা রামনগর মসজিদের পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়।